
দর্শন তার বিবিধ যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনার পরিসরে জ্ঞান ও অজ্ঞান, বিদ্যা ও অবিদ্যাকে বিশেষরূপে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছে। ঈশোপনিষদে অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে বিদ্যার দ্বারা অমৃতত্ত্ব অর্জনের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞান বা অজ্ঞানের ভেদ উপস্থাপন করতে গিয়ে সূর্যমণ্ডলের প্রসিদ্ধ উদাহরণটি স্মরণ করা যায়। আকাশে ভাস্বর সূর্যমণ্ডলের প্রতিরূপ ভূমিতে স্থাপিত একাধিক পাত্রপূর্ণ জলে বহুরূপ হয়ে প্রতিভাত হয়। পরম সত্যজ্ঞান ঐ দূর আকাশের সূর্যমণ্ডলের তুল্য অদ্বিতীয়, স্বতঃপ্রকাশ। পাত্রের জলে দৃশ্যমান বহু সূর্যমণ্ডলের জ্ঞান প্রত্যক্ষদৃশ্য হলেও ভ্রান্ত, পাত্রের জল তিরোহিত হলে সূর্যমণ্ডল-ও আর দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে না। অতয়েব, ওই জ্ঞান সত্য নয়, অভ্রান্ত নয়। অজ্ঞান আপাত রমণীয় হলেও মঙ্গল-সংশ্লিষ্ট নয়।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা একজন জীবনযোদ্ধাকে যখন জীবনের পাঠ দিচ্ছেন, নির্দেশ করে দিচ্ছেন সত্যপথ, উদ্বোধিত করতে চাইছেন অন্তরের সুষুপ্ত বোধকে, তখন সেখানেও জ্ঞান ও অজ্ঞানের স্বরূপ উন্মোচন ও উপলব্ধির মধ্য দিয়েই সাধক, বীর কিংবা সংসারী গৃহস্থ অথবা মূঢ়চেতা হীনবল মানুষ আত্মশক্তি অর্জন করতে করতে উত্তরণের পথ পেতে চায়।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৯: আপনামাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৮: এখানে দিন-রাত-শীত-গ্রীষ্ম-আলো-অন্ধকার, সব কিছুরই হিসেব আলাদা
গীতা কাকে জ্ঞান কাকেই বা অজ্ঞান বলতে চায়?
আত্মগর্বহীনতার বোধ গীতায় জ্ঞানরূপে বিবেচিত। গীতা তাকেই জ্ঞান বলতে চায় যে চেতনায় উত্তীর্ণ হলে সংকীর্ণ আত্মশ্লাঘা, আত্মমুগ্ধ হয়ে নিজেকে বিশেষরূপে উপস্থাপনার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা মানুষের থাকে না। পাশাপাশি জেগে ওঠে অহিংসা, সহিষ্ণুতা ও সারল্য। স্থিতধী সেই মানুষ আত্মসংযমের অভ্যাসে অহঙ্কারমুক্ত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে নিতান্তই অনুরাগহীন হন। গীতা বলতে চাইবেন, এই সকল বৈশিষ্ট্য-ই জ্ঞান। পার্থিব বিষয়ের লাভালাভে ঔদাসীন্য প্রকৃত জ্ঞান, অপরের সুখ-দুঃখে ঔদাসীন্য প্রকৃত জ্ঞান, ইষ্ট ও অনিষ্ট বস্তুনিচয়ে সমমনোভাব প্রকৃত জ্ঞান।
আত্মগর্বহীনতার বোধ গীতায় জ্ঞানরূপে বিবেচিত। গীতা তাকেই জ্ঞান বলতে চায় যে চেতনায় উত্তীর্ণ হলে সংকীর্ণ আত্মশ্লাঘা, আত্মমুগ্ধ হয়ে নিজেকে বিশেষরূপে উপস্থাপনার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা মানুষের থাকে না। পাশাপাশি জেগে ওঠে অহিংসা, সহিষ্ণুতা ও সারল্য। স্থিতধী সেই মানুষ আত্মসংযমের অভ্যাসে অহঙ্কারমুক্ত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে নিতান্তই অনুরাগহীন হন। গীতা বলতে চাইবেন, এই সকল বৈশিষ্ট্য-ই জ্ঞান। পার্থিব বিষয়ের লাভালাভে ঔদাসীন্য প্রকৃত জ্ঞান, অপরের সুখ-দুঃখে ঔদাসীন্য প্রকৃত জ্ঞান, ইষ্ট ও অনিষ্ট বস্তুনিচয়ে সমমনোভাব প্রকৃত জ্ঞান।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৫: সরজমিনে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৪: প্রকৃতির সান্নিধ্যে কি গ্লানিমুক্তি সম্ভব? লক্ষ্মণের আবেগ কি সাধারণের মধ্যে সহজলভ্য?
