রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

শাক্য দ্রুত দৌড়াচ্ছিল। যদিও শাল-সেগুনবৃক্ষের ইতস্তত বেড়ে ওঠা প্রাচীন কাণ্ডগুলি তার সবেগ চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল খুব। কিন্তু এ-সব ট্রেনিং তার নেওয়া আছে। ফলে তেমন অসুবিধা তার হচ্ছিল না। রোজ সকালে সে যে ট্রেডমিলে ঘাম ঝরায়, পুশ আপ করে, ওয়েট লিফটিং করে তার নিজস্ব ছোট জিমে। তার সুফল এখন পাচ্ছে। মেদহীন ছয় ফুটের শরীরটা নিয়ে সে দৌড়াচ্ছিল, যেন কোন প্রাচীন পারঙ্গম হরিণ। তার পিছন পিছন পাভেল দৌড়াচ্ছিল। আজ পাভেলের মেদলালিত, সুখী চেহারা দেখলে কেউ বুঝতেও পারবে না, একদিন সে যখন এই সার্ভিসে জয়েন করেছিল, তখন পাভেলেরও একটা ঈর্ষণীয় ফিজিক ছিল। কিন্তু আজ তার “হায় লাঠি, তোমার দিন গিয়াছে” অবস্থা। সে একটানা দৌড়াতে পারছিল না, হাঁফাচ্ছিল। থেকে থেকেই দাঁড়িয়ে পড়ছিল সেই কারণেই। ফলে ক্রমাগত তার এবং শাক্যের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছিল।

পাভেলের একবার মনে হল, এ কোনও ফাঁদ নয় তো? কারণ এই যে এখন তারা এই জঙ্গলে অজ্ঞাত কারও পিছনে কিছু না-জেনেই ছুটে চলেছে, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা পর্যন্ত করেনি, এমন তো হতে পারে। এইভাবে গভীর জঙ্গলের আরও গভীরে নিয়ে গিয়ে এরা তাদের দু’জনকে ফ্যাসাদে ফেলল! তার মন কু গাইছিল। পকেট থেকে পুলিশি রিভলভারখানা হাতে নিয়ে চারপাশ ভালো করে দেখতে দেখতে চলল। সে ঠিক করে নিল, অচেনা এবং সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই সে এক-আধবার ওয়ার্নিং দেবে ঠিকই, কিন্তু তারপরেই উক্ত ব্যক্তির পা লক্ষ্য করে গুলি চালাবে!
শাক্য ছুটছিল। অন্ধের মতো নয়, সামনে দ্রুত ধাবমান ব্যক্তিই তার লক্ষ্য। লোকটি ছুটে চলেছে ক্ষিপ্রগতিতে। যেন জঙ্গলের গাছপালা-ঝোপঝাড় কোনওকিছুই তার কাছে বাধা নয়। এরকম তখনই হতে পারে, যখন কেউ জঙ্গলকে হাতের তালুর মতো চেনে। এই লোকটি সম্ভবত সেইরকম। কারণ অতর্কিতে বাঁক নিতে হলে যেমন কিছুটা গতি কমে আসে, কারণ মস্তিষ্ক চিন্তা করবার জন্য কয়েক সেকেন্ডের জন্য মুভমেন্ট কিছুটা শ্লথ হয়, এর ক্ষেত্রে সেই রকম কিছুই হচ্ছিল না। যেন সে জানে, এরপর কোথায় কী আসবে, কোথায় কাঁটাঝোপ আছে, কোথায় ভূপতিত কোন গাছের গুঁড়ির বাধা। শাক্য একবার হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও সামলে নিল। সামনের ব্যক্তিটি সেই সুযোগে কিছুটা হলেও এগিয়ে গেল।

লোকটি বেশি লম্বা নয়, বেঁটেখাটো চেহারা। বেশ রোগাই। মাথার চুল দীর্ঘ। অনেকটা মেয়েদের মতো লম্বা চুল রেখেছে সে। পরে আছে সাধারণ ধূসর প্যান্ট এবং জংলা রঙচঙে একটা শার্ট। তবে শার্টটা পুরানো, রং জ্বলে যাওয়া। পায়ে পাম্প শু। স্থানীয় লোক বলেই মনে হয়। কিংবা এই অঞ্চলে অনেকদিন থাকতেও পারে, তা না হলে জঙ্গলকে এ ভাবে চেনা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৫: অরণ্য আদিম

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু! পর্ব-৩০: তাহলে ট্রেন টিকিটের সেই এম-২৫ কে?

শাক্য চাইছিল যেভাবেই হোক, লোকটা ধরা পড়ুক। তাহলেই জানা যাবে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে লোকটা এখানে এসেছিল। সে কি তাদের উপর নজর রাখবার জন্য এসেছিল, না কি নিজের প্রয়োজনেই এসেছিল? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর নির্ভর করছে ভাবনার গতি কোন দিকে যাবে, সেই বিষয়টি। যদি তাদের উপর নজর রাখবার উদ্দেশ্য নিয়েই লোকটি এসে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, তাদের এই সময় এখানে আসার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কেউ না কেউ জানিয়েছে তাকে। কারণ, থানা থেকে এখানে যে আসবে, তা আগে থেকে ঠিক ছিল না। ঘটনা-পরিস্থিতিতেই তারা এখন এখানে। এত চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা এখানে এসেছে যে, দু’-চারজন ছাড়া আর কারও পক্ষেই তা জানা সম্ভব নয়। আর সেই দু’-চারজনের সকলেই থানার লোকজন, অবশ্য যখন সে বলছিল, তখন আশেপাশে আর কেউ শুনে থাকতে পারে। ড্রাইভার লোকটিও ওপরওলার নির্দেশ পেয়ে আগে থেকে জেনে গিয়েছিল যে, তাদের কোথায় কোথায় নিয়ে যেতে হবে। সে-ও অবশ্য পুলিশ-ডিপার্টমেন্টেরই একজন। যদি এদের কারও কাছ থেকে খবর যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে পিশাচ-আতঙ্কের একটা সুতো পুলিশের মধ্যেই আছে। সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তদন্ত করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১১: কলকাতায় ত্রিপুরার রাজনীতি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

