শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

পূষণ বলল, “আমি কিন্তু অনিল বা সুবল কাউকেই চিনি না, আগেই বলে দিলাম। তবে চেনা-অচেনা যে-ই হোক না কেন, এমন ভয়াবহ মৃত্যু সত্যিই অনভিপ্রেত!” কঠিন একটা বাংলা শব্দ ব্যবহার করে সে একটু আত্মপ্রসাদের হাসিহাসল। আড়চোখে তাকাল লালবাজারের গোয়েন্দা-অফিসারের দিকে। কিন্তু অফিসারটির মুখে কোনও প্রতিক্রিয়ার চিহ্নমাত্র খুঁজে পেল না। বেরসিক অফিসার, মনে মনে বলল সে।
“পূষণ, আপনি এই পিশাচ পাহাড় ডেস্টিনেশনের কথা জেনেছিলেন কোথা থেকে?”
সুদীপ্ত মনে মনে বিরক্ত হল। হতে পারেন লালবাজার থেকে আসা গোয়েন্দা, কিন্তু এই জাতীয় প্রশ্ন সকলকে করার কী মানে, সে বুঝতে পারছিল না। এ তো অযথা সময় নষ্ট! যেখান থেকেই জেনে থাকুক, বিভিন্ন জায়গা থেকে একদল মানুষ একটা ট্যুরিস্ট স্পটে বেড়াতে আসতেই পারে। ওই গ্রুপের কয়েকজনের কথা বাদ দিলে পূষণ-রিমিতা-মাস দুয়েক আগে আসা ডক্যুফিচার বানানো ভদ্রলোক—এরা কেউ কাউকে চেনেও না। তাহলে এ-জাতীয় প্রশ্ন করার কী অর্থ? ভদ্রলোক কি একেবারেই আপডেটেড নয়? জানেন না, আজকাল সকলেই ওইসব ব্লগ, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া স্টোরি দেখে ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশন ঠিক করে? কিন্তু মনের বিরক্তি মনেই রাখল সে। এখন এই ব্যাপারে কিছু বলা মানে অযথা তিক্ততার জন্ম দেওয়া।
পূষণ কিন্তু শাক্যর প্রশ্নে অবাক হল না। বলল, “আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। সে আবার কোন এক ট্র্যাভেল ব্লগ বা ওইরকম কিছুতে এই স্পটটার সম্পর্কে জেনেছিল। এখন তো এইরকম করেই সবাই ঘুরতে যায়, জানেনই তো!”
“আপনি তাহলে নিশ্চিত যে, আপনার বন্ধু কোন ব্লগ থেকে এই স্পটটার সম্পর্কে জেনেছিল? আচ্ছা আপনার সেই বন্ধু কি এখানে এসেছিল?”
“একদম, এসেছিল মানে? এক সপ্তাহ কাটিয়ে গিয়েছিল বউকে নিয়ে। ওদের বিয়ে হয়েছে জাস্ট এক বছর। কিন্তু এক্সটেন্ডেড হানিমুন চলছে তো চলছেই !” বলে হাসল সে।
শাক্য হাসল মৃদু। এই সমস্ত সময়ে লোক বুঝে অন্তরঙ্গতার ভান করতে হয়। এতে ফল ভালো মেলে। পূষণের গার্লফ্রেণ্ড রিমিতা আবার একেজি-র ভাগ্নী। সে-ই মামাকে ফোন করেছিল। একেজি অবশ্য স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে দিয়েছেন, “বাজিয়ে দেখবে। যদি দেখ, ওরাই অপরাধী, গ্রেফতার করতে দ্বিধা করবে না!”
শাক্য জানে, ওরা সম্ভবত ভিকটিমদের কাউকেই চেনে না। কারণ, সবে মাত্র কাল মাঝরাতে তারা এসেছে। তা-ও আবার ওই রকম একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর। সে জিজ্ঞাসা করল তা-ও, “যারা মারা গিয়েছেন তাদের কাউকে চেনেন?”
“চেনা তো দূরের কথা। দেখার সুযোগটাই তো হয় নি। কালই সবে এসেছি, তাও মাঝরাতে। এই এঁদের দয়া হল বলে!” বলে সুদীপ্তর দিকে ইঙ্গিত করল। সুদীপ্তর মুখ কালো হয়ে গেল।
শাক্য বলল, “দেখুন, কোন ইন্সিডেন্ট ঘটলে আমাদের সকলকেই সন্দেহ করতে হয়। এটা আমাদের তদন্তের রুলস্‌-এর মধ্যে পড়ে। এরে আহত হলেও কিছু করার নেই। এই যেমন, এখন ধরুন, যারা দুজন খুন হয়েছে, তাদের কাউকেই আপনি চেনা তো দূরের কথা দেখেননি পর্যন্ত, তাও আমরা প্রাইমারি সাসপেক্টের তালিকায় আপনাদের দুজনকে রেখেছি। আপনি এবং আপনার বন্ধু রিমিতা!”
“মানে?” পূষণের মুখ হাঁ হয়ে গেল।
“হ্যাঁ। ধরুন, আপনারা এলেন মাঝরাতে, আর তারপরেই কোন এক সময়ে দু’দুজন ব্রুটালি মার্ডার হল—তাহলে একে নিছক কো-ইনসিডেন্ট বলব? না কি আপনাদের হাত আছে ভাবব? অতএব আপনারা দু’ জনেও কিন্তু প্রাইমারি সাসপেক্ট লিস্টে ঢুকে পড়েছেন।”
পূষণ খাবি খেতে খেতে বলল, “রিমিতার মামা কিন্তু…”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪৯: সখী, আঁধারে একলা ঘরে

