বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


 

বাথটাব (পর্ব-৪)

তখনও বাথটাবে কৌশিকীর শরীরটা ভাসছে। ফরেন্সিকের মফিজুল ও তার সহকারি সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। কৌশিকীর চোখ বোজানো। শিরা কাটা বাঁহাতটা বাথটাব থেকে ঝুলছে। মানে সম্ভবত ক্রাইমসিনের কোনও বদল করা হয়নি। বাথটাব ঘেঁষা র‍্যাকে একটা দামী ওয়াইনের অর্ধেক খালি বোতল। পাশে দুটো মোবাইল। তার শরীরে শুধু একটা তোয়ালে ঢাকাদেওয়া। ধৃতিমান নিশ্চিত এটা মফিজুল-এর কাজ। তারা দু’জনে একসঙ্গে বহু মৃতদেহের প্রথম তদন্তে পৌঁছেছে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে মফিজুল মৃতদেহের নিরাভরণ শরীরের ওপর ফরেন্সিকের ছাপ মারা তোয়ালে চাপা দিয়ে দেয়। যাতে এ নিয়ে কেউ কোনও কথা না বলতে পারে।
মফিজুল যখন ফরেনসিক নমুনা নেওয়ার কাজ করছে সেখানে মাথা দেবার খুব একটা প্রয়োজন নেই বলে ধৃতিমান টয়লেট থেকে হোটেলের বিলাসবহুল কামরায় চলে এল। বিছানা এলোমেলো। ছেড়ে রাখা রাত পোশাক। আর সন্দেহজনকভাবে পিছনের এক কোণে পড়ে আছে একটি দামি হ্যান্ডব্যাগ। ধৃতিমান নিশ্চিত যে ওই হ্যান্ডব্যাগ এর মধ্যে মানি পার্স খোঁজ করলে অন্যান্য কিছুর সঙ্গে এই ক্রেডিট কার্ডটাও ছিল যেটা খুনের ঘটনার পর আততায়ী মেইন সুইচবক্স এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, কাউকে না বললেও ধৃতিমান চৌধুরী নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার যে এটা কোন আত্মহত্যার ঘটনা নয় আত্মহত্যার আদলে আসলে এটা একটা অত্যন্ত হিসেব করে করা খুন! এখন প্রশ্ন হল খুনির এক্সেস কার্ড নেওয়ার দরকার হল কেন? খুনটা করে সে দরজাটা টেনে দিলেই দরজা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে যেত। তাহলে সে কি চেয়েছিল কৌশিকীর অজান্তে এই ঘরের মধ্যে ঢুকতে? যদি তাই হয়, তাহলে সে প্রথমবার ঘরের এক্সেস কার্ডটা নিয়েছিল কি করে?
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৭: জননী সারদা সন্তানের দুঃখভার লাঘব করেন

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫১: বাথটাব: এটা শবর দাশগুপ্তদের যুগ!

ঘরের মধ্যে আর কিছুতে সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়া যাবে না যা মফিজুলের নজর এড়িয়ে যাবে। তবু দীর্ঘদিনের অভ্যেসবশত ধৃতিমান ঘরের রাখা চেয়ার টেবিল সোফা বিছানার নিচের কোণে নজর চালিয়ে নিল। তারপর ঘর থেকে বাইরের করিডোরে চলে এলো, চোখ চালিয়ে দেখতে লাগলো কোথায় কোথায় কটা সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। করিডোরে জ্বলতে থাকা আলোগুলোর পজিশন কেমন ভাবে আছে। ধৃতিমান রনজয় রায়কে সঙ্গে নিয়ে হোটেলের সিকিউরিটি রুমে গিয়ে সারাদিন ওই করিডরের ফুটেজ দেখতে চাইল।

সারাক্ষণ মোটামুটি নিয়মমাফিক লোকজন এসেছে। রুমসার্ভিস-এর লোকজন নির্দিষ্ট সময়ে খালিঘর সাফ করতে এসেছে। কোনও কোনও ঘরে নতুন বোর্ডার এসেছে। কৌশিকীকে সারাদিনে তিন চারবার ঘরে ঢুকতে ও ঘর থেকে বের হতে দেখা গিয়েছে। সবটাই শুটিংয়ের প্রয়োজনে পোশাক ও মেকআপ পরিবর্তন করে যাতায়াতের কারণে। প্রত্যেকবারই কৌশিকীর সঙ্গে তার টিমের মেম্বাররা মেকআপ আর্টিস্ট তার শুটিং কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। সন্ধেবেলায় কৌশিকী সম্ভবত ওই ওয়াইনের অর্ডার দিয়েছিলেন একজন বেয়ারা এসে সেই অর্ডার ঘরে ঢুকে সার্ভ করে যায়। দরজা সম্ভবত খোলা ছিল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৫: সাফল্য কি বংশগত উত্তরাধিকার? না কি ব্যক্তিগত কৃতিত্বের প্রমাণ?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

