বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

মালি রঘুপদ সিংয়ের বয়স হয়েছে। তার পূর্বপুরুষেরা কোনও এক মোঘল সেনাপতির অধীনে সৈন্যবাহিনীতে কাজ করত। এখানে এসে যুদ্ধ শেষ হলেও আর ফিরে যায়নি। সেই থেকে পাঁচ-ছশো বছর ধরে তারা বাংলায় থাকতে থাকতে পুরোদস্তুর বাঙালি বনে গিয়েছে। আদতে তারা রাজস্থানের লোক। রঘুপদ বেশ জাঁক করেই কথাটা বলল। বংশপরম্পরায় এই কাহিনি সে তার নানির কাছে, নানি তার নানির কাছে—এইভাবে না কি শুনে আসছে। সে-ও কথাটা তার ছেলেকে বলেছে, ছেলে বলবে তার ছেলেকে। নাই বা তারা রাজস্থানে থাকল, কিন্তু যার যার শেকড় তাকে তা জানতে হয়!

শাক্যর ভারি ভালো লাগল। কোথায় রাজস্থান আর কোথায় পিশাচপাহাড় নামে অখ্যাত একটা গঞ্জ, সাম্প্রতিক কেল কালাদেও নামক অজ্ঞাতপরিচয় এক আততায়ীর হাতযশে যা লোকের কাছে বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে, আর হ্যাঁ, অবশ্যই কিছু ব্লগারদের কৃপায়—সেখানে বাস করেও রঘুপদ নিজের রাজস্থানী শেকড়ের কথা ভোলেনি। বংশপরম্পরায় যাতে না-ভোলে সেই ভাবে ছেলেকেও শিখিয়ে দিয়েছে। যেখানেই সুযোগ পায়, নিজের পে-ডিগ্রির কথা এ ভাবে বলে আসলে তারা জানাতে চায় যে, তারা এক মহান জাতির উত্তরাধিকার। আসলে যতই বাঙালি হয়ে যাওয়ার কথা মুখে বলুক না কেন, তারা যে বাঙালিদের থাকে পৃথক সেই কথাই ঠারে ঠারে জানাতে চায়। নিজের জাতিসত্তা নিয়ে এই গর্ব মন্দ জিনিস নয়, এর উগ্রতাই মারাত্মক।
তবে রঘুপদ কাজের কথা তেমন কিছু বলল না। মালিক হিসেবে কাপাডিয়ার গুণগান করল। সে মালি বলে তাকে অবজ্ঞা করেন না। আসলে সবাই রাজপুতদের সম্মান করে। মালিকও করেন। সে কোন ছোটবেলায় তার বাপ-পরদাদার কাছ থেকে এই বাগানের কাজ শিখেছে। তার ঠাকুর্দার বাবা কলকাতায় কোনও এক পার্কে বাগানের দেখভাল করত। পরে এখানে চলে আসে। বাবাও কলকাতাতেই কাজ করেছে। কিন্তু তার এই জায়গা ছেড়ে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, এই জন্য সে টুকটাক এটা-ওটা করত। মাঝে কিছুকাল হাজারিবাগে কোনও এক রইস আদমির মোকামের বাগানের দায়িত্বে ছিল। সেখানেই মালিক কাপাডিয়া সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয়।

মালিক এখানে রিসর্ট বানালে সে নিজেই গন্ধে গন্ধে এসে হাজির হয়, কাপাডিয়া সাহেব তাকে আর ঠেলতে পারেননি। বাগানের দায়িত্ব দিয়ে বলেছিলেন, “এক সাল দিচ্ছি তোমায় রঘু, এর মধ্যেই বাগান যেন একেবারে আলো হয়ে ওঠে!” রঘু সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল, এক বছরের মধ্যেই সে রুক্ষ মাটিতে গোলাপ, দালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা থেকে জবা, টগর, জুঁই, বেল, গন্ধরাজ ইত্যাদির একেবারে বন্যা বইয়ে দিয়েছে। গরমকালটা একটু অসুবিধা, তবে তখনও সূর্যমুখীর ঝাড় গোটা রিসর্টের বাগানে যেন আগুন বইয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫৪: একে একে

