বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

ফোনটা আসতেই উন্মেষা কেটে দিল। সাইলেন্ট মোডে সব সময়েই সে রাখে এখন ফোনটা। অঞ্জন না হলে হাজার একটা প্রশ্ন করে। কে ফোন করেছে, কেন করেছে, তার সঙ্গে কী সম্পর্ক—বিরক্ত লাগে উন্মেষার। তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেউ মাথা গলাক, তা সে চায় না। অঞ্জন হলেও নয়। এমনিতেও অঞ্জন এখনও লিগ্যালি তার কেউ নয়। ভবিষ্যতে কী হবে তা সে জানে না। কিন্তু যতদিন না কিছু একটা হচ্ছে, ততদিন সে কারও খবরদারি বরদাস্ত করবে না। বিয়ে হলেও কী করত?

হিরণ্ময় কখনও করেনি। খুব সাই ছিল। মিশুকে ছিল না মোটেই। নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকতে ভালোবাসত। যেদিন তাকে প্রপোজ করে সে, সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল উন্মেষা। তার জীবনে যে ঝড় বয়ে গিয়েছিল তখন, তার পরেও যে কোনও পুরুষ তাকে মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারে, ভালোবাসতে পারে, এ তার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু হিরণ্ময় সে-সব মাথাতেও আনেনি, বরং যখনই সে ওই প্রসঙ্গ তুলতে চেয়েছে, হাত দিয়ে মুখ চাপা দিয়েছে। এত শান্ত, ধীর, অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ জীবনে আর কাউকে দেখেনি সে। এমনকি বিশেষ মুহূর্তগুলিতেও হিরণ্ময় তাড়াহুড়ো করত না। সঙ্গমের সময় সে উন্মেষার নিরাবরণ দেহকে যেন প্রতিবার আবিষ্কার করত। তার স্তনের ভাঁজের তিলে হালকা চুমু খেতে খেতে বলত, “দেহ হল পাহাড়ের মতো। যতবার ট্রেক করো, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আর ট্রেক করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করতে নেই। বুঝলে ম্যাডাম?”

ভালোবাসার আদরে ভেসে যেতে যেতে উন্মেষা বলত, “উম্ম্! তুমি এত রোম্যান্টিক, তা তোমার সঙ্গে এই বিশেষ মুহূর্ত যে না কাটিয়েছে, সে জানতেও পারবে না। তোমাকে তো সবাই জানে গোমড়ামুখো, রামগড়ুরের ছানা বলে!”
“জানা কি আর এক জীবনে ফুরায় উমি? যদি জানা ফুরিয়েই যায়, তাহলে জানবে সম্পর্ক শেষ। প্রেমিক-প্রেমিকা বল, স্বামী-স্ত্রী বল কিছু জিনিস অজানা থাকা ভালো, কিছু জিনিষ রহস্যময় না-জানার আবরণে ঢাকা থাকা ভালো। তাতে কৌতূহল জেগে থাকে। আর কৌতূহলই সম্পর্ককে ধরে রাখে। ছিঁড়তে দেয় না।”
“কী যে সুন্দর বল তুমি!”
“শুধু বলি? করি না?”
“কী?”
“আদর?”
“যাঃ! খুব দুষ্টু তুমি!”
“বেডে কতটা দুষ্টুমি করি, সে-বিষয়ে কিন্তু রিপোর্ট দিলে না কখনো!”
“যাঃ!” ব্লাশ করে উন্মেষা। হিরণ্ময়ের জিভ তার শরীরে আলপনা দিচ্ছিল।
“যাঃ কী! রিপোর্ট না পেলে এই অধমের মন ভেঙে যাবে জানো না তুমি? যন্ত্রও আর ঠিক মতো পারফরম্যান্স দেখাতে পারবে না!” বলে উন্মেষার মুঠোতে যন্ত্রটাকে ধরিয়ে দেয় সে।
আলতো আদর করতে করতে উন্মেষা বলে, “বাইরে তো মুখে কথা সরে না, লাজুক দি গ্রেট। এ দিকে বেডে একেবারে মুখে কথার ফুলঝুরি ছোটে? কী ব্যাপার? বহুত ছুপে রুস্তম হো তুম্!”
হিরণ্ময় গভীর শ্বাস ছেড়ে বলে, “আমি সবার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারি না। ইন ফ্যাক্ট তোমার কাছে যা পারি, আর কারও কাছে তা পারব কি না তা-নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। সবার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে নেই উমি। তাতে সকলে ভুল বোঝে। নিজেকে কেবল নিজের মানুষের কাছেই মেলে ধরতে হয়।”
হিরণ্ময় কী দুঃখ পেল তার কথায়? তার মন ঘোরাতে উন্মেষা তার যন্ত্রটায় নখ দিয়ে আঁচড় কাটে। বলে, “আদর কি আজকের মতো শেষ?”
উন্মেষার গভীর কন্দরে রেনবো কিস্ দিতে দিতে হিরণ্ময় অস্ফুট গলায় কী বলতে চেয়েছিল কে জানে? কোনদিন আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি তার।
অঞ্জন বলল, “কারও কথা ভাবছো না কি একটু আগের অভিজ্ঞতার কথাতেই ডুবে আছো?”
অঞ্জনের কথায় চটকা ভাঙে উন্মেষার। মনের ভাবকে বাইরের শীতলতায় ঢাকা দিতে দিতে বলে, “নাহ্, কার কথাই বা ভাবব? একটু আগের অভিজ্ঞতার কথাও ভাবছিলাম না। ভাবছিলাম, পিশাচ পাহাড়ে আসাটা ভুল হয়েছে আমাদের। এখানে এসে এমন সব অভিজ্ঞতা হবে জানলে আমি আসতামই না।”
অঞ্জন বলল, “তোমার কী ধারণা আমিই আসতাম? শালা যতসব গান্ডুদের কথা শুনে নেচে উঠলাম। এদিকে আর এক জন, শুয়ারের বাচ্চা আর্য, আমার দামি বাইকটা নিয়ে কোথায় যা লাপাতা হয়ে গেল! এখন থানায় গিয়ে দেখতে হবে, ওই বাইকটা যেটা পাওয়া গিয়েছে কোনও এক জঙ্গলের ধারে, সেটা আমার কি না! আর যদি আমারই হয়, তাহলে ওটা কেস না মেটা পর্যন্ত অ্যাভিডেন্স হিসেবে থানাতেই পড়ে নষ্ট হবে। যখন ফেরৎ পাবো, তখন ওটা ইউজলেস হয়ে যাবে। আমার এত টাকার বাইক! পুরোটাই জলে গেল!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬১: মধ্যদিনের রক্তনয়ন

