বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

শাক্য হাতে কাঠের তৈরি বাহারি বোতাম-সহ একখানি লাল কাপড়ের টুকরো নিয়ে ভাবছিল। আগেই সে হাতে গ্লাভস পরে নিয়েছিল। এটা তাদের পুলিশি ট্রেনিং-এর শিক্ষা। পাভেল এগিয়ে এল। “কিছু পেয়েছ বুঝি?”

শাক্য বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট আর তর্জনীর আগায় ধরে বোতামটা দেখাল তাকে। পাভেল বলল, “এর সঙ্গে বাইক বা খুনের কিছু যোগ আছে কি? এটা তো অনেকদিন আগের পুরানো হতে পারে।”
“তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না পাভেল। প্রথম কথা হল, বোতামটা আজ-কালের মধ্যে ছিঁড়ে পড়েছে। সেটা যা বা যারা বাইক রাখতে এসেছিল, তাদের কারুর হতে পারে, কিংবা পুলিশের তদন্ত যখন হচ্ছিল, তখন তাদের মধ্যে মিশে থাকা কৌতূহলী কারও হতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি আমি নাকচ করে দিচ্ছি, কারণ বোতামটি পুরনো হলে, এখানে যা লাল মাটির ওড়াউড়ি, তাতে বোতামটির রং জ্বলে যেত, নিদেনপক্ষে তার খাঁজে খাঁজে ধুলো জমত।

তাছাড়া লাল কাপড়ের টুকরোটা ভালো করে দেখলেই বুঝবে, এর সঙ্গে লেগে থাকা কাপড়ের আঁশগুলি এখনও রেশম রেশম ভাব ছাড়তে পারেননি। এটা বেশ কয়েকদিন আগের হলে সেই ভাবটা থাকত না। দ্বিতীয়ত, যে-মানুষটি বা যারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের মধ্যে একজন আছে, সে খুব শৌখিন। কারণ, শৌখিন না হলে এই বাহারি কাঠের বোতাম সে ব্যবহার করত না। তৃতীয়ত, হয় তার অনেক তাড়া ছিল, বাইক যারা রেখে গিয়েছে, তাদের কেউ হলে তার তাড়া থাকা স্বাভাবিক; নয়তো এখানে কেউ লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল!”
পাভেল বলল, “হয়তো, অপরাধীদের কোনও পার্টনার। কখন বাইক আসে, সেই ব্যাপারটি লুকিয়ে নজরে রাখছিল।”

“হাসালে পাভেল। আসবার আগে সুদীপ্ত কি বলেছিলেন, মনে আছে? বলেছিলেন, এই পুরনো মোকামের জঙ্গল ভৌতিক বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস, ফলে দিনের বেলাতেও এ-দিক ঘেঁষে না কেউ। অথচ তেমন একটা জঙ্গলে একা একজন অপেক্ষা করছিল, কখন রক্তমাখা বাইক নিয়ে এসে হাজির হবে কেউ, এটা তুমি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে কর?”
“একা হতে যাবে কেন? সঙ্গে আর কেউ বা কেউ কেউ থাকতে পারে!” পাভেল মতামত দিল।
“এটা একটু লোক-হাসানো মতামত দেওয়া হয়ে গেল না পাভেল? ধরে নিলাম, এখানে বাইক রেখে যাওয়াটা পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। কিন্তু তা হলে, এখানে দু’ জনই থাকুক কিংবা একজন, তার থাকাটা অর্থহীন হয়ে যায়। তাছাড়া, সামনে মুম্বাই রোড, সেখান দিয়ে অহরহ সাইকেল, রিকশা ইত্যাদি ছুটে চলেছে। সেখানে রোডের ধার ঘেঁষে পুরানা মোকামের জঙ্গলে যদি একের অধিক লোক যদি দাঁড়িয়ে থাকে, তাও পুরানা মোকামের জঙ্গল, তাহলে সকলে একটু কৌতূহলী হয়ে উঠবে না কি? তাহলে তো আর গোপন বলতে কিছুই থাকল না। আর ধরে নিচ্ছি কেন আমরা যে, রক্তমাখা বাইক যারা রাখতে এসেছিল, তাদের মধ্যেই কারুর জামা-কাপড়ের অংশ এই বোতামটা? এটা তো অন্য কারও হতে পারে?”