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য

শাক্য জিজ্ঞাসা করেছিল, “রিসর্টে যারা আসেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয় না?”
“নাহ্‌ স্যার, আমি সাধারণ মালি, আমার সঙ্গে বাবুরা কথা কইবেন কেন? কখনও কখনও কেউ হয়তো এমনি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোণ গাছের বা ফুলের নাম জিজ্ঞাসা করল, প্রশংসা করল বাগানের, কেউ কেউ আমি মালি কি না সে কথাও জিজ্ঞাসা করে, ব্যস্‌ এইটুকুই!”
“তাহলে এখানে যে অনিলবাবু খুন হয়েছেন কাল শেষ রাতে তাঁকে তুমি চেনো না?”
“না স্যার। দেখেছি কি না তা-ও বলতে পারব না। লাশ তো দেখিনি। তবে এ বারের যে পার্টি এসেছিল, তাদের মধ্যে এক জেনানা আছেন, তিনি ছাড়া আর কাউকে আমি চিনি না। তাও চিনি বলতে, কাল সকালে যখন বাগানে কাজ করছিলাম, তখন তাঁরা কোথাও যাচ্ছিলেন। গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। কলকাতা থেকে আসা গাড়ি। এখানের সব গাড়ি আর তাদের মালিককে আমি চিনি তো, তারাও আমাকে চেনে জানেন! রঘুপদদা বললে সক্কলে চিনে যাবে। বুঝলেন কি না! ওইটুকুই যা পাওয়া!” বলে এক চোট আত্মপ্রসাদের হাসি হাসল রঘুপদ।

মানুষটি ভারি সরল। ভালো লাগল শাক্যর। আজকাল মানুষ রাতারাতি অনেক মানুষের কাছে পরিচিতি পাওয়ার লোভে কত কিছুই না করে। সেখানে সামান্য দু’ একজন লোকাল মানুষ হরিপদকে চেনে—এতেই সে ধন্য। এত অল্পে সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষাও জীবনের এক বড় শিক্ষা!
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৫: মা সারদার ভ্রাতৃবিয়োগ

রঘুপদ হাসি থামিয়ে বলল, “সেই জেনানা আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, বসন্তকাল চলে গেলে কী গাছ লাগাবো? আমি দূরের বেড দেখিয়ে বলেছিলাম, লাগাবো কী ম্যাডাম, আগেই লাগানো হয়ে গিয়েছে। ওই দেখুন সূর্যমুখী, জিনিয়া আর পিটুনিয়ার বেড। পিটুনিয়া অবশ্য এখন থেকেই বাগান আলো করে আছে, তবে গরমকালের পিটুনিয়া আলাদা। তা সে-কথা শুনে সেই জেনানা খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, তোমার হাতে জাদু আছে। তাই বার বার তুমি বাগানটাকে আলো করে রাখো। আমি শুনে একেবারে ধন্য হয়ে গেলাম। আমার ছেলে আমাকে বলে, কেউ প্রশংসা করলে তাকে থ্যাংক ইউ বলতে হয়। আমিও সেটাই বললাম। তাতে জেনানা আমাকে “ওয়েলাম” না কী বললেন, আমি একটা নমস্কার করে ফেললাম।”
“বাহ্‌, তাহলে তো ভালোই !”
“আজ্ঞে স্যার! জেনানাটি ভারি ভালো মানুষ। এত সুন্দর করে কথা বলছিলেন, যেন আমি তাঁর কতকালের চেনা। আমারও যেন মনে হল, তাঁকে চিনি। তাঁর ওই গলা যেন আগে শুনেছি। এতটাই আপন করে কথা বলছিলেন!”
“আচ্ছা রঘুপদ, সুবল তো এখানে কাজ করত, তার সঙ্গে কেমন পরিচয় ছিল তোমার?”
“সুবল ভারি ভালো লোক ছিল স্যার। মিথ্যে বলব না, বাজারে মাল করতে গেলেই আমার জন্য এক বান্ডিল বিড়ি আনত, কখনও কখনও সিগারেটও খাওয়াত। বলত, আমরা সবাই কাজে ফাঁকি দিলেও দিতে পারি রঘুদা, তোমার তা হওয়ার যো নেই। তুমি ফাঁকি দিলে রিসর্টের বাগান অন্ধকার হয়ে যাবে। রিসর্টের সুন্দর বলতে আর কিছুই থাকবে না। ভাগ্যিস তোমার বাগান আছে, নাহলে এই রিসর্ট ন্যাড়া ন্যাড়া লাগত!”
“তাহলে সুবল তোমার ভক্ত ছিল বল?”
“তা বলতে পারেন। তবে একটা বদ অভ্যাস ছিল। মাঝে মাঝে বাবুদের ঘরে উঁকিঝুঁকি মারত। বাগানে এসে এদিক ওদিক দিয়ে দেখত। আমি কত বকাঝকা করেছি, এ সব করতে নেই বলে, তা বলত, সব এর বউ তার প্রেমিকাকে এনে ফূর্তি করছে, দেখব না! আমি বলতাম, মালিক জানতে পারলে সর্বনাশ হবে, তা বলত, হবে না। মালিককে জব্দ করার চাবিকাঠি না কি তার কাছে আছে। সুবল না হলে মালিকের চলে না তো, এই তিন মাস ধরে সে এসেছে, দেখছি সেই প্রথম দিন থেকে। মালিক আমাদের সুবল বলতে অজ্ঞান। খুব কাজের ছেলে ছিল সত্যি কথা! একবার বললে আর দেখতে হবে না, সে কাজ সে করবেই করবে। আমার ছেলেটা স্যার অত চৌখস নয়। কবে যে লায়েক হয়ে উঠবে। বিয়েটাও ওই জন্য দিতে পারছি না। এই রিসর্টেই যদি একটা হিল্লে হয়, সেজন্য এখানে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছি মালিককে ধরে। সুবলই বুদ্ধিটা দিয়েছিল যদিও। খুব খারাপ লাগছে। কালাদেও যে কেন তাকে ওইভাবে মারলেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমার তো মনে হয়, ভোরবেলা বাইরে পেচ্ছাপ করতে উঠেছিল, কালাদেও হয়তো যাচ্ছিলেন সেদিক দিয়ে, সামনাসামনি পড়ে গেছে, অমনি রেগে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। কালাদেওকে দেখতে নেই। কালাদেও সামনে পড়ে গেলে চোখ বন্ধ করে মাটিতে শুয়ে পড়তে হয়। আমরা লোকাল লোক জানি এসব। সুবল তো বাইরে থেকে এসেছে। তাও মাত্তর তিন মাস। সে কেমন করে জানবে ? ইস্‌, আমি যদি তাকে নিয়মটা শিখিয়ে দিতুম !” বলে রঘুপদ মাথা নাড়তে লাগল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৯: শ্রদ্ধাঞ্জলি— প্রযোজক-গায়িকা অসীমা মুখোপাধ্যায়, অভিনেত্রী অঞ্জনা ভৌমিক ও গীতিকার মিল্টু ঘোষ

