বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

গীতার আন্তরিক ভাববস্তুকে বহন করে রবীন্দ্রগীতিতে ধ্বনিত হবে—
এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে,
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,
গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে,
তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে॥


সেই কোন্ দূর অতীতের এক মহাসংগ্রামের বিস্তৃত ভূমিতে সমাগত আত্মীয়বান্ধব আর অদূরবর্তী মৃত্যুশীতল বিয়োগবিধুর শূন্যতাকে নিমেষেই অনুভব করে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর অন্তরলোকে বেজে ওঠা মরণের ডঙ্কা আর হৃদয়াকাশে ঘনায়মান গভীর সুতীব্র বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলেন। নিমেষে বিস্মৃত হলেন বীরধর্ম, মুছে গেল আজন্ম অধীত, সঞ্চিত কৌশল, কর্তব্যনিষ্ঠা।
একদা লক্ষ্যভেদী আজ এই রণভূমিতে নিতান্ত অসঙ্গ, একা। তখন এক যুগন্ধর বাগ্মী পুরুষ বলতে থাকলেন ধর্মের বাণী, কর্তব্যের উপদেশের সঙ্গেই আত্মজাগরণের বরাভয় শোনালেন, স্মরণ করালেন শরণাগতকে। জীবনমৃত্যুর দোলাচল তাঁর ভাষ্যে যেন হয়ে উঠল নটরাজের চরণযুগলের নৃত্যমধুর নুপূরনিক্বণ অথবা মহাকালের দুই হাতে শোভমান কালের মন্দিরার নিত্যধ্বনি। সেই বীরহৃদয়ের বিজন আকাশে এরপর উন্মোচিত হবে পরমাত্মার বিশ্বরূপ, আলোয় ঢাকা সেই মহাসনে অনিন্দ্যকান্তি, অনন্তদ্যুতি, অমৃতনিষ্যন্দী অথচ ভীষণ, উগ্র, মধুর সত্যকে তিনি প্রত্যক্ষ করবেন। জীবনে সঞ্চারিত গভীর আশা, উত্সারিত নববোধকে নিবিড় পুলকে তিনি পেতে চাইবেন।

সেই বাগ্মী যুগপুরুষ জানাবেন—
“অন্তকালে চ মামেব স্মরন্মুক্ত্বা কলেবরম্।
যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ।।”
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৬: হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮২: মা সারদার ভক্ত যোগেন মায়ের কথা

যে আসন্ন মৃত্যুর করাল ছায়া দেখছো, বিয়োগবেদনার আশঙ্কায় তোমার ইন্দ্রিয় বিকল হচ্ছে সেই মৃত্যু প্রয়াতকে অনন্তগামী করবে, তিনি যুক্ত হবেন বিশ্বপ্রপঞ্চে। অখণ্ড পরমসত্তার আংশিক প্রকাশ জীব জীবনব্যাপী ভোগ, লোভ, দ্বেষ ও শোককে অতিক্রম করে স্বয়ং পরম হয়ে উঠবে।

অতয়েব হে বীরশ্রেষ্ঠ, জীবন অনিয়ত, দেহ অনিত্য, জাগতিক সম্পর্ক, পারস্পরিক দ্বেষ অথবা আকর্ষণ, গুণরাজি, দোষসকল সকলই নশ্বর; শরীর, ইন্দ্রিয়ের নিয়ত বিনাশ-ই এই জগতের একমাত্র সত্য, তবে ধ্রুব কি?
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৮: রামানুজ ভরত ও লক্ষ্মণ, আনুগত্যের প্রকাশে দু’জনেই অনন্য

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী

কর্ম, নিষ্কাম কর্মের অভ্যাস ও সাধন আসক্তিমুক্ত করবে। তবেই তুমি অনন্তগামী অমৃত হবে। জ্ঞান যোগ, ভক্তি এই ত্রিবিধের পরিপালনে সার্থক হবে সেই নিষ্কাম কর্মপ্রয়াস।

কিন্তু বিষয়তৃষ্ণা, পার্থিব আকর্ষণ, ভোগেচ্ছা ও লিপ্সা কি এতো অনায়াসে মুছে যাবে? পার্থিব জীবনে একেবারেই কি অসঙ্গত এই আকর্ষণ?

যিনি প্রাণসখা, নিত্য ভাস্বর যাঁর উপস্থিতি হৃদয়াকাশে, যিনি জীবনরথের সারথি, যিনি সকল ভোগের সাক্ষী অন্তরতর তিনি বলবেন—
“বিষয়া বিনিবর্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জং রসো’প্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ততে।।”
আরও পড়ুন:

বল বীর, চির উন্নত মম শির!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৮: শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন দ্বারকানাথ

জীবের বিষয়তৃষ্ণা থাকবেই। জীবশরীরে ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া থাকাটাই স্বাভাবিক। বিষয়ের আকর্ষণ আছে বলেই আজ এই যোদ্ধৃবর্গ রণাঙ্গণে। বিষয়ভোগেচ্ছা থেকে, সুখাসক্তি থেকে ক্রমে ক্রমে শরীরী ইন্দ্রিয়বিশিষ্ট জীব নিবৃত্ত হতে পারে। কিন্তু ইন্দ্রিয়াসক্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে না শরীরী জীব। এই নশ্বর লোকে উচ্চতর স্বাদের আস্বাদন-ই তাকে বিষয়তৃষ্ণা থেকে চিরমুক্তি দিতে পারে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content