“অন্য কেউ কেন হতে যাবে? কার গরজ পড়েছে, এখানে এসে এই পুরনো মোকামের জঙ্গলে লুকিয়ে বসে থাকবে? কিসের জন্য? তাছাড়া, বাইক রাখতে যারা এসেছিল, তারা যে এখানে আসবে, সে কি তা জানত? আর যদি ধরে নিই সে জানত না, তাহলে তার পক্ষে এখানে লুকিয়ে থাকা আশ্চর্যজনক নয় কি?”

“সেটাই তো আমাকে ভাবাচ্ছে পাভেল! কে পরে জানলেও চলবে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটাই বেশি জরুরি। তাছাড়া স্থানীয় হলে সে হয়তো সাহস পেত না, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, সে বাইরের মানুষ। কিন্তু তাহলেও সেই একই প্রশ্নের কাছে ঘুরে ফিরে আসতে হয়, কেন?” বলে চিন্তিত মুখে শাক্য এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর জীবনকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল।
জীবন অল্প কিছু দূরে দাঁড়িয়েছিল। সম্ভবত, লালবাজার থেকে আসা বড় সাহেবদের কোন হুকুমের জন্য সে অপেক্ষা করছিল। শাক্য ডাকতেই সে দৌড়ে এল।

শাক্য তাকে বলল, “আচ্ছা জীবন, আজ সকালে যখন এস.আই সাহেব বাইকের সন্ধানে আসেন, তখন তুমি সেই টিমে ছিলে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। ছিলাম।”

“তা তোমরা কী করলে? বাইক দেখে সেখানেই ঘোরাঘুরি করলে না কি জঙ্গলের আরও ভিতরে ঢুকেছিলে?”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫৯: বুধনের কথা

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২৫: ধৃতিমানের ওপর কি শ্রেয়া নজর রাখছিল? নাকি অন্য কেউ?

“বাইকটা তো প্রায় সামনেই রাখা ছিল স্যার। এসআই সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওটার পরীক্ষা করেছেন। আশেপাশের মাটিও পরীক্ষা করেছেন, যদি পায়ের ছাপ পাওয়া যায় কোনও। কিন্তু আমাদের এ রুক্ষ কাঁকূড়ে মাটি। কারও কোনও চিহ্ন বুকে ধরে রাখতে চায় না!”

শুনে চমৎকৃত না হয়ে পারল না শাক্য। জীবন নামের লোকটি বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে তো! শাক্য তাকে বলল, “তাহলে তুমি বলছ আজ সকালে সুদীপ্তবাবু জঙ্গলের ভিতরের দিকে ঢোকেননি?”

জীবন আবারও বলল, “আজ্ঞে স্যার। ওই জঙ্গল খুব ভয়ানক আছে, ওর ভিতরে ঢোকা তো দূর, ধারেকাছেও কেউ ঘেঁষে না!”

“কিন্তু সে-কথা তো সত্যি বলে মনে হচ্ছে না জীবন। এই দেখ, এ-জঙ্গলে যে লোক আসে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ!” বলে শাক্য আঙুল দিয়ে দেখাল। জঙ্গলের একটু আলো-আঁধারি জায়গায় বেশ কিছু দামি সিগারেটের ফিলটার টিপস পড়ে আছে। জীবন কোন কথা বলল না। জিভ দিয়ে উপরের ঠোঁট চাটল কেবল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

শাক্য এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। সামনেই একসার শাল গাছ, নিচে কাঁটাঝোপ, দু-একটা বিড়িপাতা আর কুসুমগাছও রয়েছে তাদের ভিড়ে। পাভেলের একটু অস্বস্তি হচ্ছে। এখানে অনেকদিন আগে এসে ছানবিন করার সুবাদে সে জানে, এই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে হরেক কিসিমের ভয়ের গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তার গা ছমছম করে উঠল। যদিও দিনের আলো চারদিক ভাসিয়ে দিচ্ছে, তবুও জঙ্গলের ভিতর সেই আলোর খুব কমই এসে পৌঁছেছে বলে নিচের দিকটা প্রায়ান্ধকার। তার উপর কাঁটা ঝোপ থাকার ফলে এগুলোও মুশকিল। শাক্য কিন্তু দিব্যি এগিয়ে যাচ্ছিল। কোনও ভয়ডর না করেই। একটা কাঁটাঝোপ পার হয়ে সে একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। তারপর নিচু হয়ে কী দেখতে লাগল। পাভেল বুঝতে পারল না সে আর এগোবে কি না। জীবনও তার পাশেই দাঁড়িয়ে একই কথা ভাবছিল। এমন সময় শাক্য সোজা হয়ে তাদের দিকে ফিরে বলল, “একটু এদিকে এসো। ভয় পেয়ো না! এসে দেখে যাও!”