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-১৪: মৃত্যুর রাতে নিখিল কি শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন?

তাকে থামিয়ে দিয়ে শাক্য বলল, “আপনার বন্ধুর মামা আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, আপনাদেরকেও সাসপেক্ট তালিকায় রেখে তদন্ত করতে। বন্ধুর মামা বড় পুলিশ অফিসার হলেই যে বন্ধু অপরাধী হবে না, এটা কেমন কথা হল ? অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ অফিসারের ছেলে মেয়েরা বড়-ছোট অপরাধ করে বসে, এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু বিরল নয়!”
পূষণ ক্যাবলার মতো হেসে বলল, “কী যে বলেন? আমি করব খুন? রিমিতা কড়া চোখে তাকালেই আমার হাত কাঁপে। আর আমি কি না খুন করব? ওহ মাই গড! এই সেঞ্চুরীর সেরা জোক!”
শাক্য এবার বাস্তবিক হেসে ফেলল। বলল, “আচ্ছা, এই প্রসঙ্গ থাক। কালকের ঘটনা নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করি?”
“করুন। আমি বলে বলে ক্লান্ত কাল থেকে। তবে আপনি জিজ্ঞাসা করলে আবারো বলব।”
“আমার বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই। আপনার কালকের বয়ান আমি থানার ফাইল থেকে পড়ে ফেলেছি। আমার কয়েকটা ব্যাপারে আলাদা করে জানার ছিল। সেইগুলিই জিজ্ঞাসা করবো।”
“করুন।”
“আপনারা কারা কারা কালাদেওকে রাস্তার উপর মৃতদেহের উপর চড়াও হতে দেখেছেন?”
“কালাদেওকে তো দেখিনি! আমার তো মনে হয়, মঙ্গল মাহাতো ছাড়া আর কেউ সেটা দেখেছে!”
“মঙ্গল মাহাতো?”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা

মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড় নয়, আমাদের এই বাংলাতেই রয়েছেন ডোকরা শিল্পীরা

