বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

ঘোমটা (ক্রমশ)

যাবার সময় শ্রেয়া নিয়মমাফিক বলে গেল ছেলে বা বউমা যেন বাড়িতেই থাকে, যতদিন পর্যন্ত না তদন্ত শেষ হচ্ছে তারা যেন বাড়ি ছেড়ে কোথাও না যায়। খুব জরুরি কোনও কাজে যেতে গেলেও থানায় জানিয়ে যেতে হবে। লোকাল থানার অফিসার হিসেবে বিপুলবাবু সারাক্ষণই ছিলেন তবে বাড়ির ভিতরে দোতলায় আসেননি। নিচে চায়ের দোকানে বসে চা আর সিগারেট ধ্বংস করেছেন। কাজের লোক মলিনা ঘটনার দিন রাতে বাড়িতে সুষমাদেবীর সঙ্গে একাই ছিল। দালানে শুয়েছিল। সার্কামস্টান্সিয়াল এভিডেন্স তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু সুষমাদেবীকে খুন করার কোনও জোরালো মোটিফ নেই মলিনার।

ফরেনসিক টিম ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে ফ্রিজে রাখা খাবারদাবারের নমুনা আর গ্লুকোমিটারটাও নিয়ে গেল। ভৈরব দত্তকে নিয়ে শ্রেয়া বাসু চলে গেলেন। শ্রেয়া যাবার আগে টিস্যু পেপারে মোড়া খাটের তলায় পাওয়া সেই টেস্ট স্ট্রিপ দুটো ধৃতিমান তাঁকে দিয়ে দিল। শ্রেয়া অবাক। ধৃতিমান হাসল।

বিপুল পাল উল্টোদিকে উল্টোডাঙ্গা থানায় ফিরবেন। আরিফ রোড থেকে করবাগান দিয়েই মেন রোডে উঠবেন। তাই হয়তো ধৃতিমানের দিকে একবার তাকিয়ে একটা ভ্রূ-ভঙ্গি করলেন। ভাবখানা ‘যেতে চান নাকি?” ধৃতিমান উত্তরটা ইশারাতেই দিল। ঠোঁট ফাঁক করে একটা অল্প দাঁত বের করা হাসি সঙ্গে মাথার না-সূচক আন্দোলন বোঝালো “না না ঠিক আছে”।
কালো ধোঁয়া বের করে উষ্মা প্রকাশ করে চলে গেল বিপুল পালের জিপগাড়ি। পুলিশের গাড়ির কি পলিউশন সার্টিফিকেট লাগে?
আরও পড়ুন:

হ্যালো বাবু! পর্ব-৩: সুষমা দেবীর ঘরের দুটো জানালার উপরের পাল্লা খোলা ছিল

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২২: সুন্দরবনে গোয়াল পুজো আর ‘ধা রে মশা ধা’

বাড়ির দিকে ফেরবার আগে হঠাৎ কি মনে হতে বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারে ইস্ত্রিওয়ালার ঠেলাগাড়িটার কাছে গিয়ে দোতলায় সুষমা করের ঘরের দিকে তাকালো। সে ঘরের জানলা এখন বন্ধ।

এটা মনে হতেই পারে যে কাকাতুয়া তো কথা বলবেই। খামোকা ‘কথাবলা’ বিশেষণটা বুবুর আগে জোড়ার কারণ কী? কারণ আছে। বুবু ‘হ্যালো’ বা ‘গুড মর্ণিং’ বলেই ক্ষান্ত হয় না। সে অনর্গল কথা বলে। হ্যাঁ তবে একই কথা দু’ বার-তিনবার বা বারবার বলে বুবু। ধৃতিমানকে ডাক নামে, ‘বাবু’ বলে ডাকে। সে বাবুর ছোট্টবেলার সঙ্গী। সেই রানাঘাটের বাড়ি যেখানে বাবা-মা সকলে ছিলেন। বাবারা পাঁচ ভাই। পৈতৃক বাড়ি। বাবু একাই । আর ভাই বোন নেই। ভাইবোন যারা তারা সব খুড়তুতো-জাঠতুতো আত্মীয়-স্বজন। আগেই মা চলে গেলেন বাবু তখন ক্লাস নাইন। বাবা যখন গেলেন তখন বাবু রবীন্দ্রভারতীতে নাটক নিয়ে মাস্টার্স করছে। বাবা চলে যাবার আগে থেকেই বাড়ির ভাগাভাগি নিয়ে চাপা কথাবার্তা চলতো।
বাবু তখন কলকাতায় শেয়ারিং থাকে। মাঝে মধ্যে রাণাঘাটে যায়। এসবে বড় একটা মাথা দিতো না। কিন্তু বাবা চলে যাবার পর, জেঠাকাকা খুড়তুতো-জাঠতুতো ভাইবোনের আত্মীয়তার আসল চেহারাটা বুঝতে পারল। রক্তের মিল থাকলেই কি মানুষ মানুষের আত্মার সঙ্গে মিলবে? একান্ত কাছের জন, স্বজন হয়ে উঠবে? তা সত্যি নয়! এটা বুঝতে পেরেই এক দিন কাকভোরে একটা ব্যাগ আর খাঁচায় বুবুকে নিয়ে রানাঘাটের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল।
একটা চিঠিতে লিখেছিল, “আমি এ পরিবারের সদস্য কিন্তু আমার এই বাড়ি বা সম্পত্তির কোন ভাগ চাই না। আমার কোন দাবি নেই।“ তারপর থেকে ধৃতিমান ভুলেও কোনওদিন রানাঘাটের বাড়িতে পা রাখেনি। তবে সম্ভবত উকিলের পরামর্শেই ভবিষ্যতের আইনী সমস্যা এড়াতে বাবুর কাকাজ্যাঠা খুড়তুতো-জাঠতুতো আত্মীয়স্বজনরা নিমরাজি হয়েই বাবুকে বাবুর প্রাপ্যের কিছুটা টাকা দিয়ে দলিলে সই করিয়ে নিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে বাবুর বন্ধুবান্ধব কম। একটু ঘরকুনো। স্কুলের পড়াশোনা ছাড়া গল্পের বই আর বুবুকে নিয়েই থাকতো। তবে গল্পের বই বলতে গোয়েন্দা গল্প।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৪: একটু হোক-ফোক!