শুনে পাভেল আর জীবন দুজনেই এগিয়ে গেল। শাক্য যেমন কাঁটাঝোপ ডিঙিয়ে গিয়েছিল, সেভাবে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, শাক্য যা দেখাতে চাইছে। জঙ্গলের মধ্যে দিব্যি একটা পায়ে চলা পথের রেখা জঙ্গলের আরো গভীরে চলে গিয়েছে। আর সে-পথে যে নিয়মিত লোক চলাচল করে তা স্পষ্ট। জায়গাটায় কোন ঘাস ইত্যাদিও গজায়নি তেমন সে কারণেই। আর সেই পথের উপরেও এদিক-ওদিক অর্ধদগ্ধ ফিলটার টিপস, বিড়ির টুকরো ইত্যাদি পড়ে। এর একটাই অর্থ হয়, এ-পথে নানা লোক যাতায়াত করে। কিন্তু কেন করে, সেটা বুঝতে পারল না সে।

শাক্য বলল, “জীবন, এইখানে যা আমরা দেখলাম, তা তুমি এখনই কাউকে বলো না। এই যে পথ, যা জঙ্গলের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালেও সহজে চোখে পড়বে না, আর তা যে নিয়মিত ব্যবহার হয়—এ সব কথা এখন গোপনই থাক্!”

জীবন বলল, “আজ্ঞে স্যার, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।”

পাভেল বলল, “শাক্য, আমি বুঝতে পারছি না, যদি এখানে কিছু মানুষের আনাগোনা চলেই, তাতে অপরাধের কী আছে? জঙ্গলে গোপনে কাঠ কাটতে স্থানীয়দের ঢোকা অসম্ভব কিছু নয়। সেক্ষেত্রে পায়ে চলা পথ তৈরি হওয়াও বিচিত্র নয়, তাই না কি?”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪০: মা সারদার নিজবাটি

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৮: মোহিতকুমারী এক মহিলা আত্মজীবনীকার

“একেবারেই নয়। কিন্তু তাহলে সামনের দিকেও পায়ে চলা পথের দেখা মিলত। ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে পথটা তৈরি হয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ত। কিন্তু তা হয়নি। অতএব, মনে করা যেতে পারে যে, কেউ বা কারা চায়নি যে, এই পথ অন্য কারুর চোখে পড়ুক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাইকটা নিয়ে। এমনভাবে বাইকটা রাখা ছিল যে, খুব সহজেই তা চোখে পড়বে কারও না কারও। পুলিশেরও পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে বাইকটা এভাবে তারা কখনোই এখানে রাখবে না, যারা এই জঙ্গলে ভূত-প্রেত-অলৌকিকের ভয় তুচ্ছ করে নিজেদের প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করে। এই পথটা গোপন রাখতে চেয়েছে তাঁরা কোন এক অজ্ঞাত কারণে, ফলে সেখানে বাইক রেখে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজেদের গোপন ঘাঁটি চিনিয়ে দেবে এমন বোকা এ-জগতে কেউ নেই। তাছাড়া, বাইকটা এমনভাবে রাখা হয়েছে, যাতে সকলের চোখে পড়ে। অথচ যারা জঙ্গলের ভিতর যাওয়া-আসা করে, তারা সহজেই বাইকটা ভিতরে কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারত। কিন্তু তা করেনি। এর অর্থ একটাই যে, যারা বাইকটা রেখেছে আর যারা জঙ্গলের ভিতর যাওয়া-আসা করে, তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন লোক!”

“এটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হচ্ছে!” পাভেল বলল।

“কিন্তু কারা পাভেল এবং কেন? তাড়াতাড়ি আমাদের জানতেই হবে!”

“হ্যাঁ।”

শাক্যকে জঙ্গলের ভিতরের দিকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে বলল পাভেল, “কিন্তু তুমি কি জঙ্গলের আরও ভিতরে ঢোকার তাল করছ না কি?”

“ইচ্ছে করছে। কিন্তু হঠকারিতা করে তোমার এবং সুদীপ্তবাবুদের বিপদ ডেকে আনতে মন চাইছে না। কিন্তু কিছু একটা তো করতেই হবে। পাভেল, আজ রাতে তোমার আর আমার ঘুম নট্ হয়ে গেল! তৈরি থেকো।”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content