গীতা জানাবেন, এই একান্ত বৈরাগ্যের বোধ অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-ভার্যা-পুত্র-গৃহ ইত্যাদিতে নিরাসক্তি, গুরুজনের প্রতি সেবা ও বিনম্রতা জ্ঞান। এছাড়াও নির্জনে একান্তবাসের অভিপ্রায়, জনসংঘের কোলাহলাদিতে বিরাগ ও অরুচি জ্ঞান। অধ্যাত্মবিষয়ের নিত্যত্বে নিত্যবিশ্বাস ও তত্ত্বচিন্তার অর্থাৎ বিষয়ের অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম স্বরূপচিন্তনে ও তার উদ্ঘাটনে আগ্রহ হল জ্ঞান। গীতা জানাবেন, পরমশক্তির প্রতি অচঞ্চলা অবিমিশ্রা ভক্তিই হল জ্ঞান।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৭: মা সারদার লিঙ্গপুজো

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৮: দুর্গম গিরি কান্তার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’
জ্ঞান, যোগ ও ভক্তির সমন্বয় গীতার মূল তত্ত্বনির্যাস। পরা শক্তির সঙ্গে অদ্বৈতবন্ধনের দার্শনিক অনুধ্যানের পাশেই সততঃ উদার আত্মসমর্পণ কিংবা উপনিষদের রহস্যতত্ত্বের গভীরে অবগাহনের সুসংহত যাত্রাপথে গীতা মানুষের জীবন, মন ও তার থেকে জাত বিচিত্র বোধরাশিকে মন্থন করে সংঘাতক্লিষ্ট সেই সত্তার গোপনলোকের সুপ্ত অনির্ণেয় বহুধ্বনির অনুরণনকে অনির্বাণ মহাসঙ্গীতের স্তরে উন্নীত করেছে। কখনও জ্ঞানালোক ভক্তির সঙ্গে মিশেছে, কখনও ভক্তি যুক্ত হয়েছে দর্শনে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯o: ছাতারে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৩: শরৎকুমারী স্নানাগারের সামনে বসে সারাক্ষণই সাজতেন
গীতা এই নির্মাণ ও বিনির্মাণের নানা স্তরে ইঙ্গিতে ও প্রত্যক্ষতঃ নানা উপদেশ দেবেন। জানাবেন জীবনের কর্তব্য ও অকর্তব্যকে। এভাবে চিহ্নিত হবে প্রকৃত ও সত্যজ্ঞানের পথ, গীতা বলবেন, পূর্বোক্ত নির্দিষ্ট বিষয়গুলিই জ্ঞান। পূর্ণমানব অথবা পূর্ণতাকামী মানবসত্তা সেই জ্ঞানের আলোয় ভাস্বর হন। এগুলি ব্যতীত আর সকলই অজ্ঞানমাত্র। অনুরাগ থেকে আকাঙ্ক্ষা, শ্লাঘা কিংবা ঔদ্ধত্য, আসক্তি কিংবা স্বার্থমগ্ন ক্ষুদ্রতার মধ্যে আপাত আত্মগৌরব আছে বটে, তবে তা আত্মাবমাননার নামান্তর। —চলবে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।।