সুদীপ্ত বলল, “ওই বাসের হেল্পার। সেই প্রথম মৃতদেহের উপর অদ্ভুত কোন প্রাণিকে উপুড় হয়ে রক্ত বা কিছু খেতে দেখে!”
“ও হ্যাঁ, রিপোর্টে এই রকম কিছু লেখা ছিল বটে! আচ্ছা, কেবল মঙ্গল মাহাতো কেন? সবার আগে তো দেখার কথা বাস যে চালাচ্ছিল সেই ড্রাইভারের? তার বয়ান তো দেখলাম না!’
সুদীপ্তের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কথাটা তার মাথায় আসেনি, কিংবা ভুলে গিয়েছিল। সত্যিই তো, বাস ড্রাইভারের তো সবার আগে দেখার কথা!
পূষণ বলল, “আমার কথাটা খেয়াল হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সবাই আমরা যখন এই নিয়ে মঙ্গল মাহাতোকে জিজ্ঞাসা করছি, তখন ড্রাইভার ঠায় বাসের মধ্যে বসে ছিল, একবারের জন্যও নামেনি !”
“স্ট্রেঞ্জ!” শাক্য সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি অবিলম্বে ড্রাইভারকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসা করুন যে সে কী দেখেছে। সে কি দেখেছে—এ-ভাবে জিজ্ঞাসা করবেন না। তাতে অন্য উত্তর আসতে পারে। আমার ইনট্যুইশন বলছে, তার বয়ান এই কেসে গুরুত্বপূর্ণ!”
সুদীপ্ত বলল, “আচ্ছা স্যার, আমি এক্ষুনি ফোন করে ওসি স্যারকে বলছি তাকে থানায় ডাকতে। তবে সে বাস নিয়ে বেরিয়ে গেলে রাত্রের আগে তার বয়ান জানা যাবে না!”
“ফোন নাম্বার নিয়ে তাকে ফোন করুন। ফোনে জেনে নিন!”
“আচ্ছা স্যার, আমি দেখছি!” বলে সুদীপ্ত একটু উঠে গেল।
“পূষণ, আপনারা দুজনে নেমেছিলেন ঘটনাটা দেখতে?”
“আমি নেমেছিলাম। রিমিতা নামেনি। সে এসব ব্যাপারে ভয় পায়! তা ছাড়া সে বিষয়টা তখন তেমন বুঝতে পারেনি। যখন পেরেছিল, ততক্ষণে পুলিশ এসে গিয়েছে এবং তারা জায়গাটা ঘিরে ফেলেছে। তখন রিমিতার পক্ষে দেখার উপায় ছিল না। সে দেখতেও চায়নি। এই সব ব্যাপার দেখলে তার ধাক্কা সামলানো কঠিন হতো!”
“আচ্ছা। ঘটনাস্থলে কেবল মুণ্ডহীন লাশটাই পড়ে ছিল, আর কিছু ছিল না?”
“নাহ! পুলিশ যদিও বলছিল, বাইক বা সেই রকম কোন কিছু থেকে আচমকা পড়ে গিয়ে মাথা থেঁতলে যেতে পারে!”
“সেক্ষেত্রে বাইকটাও কাছেই পড়ে থাকার কথা। কালাদেও নিশ্চয়ই বাইকে করে পালিয়ে যায়নি?”
পূষণ হাসল। তার হাসিটাই জবাব।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-২৮: কাদম্বরী বিহারীলালকে দিয়েছিলেন ‘সাধের আসন’

শাক্য বলল, “একটা কথা ভেবে বলুন তো, মঙ্গল মাহাতো কালদেওর কথা বলেছিল, না কি আর কেউ?”
পূষণ বলল, “ঠিক মনে নেই, তবে আমার মনে হয়, মঙ্গল কালাদেওর কথা বলেছিল। তবে আর একজন বলেছিল, তাকে মনে আছে। বেশ হামবড়াই ভাব লোকটার, ঈষ্বরীপ্রসাদ। এখানে কোন লোকাল গ্রামদেবতার মন্দির আছে, তারই পুরুতের ছেলে। নিজেও পুরুতগিরি করে। নিজের পরিচয় দিচ্ছিল সে বেশ জাঁক করে। অনেকেই দেখলাম তাকে চেনে। ভক্তি-শ্রদ্ধা করে কি না জানি না!”
“পুলিশ কী তাদের সঙ্গে কথা বলেছিল ?”
“হয়তো ! আমার জানা নেই!”
“কাল মাঝরাতে ফেরার পর আপনারা সারাক্ষণ রুমেই ছিলেন ?”
“যা শীত এখানে, কোথায় আর যাবো। তবে ভোরে উঠে দুজনে কিছু ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত ছিলাম, মিথ্যে বলব না!” পূষণ দাঁত বার করে নির্লজ্জের মতো হাসল।
শাক্য বলল, “কোনও চিৎকার বা আনকমন আওয়াজ শুনেছিলেন কি?”
“নিজেদের আওয়াজ ছাড়া আর কোন কিছুর দিকে মন ছিল না। তাও শুনলে বলতাম!”
“আচ্ছা। পূষণ, এমনিতে আপনার কোন ভয় নেই, কিন্তু বলা তো যায় না, কখন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে উঠে আসে। তবে একেজির ভাগ্নীকে কিন্তু বেশি জ্বালাবেন না। গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট পিছনে পড়ে যাবে!’ হাসতে হাসতে বলল শাক্য।
“তা আর জানি না ! এখন পালাতে চাইলেও পুলিশি কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায় ! কপাল ! কথায় আছে, ভাগ্যবানের বউ মরে, কিন্তু গার্লফ্রেন্ড…!” কপট ক্ষোভে বলল পূষণ।
“আপনি কি চান, আপনার গার্লফ্রেন্ড মারা যাক?”
জিভ কেটে বলল পূষণ, “আরে কী সব বলছেন? আমি জাস্ট জোক করলাম একটা!”
“আগলি জোক! আর করবেন না! যান, রিমিতাকে পাঠিয়ে দিন!” গম্ভীর গলায় বলল শাক্য।
সুদীপ্ত এসে দাঁড়াল। বলল, “ফোন করলাম স্যার! ড্রাইভারকে। কথা হল!”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content