ঠিক এরপরেই প্রায় ৭ মিনিট ২৭ সেকেন্ড এই করিডরের দু’দিকের দুটি ক্যামেরায় কোনও ছবি ওঠেনি। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হোটেলকর্মীরা কাজের কারণে যাতায়াত করেছেন। এই সময়ে কৌশিকীর ঘরের থেকে কেউ বেরোননি বা কেউ ভেতরেও যাননি। তারপর লবির ক্যামেরায় দেখা গেছে কৌশিকীর টিমের সেই মেয়েটিকে ডেস্কে গিয়ে বারবার কিছু বলছেন। তারপর তাঁর জোরাজুরিতেই তাঁর সঙ্গে হোটেলের কর্মী এবং ডেক্স ম্যানেজারকে ছুটে আসতে এবং কৌশিকীর ফ্লোরে এসে দরজা ধাক্কাতে দেখা গিয়েছে। এবং আরও বেশ খানিকক্ষণ পর পুলিশ এবং ডাক্তারের সামনে কৌশিকীর ঘরের দরজা অ্যাকসেস কার্ড দিয়ে খুলেছেন ডেস্ক ম্যানেজার স্বয়ং।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক

পুরো সিসিটিভি কভারেজে ওই ৭ মিনিট ২৭ সেকেন্ড বাদ দিলে সন্দেহজনক কিছু নেই। ৭ মিনিট ২৭ সেকেন্ডকে খুব সহজেই সিকিউরিটির লোকজন বুঝিয়ে দিলেন টেকনিক্যাল গ্লিচ বলে কারণে অকারণে ল্যাপটপ মোবাইল ফোন হ্যাং করে যায় স্ক্রিন ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়। যেতেই পারে তবে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কেন এমন হয় সেটা ঘটনা ঘটার পর অনুসন্ধান করলে পরীক্ষা করলে হয়তো জানা যাবে।

দেহ পোস্টমর্টেমে চলে গেল ঘর সিল করে দিয়ে পুলিশ ফিরে গেলেন। মফিজুলকে ফোনের ইশারা করে ধৃতিমান হেঁটেই হোটেলের পোর্টীকো থেকে বের হচ্ছিল। পাশে এসে দাঁড়ালো রণজয় রায়ের কলকাতা পুলিশ লেখা জিপ—
—আসুন ড্রপ করে দেব! উল্টোডাঙা তো?
—থ্যাঙ্ক ইউ! আমি আসলে নিউটাউনেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাব। কাছেই হাঁটা পথ
—ওহ! আই সি! ওকে দেন! কিছু প্রয়োজন হলে ফোন করবেন! গুড নাইট!
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সাদা নীল জিপ হোটেলের ঢালু ড্রাইভ ওয়ে দিয়ে নেমে গেল। হেঁটে ফিরতে ফিরতে বাবু ভাবছিল, সে যে অ্যাভয়েড করছে রণজয় কি বুঝতে পারল? এই ব্যাপারটা অদ্ভুত! কখনও আমরা জানান দিতে চাই যে বিশেষ কাঊকে আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি! আবার কখনও এড়াতে চাই কিন্তু বুঝতে দিতে চাই না! মানুষের মন স্প্যাগেটির পাকের থেকে জটিল। বাবু ঠিক করতে পারছে না, ক্যাব বুক করবে নাকি এমনিই ট্যাক্সি পেয়ে যাবে। কিন্তু ফোনটা খুলে সেই ভিডিও খুলে ফেলল। একটু আগে সিসিটিভি ফুটেজের একটা অংশ রেকর্ড করেছিল ধৃতিমান। সেই ভিডিওটা চালিয়েই মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ড্রাইভ ওয়েতে থমকে গেল বাবু মানে ধৃতিমান চৌধুরী! ঈশ ! এই ক্লুটা কী করে মিস করে গেল সে? —চলবে।
 

কৌশিকী দত্তগুপ্ত হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪।

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content