আর যদি তা না হয়, যদি লোকটি নিজের তাগিদেই এখানে এসে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এই রহস্যময় ঘটনার অন্যতম কারিগর সে। তা না হলে, যে জায়গাটায় একটা মিসহ্যাপ হয়েছে একদিন আগে, এবং পুলিশ টেপ দিয়ে জায়গাটা ঘিরে রেখে সবার প্রবেশ নিষেধ বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে, সেখানে সাধারণ লোকের আসাটা অসম্ভব। এই জঙ্গলে কেউ যদি কাঠ কিংবা পাতার লোভেও এসে থাকত, তাহলে সে ছুটে পালাত না। কিন্তু সামনের ধাবমান ব্যক্তিটি যে কাঠকুটোর লোভে কিংবা পাতার আশায় এখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তা মনে হয় না। শাক্য যত ভাবছিল, ততই তার রোখ চেপে যাচ্ছিল। যে ভাবে হোক লোকটিকে ধরতে পারলে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া যাবে তদন্তে। কারণ, তার মন বলছে, এই লোকটি এই অঞ্চলের ঘটনাক্রমের অন্যতম দোসর কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীও হতে পারে।

ভাবতে ভাবতে শাক্য বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ পড়ে থাকা একটি ভাঙা ডালে সে হোঁচট খেল। তার মুখ দিয়ে ব্যথাসূচক একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল, “আঃ!”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা

নাহ্‌, মাটিতে আছড়ে পড়েনি অবশ্য সে, তার আগেই শরীরটাকে ব্যালেন্স করে নিতে পেরেছে একখানা ঝুঁকে পড়া নরম ডাল ধরে। সমস্ত ঘটনা আর কতটুকু সময়ই বা নেবে? কিন্তু ওইটুকু মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল বোধহয় সামনের ব্যক্তিটির পক্ষে। নিমেষে সে হাওয়া হয়ে গেল সামনের গাছপালার জটলার আড়ালে। নিজেকে সামলে নিয়ে যতক্ষণে শাক্য সেখানে পৌঁছাল, দেখতে পেল তার চারপাশে নিবিড় শালজঙ্গল ছাড়া আর কিছু নেই। জঙ্গলের অনেকটাই গভীরে চলে এসেছিল সে। দুপুর বেলার রোদও এখানে সামান্যই প্রবেশ করতে পেরেছে। ঝিঁঝিঁ ডাকছিল একটু আগেও, কিন্তু এখন তারা হঠাৎ যেন চুপ করে গিয়েছে। পায়ের তলায় শালের নবীন গাছগুলি কেবল।

এই জঙ্গলে কালাচ, শাঁখামুটে ইত্যাদি সাপ আছে বলে শুনেছে সে। একেজি যে রিপোর্টগুলি তাদের পড়তে দিয়েছিলেন, সেখানেই ছিল। ওদের কবলে পড়ার অর্থ সাক্ষাৎ মৃত্যু। তার পায়ে হান্টিং বুট নেই এই মুহূর্তে। থাকার কথাও নয়। যত দ্রুত সম্ভব তাকে বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। সে সামনের দিকে তাকাল। নাহ্‌, কোথাও কেউ নেই। এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে লোকটি যেন হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেছে। কান পেতে শোনবার চেষ্টা করল সে যদি কোথাও শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ কিংবা নড়াচড়া করার কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। জঙ্গল যেন এখন রুদ্ধশ্বাস কিছুর প্রতীক্ষায় আছে। কোথাও একটা পাখি ‘টুইটুই’ করে ডাকল। শাক্যর মনে হল, জঙ্গল যে জীবিত, ওই ডাকটাই তার প্রমাণ। চারপাশে তাকিয়ে দেখল সে, কেউ কোথাও নেই।

একটু আগেও পাভেল তার পিছন পিছন দৌড়ে আসছিল। কিন্তু সে-ও বোধহয় ক্ষান্ত দিয়েছে। শাক্যও স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে হয়তো আসবার আগে দু’বার ভাবত। কিন্তু তার মধ্যে তখন রোখ চেপে গিয়েছিল বলেই সে কোন কিছুই না ভেবে দৌড়েছিল। এখন তাকে যদি এইখানে কেউ অতর্কিত আক্রমণ করে মেরে রেখে যায়, তাহলে তার মরণান্তিক আওয়াজ শুনে পাভেল হয়তো খুঁজে খুঁজে আসবে এই স্পটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে। নাহ্‌, ফিরতে হবে। এই পর্বের শেষাংশ আগামী পর্বে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content