তার কাছে আর কিছু পেল না শাক্য। সুদীপ্ত এখন ফিরে আসেনি। সে যে এবারে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সময় নিয়ে ছানবিন করবে—সেটা আন্দাজ করেছিল শাক্য। করুক। এই কেসটা এতটাই জটিল যে সূত্র যা পাওয়া যায়, যত ক্ষুদ্রই হোক জোগাড় করা দরকার। রঘুপদকে তার ছেলেকে পাঠিয়ে দিতে বলতেই সে হাঁউমাঁউ করে কান্না জুড়ে দিল, “আমার ছেলে ছোট স্যার। সে কিছু জানে না। ক’দিন আগেও পুলিশের ভয় দেখিয়ে ওর মা ওকে দুধ খাওয়াত।”

শাক্য মনে মনে হাসল। আজকাল দুগ্ধপোষ্য ছেলেপিলেরাও যা সব কাণ্ডকারবার করছে, তাতে চোখ কপালে উঠে যায়। আর এ-তো একুশ-বাইশের ছেলে! মুখে সে বলল, “তোমার চিন্তা নেই রঘু, আমি এমনি দু’একটা কথা জিজ্ঞাসা করেই ছেড়ে দেব। ও বাচ্চা ছেলে, ও আর বেশি কী জানে? পাঠিয়ে দাও।”

রঘুপদর ছেলের নাম কংসারি। এখনকার দিনে মোটেও আধুনিক নাম নয়। তবে ছেলেটা যথেষ্ট সপ্রতিভ। তার কাছে বেশি কিছু জানা গেল না যদিও। সে টুকটাক ফাইফরমাশ খাটে। সুবলদা ব্যস্ত থাকলে তাকে রুমে চা বা জলখাবার ইত্যাদি পৌঁছে দেবার জন্য বলা হত—এইটুকুই। সে মাসখানেক হল জয়েন করেছে। খুব বেশি দেবে না বলেছে মালিক। আগে কাজ শিখলে তারপর চাকরি পাকা করবেন। এবারের পার্টির সঙ্গে সে আজ সকালের আগে কথা বলেনি। আজ সকালেই কাপাডিয়া তাকে পাঠিয়েছিলেন রুমে রুমে ঘটনার কথা জানিয়ে সবাইকে পুলিশ নীচে ডাকছে সেই কথা বলতে। এইটুকুই। আর কিছু সে জানে না, সে দেখেনি।

শাক্যর মনে হল, ছেলেটি কিছু একটা গোপন করছে কিংবা বলতে ভয়ও পেতে পারে, সম্ভবত রঘুই তাকে ভয় দেখিয়েছে। পরে সেই না বলা তথ্যটি জানতে হবে জেনে তাকে ছেড়ে দিল, এমন সময় দরজা দিয়ে মুখখানা বাড়িয়ে অজয়বাবু বললেন, “আসতে পারি?”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content