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২৬: রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে বাবু

উন্মেষা বলল, “আর্যকে বাইকটা না দিলেই পারতে! তুমি অমন করে বললে বলেই আমি আর আপত্তি জানাইনি। আপত্তি করলে আজ এমন দুর্ভাবনায় পড়তে হত না তোমায়।”
অঞ্জন বলল, “আর্য তোমার ভালো বন্ধু, সেই জন্যই তার কথাতে আমি কনভিন্স হয়েছিলাম।”
“কে যে ভালো বন্ধু আর কে যে নয়, তা কি আর বাইরে থেকে বোঝা যায়, বলো?”
“তা যায় না! তবুও…!”
“আসলে কী জানো, পরিস্থিতিতে না পড়লে মানুষ বুঝতেই পারে না, কে তার প্রকৃত বন্ধু, আর কে নয়! এই আর্যকে তুমি ভালো ভাবছ, তার বাইরের অ্যাপিয়ারেন্স দেখেই ভালো লেগেছে হয়তো তোমার, কিন্তু যদি দেখো, সে তা আদৌ নয়, আসলে সে ক্যামাফ্লেজ করে থাকা শয়তান একজন, তাহলে কিন্তু তোমার ধারণা মুহূর্তে বদলে যাবে, নয় কি?”
“সে তো যাবেই। এই রকম কতজনের সঙ্গেই তো আমরা রাস্তায় পরিচিত হই। জানবে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুরাই অনেক ক্ষেত্রে পিছন থেকে ছুরি মারে। বিশ্বাসের সুযোগ নেয়।”
“জানি অঞ্জন। আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে এ সব!” উন্মেষা আনমনা হয় একটু।
“তোমায় ভীষণ এক্সস্টেড লাগছে উন্মেষা। বাইকটা থাকলে এখনই তোমাকে একটু ঘুরিয়ে আনতাম।”
“পুলিশ বেরুনোর পারমিশন দিত বলে মনে হয় তোমার?”
“না দেওয়ার তো কিছু নেই। আমরা তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না?”
“পুলিশ এখন আমাদের সবাইকে ক্রিমিনাল ভাবছে। যতদিন না আসল অপরাধী ধরা পড়বে, ততদিন ভাববে। ভাবো তো, যদি এমন হয়, আসল অপরাধী এই হোটেলেই লুকিয়ে আছে, কিন্তু তাকে আমরা চিনতে পারছি না, পুলিশও চিনতে পারছে না, সে কী চাইবে? এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে একটু ঘুরে আসি বলে পালিয়ে যেতে, তাই না?”
“মানে? এই? তুমি কী আমাকে সাসপেক্ট ভাবছ না কি?” অঞ্জনের গলায় রীতিমতো উদ্বেগের সুর ঝরে পড়ে।
“আরে না না ! আমি তোমাকে বিষয়টা বোঝাবার জন্য একটা এক্সামপল্ দিলাম আর কী!” উন্মেষা স্বাভাবিক গলায় বলে।
“যাক বাবা! থ্যাংক গড যে তুমি আমায় তা ভাবোনি। আমার ভুল হয়েছে, বাইকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলায়!”
“সত্যি বাইকটা হারিয়ে তোমার বেশ ক্ষতি হয়ে গেল অনেকটাই!” উন্মেষার গলায় সান্ত্বনার সুর।
“হুস্, ছাড়ো তো!” অঞ্জন মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে, “অঞ্জন সাক্সেনা কি একটা বাইকের শোকে পাগল হয়ে যাবে না কি? আসলে শখে কিনেছিলাম, চালালামও না তো তেমন। এই যা তোমাকে নিয়ে ট্রিপে এলাম। পুরো রাস্তা দারুণ এনজয় করেছি। তোমার নরম বুকের ছোঁয়া যখন পিঠে লাগছিল না, উফ, ফাটাফাটি। এ সব ছেড়ে দ্যাট আনলাকি গাই তোমার হাজবেন্ড কোথায় উপরে গিয়ে বসে রইল। কপাল। কার খাবার কে খাচ্ছে!” বলে চোখ মারল উন্মেষাকে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ

উন্মেষা নিমেষে গম্ভীর হয়ে গেল। হিরণ্ময়ের প্রসঙ্গ অঞ্জন বা আর কেউ তুলুক, তা সে চায় না। পছন্দ করে না। সে বলল, “স্টপ ইট অঞ্জন! আমি চাই না ওর কথা তোমরা কেউ বল!”
অঞ্জন একটু অপ্রস্তুত হল। সে জানত, হিরণ্ময়ের কথা কেউ তুলুক, তা পছন্দ করে না উন্মেষা। কিন্তু ভুল হয়ে গেল একটু। প্রগল্ভতা না কী যেন বলে বাংলায়। সে ম্যানেজ করতে চেষ্টা করল উন্মেষাকে। “স্যরি ডার্লিং। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। নিজেকে কন্ট্রোল করা উচিত ছিল। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি ভেরি ভেরি স্যরি!” বলে সে উন্মেষার পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার নাটক করল।

উন্মেষা কিন্তু পা সরিয়ে নিল। তার মুখ থমথম করছিল আষাঢ়ের মেঘের মতো। সে কড়া গলায় বলল, “ইউ নো আই ডন্ট লাইক অল দিস ড্রামাজ। হাউ ডু ইউ ডু দ্যাট আফটার দ্যাট? কাম অন, আই ওয়ান্ট টু বি অ্যালোন। ইফ ইউ স্টে অ্যাট রুম, আই হ্যাভ টু গো অ্যান্ড সিট ইন দ্য গার্ডেন। অলদো দি পুলিশ উইল গিভ পারমিশন টু সিট দেয়ার আফটার দ্য ইনসিডেন্ট টুডে। ইফ নট, গো আউটসাইড। বেশিক্ষণের জন্য নয়, ঘণ্টা দুয়েকের জন্য হলেই হবে!”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

অন্য সময় হলে অঞ্জন মেজাজ দেখাত, আর্গুমেন্টে যেত, কিন্তু এখন হাওয়া গরম দেখে সে-পথে হাঁটল না। এখন বিবাদ করে আলাদা হয়ে গেলে বিপদ। পুলিশ চারদিকে ঘুরছে, তার গোপন ব্যবসার কথা জেনে গেলে আর দেখতে হবে না, সোজা শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেবে। উফফ, এখানে এসে কী ভুলই না সে করেছে। উন্মেষাকে বলল সে, “তুমি কেন বাইরে যাবে? স্টে ইন দ্য রুম, আই অ্যাম ওয়াকিং আউট।” বলে সে আর দেরি করল না, বেরিয়ে গেল। দেখা যাক, অরণ্য কী করছে? তার ঘরের দিকেই পা বাড়াল সে।

এদিকে অঞ্জন বেরিয়ে যেতেই ভিতর থেকে দরজা লক করে দিল সে। অবশ্য সে ভিতর থেকে না খুলে দিলে অঞ্জন ইয়েল লক খুলে বাইরে থেকে এমনিতেও ঢুকতে পারত না। তবুও সাবধানের মার নেই। ফোনটা দেখল সে। মিনিট দশেক আগে ফোনটা এসেছিল। এখন নিশ্চয়ই তাকে পাওয়া যাবে। ভিডিও কল করবে কী? না না, থাক। এখন কে কোথায় ফোন ট্র্যাপ করছে কে জানে? সাধারণ ফোনকেও সন্দেহের চোখে দেখবে। কী যে বিপদের মধ্যে পড়া গেল! নাহ্, ফোন নয়, ম্যাসেজ করবে সে। ফোনের অপর প্রান্তে যে অপেক্ষা করছে তার একটা কথা শোনার জন্য, জানার জন্য, তাকে আর অপেক্ষায় রাখা ঠিক নয়। অতএব ফোন তুলে নিল সে।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content