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮০: পয়লা মাঘে সরস্বতী নদীর পাড়ে ৫০০ বছরের জমজমাট মাছ মেলা কখনও দেখেছেন?

ছোট্টবেলা থেকে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আনা অজস্র গোয়েন্দা গল্প পড়ে বড় হয়েছে। এখনও সেই গোয়েন্দা গল্প পড়ার খিদেটা একটুও কমেনি। দল চালাতে গিয়ে, ছবি করতে এসে কিছু অনাত্মীয় মানুষের সঙ্গে স্বার্থহীন বন্ধুত্ব হয়েছে। তারাই রানাঘাটের বাড়ির টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কে মান্থলি ইনকাম স্কিম করিয়ে দিয়েছেন। বাবা মায়ের নামে কিছু শেয়ার ছিল যেগুলোর নমিনি ধৃতিমান। বন্ধুরা ধৃতিমানকে বিলক্ষন চেনে জানে। তাই সব শেয়ার বিক্রি করে টাকাপয়সা যা পাওয়া গিয়েছিল ধৃতিমানের নামে ব্যাঙ্কে জমা করে দিল। ভাগ্যিস! তা না হলে দ্বিতীয় ছবির পর কোন ছবি নেই। টেলিভিশনের কাজে ফিল্মের থেকেও ঝামেলা বেশি টাকা কম। ফলে সময়ও কম! আজকাল ওটিটিতে কিছু ভাল কাজ হচ্ছে। কিন্তু ঠিকঠাক প্রডিউসার না পেলে ভালো কাজ করা সম্ভব নয়। আর ছবি ছেপে দেওয়াতে ধৃতিমান বিশ্বাস করে না। তাই টুকটাক সরকারি বেসরকারি ডক্যুমেন্টারি কাজ কিছু অডিয়ো ন্যারেশন-এর কাজকর্ম আর ব্যাঙ্কের মাসোহারায় বাবু আর বুবুর দিন কেটে যাচ্ছিল।
বুবু বাবুর সঙ্গে স্টুডিয়ো শুটিং-এ যেতো তবে আউটডোরে নয়। তখন বুবু থাকতো বাবুর নাটকের দলের একজনের বাড়িতে অতিথি হয়ে। বুবু বাবুর সঙ্গে খাঁচায় নয়, হারনেস বাঁধা বুবু বাবুর কাঁধে চেপে স্টুডিয়োতে যেত। স্টুডিয়োতে সেটিংএর লোকেরা বিশেষ স্ট্যান্ড বানিয়ে দিয়েছিল।
— বাবু কি করছিস? এই বাবু কি করছিস?
বুবুর খাঁচার পাশের ইজি চেয়ারটায় আধশোওয়া হতে হতে বাবু বুবুর দিকে তাকাল। তারপর জবাব দিল
— কিছু না!
— রেস্ট কর বাবু! রেস্ট কর। চা খাবি? বাবু চা খাবি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৪: কুর্গের সবুজ দুর্গ

এই বেলাটা বাবু আর বেরোবে না। ফ্রিজে রান্না করা খাবার আছে সেটা খেয়ে নেবে। রোজ হাত পুড়িয়ে রান্না করাটা পোষায় না। অনলাইন অর্ডার করাটাও লাক্সারি। কোথাও যাবার না থাকলে এই সময়টা বুবুকে খাঁচার থেকে বার করে দেয় বাবু। জানালায় নেট দেওয়া আছে। ঘরের দরজাতে নেট ঝোলানো। বুবু যাবে না তবু সাবধানে তো রাখতে হবে। দরজায় কেউ বেল দিলে বুবু যে কোন মানুষের মতো বলে ওঠে— এক মিনিট! এক মিনিট! আর এখন ঠিক তাই ঘটলো। বেল বাজতেই— বুবু বললো এক মিনিট। ভাগ্যিস বুবুকে খাঁচা থেকে বের করেনি। এখন নিচে গিয়ে দরজা খুলতে হবে। কিন্তু এখন কে এল? কারও তো আসার কথা ছিল না!! — চলবে।
 

* সুষমা কর হত্যারহস্য: পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৩

* হ্যালো বাবু! (Hello Babu) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ২য় খণ্ড।

Skip to content