শনিবার ১ মার্চ, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

কথায় বলে শিবের অসাধ্য কিছু নেই। আবার এমন অনেক কাজ আছে, যা নাকি শিবের-ও অসাধ্য। শিব শব্দের আক্ষরিক অর্থ কল্যাণ। তাহলে, কল্যাণশক্তি বা শুভবোধ সর্বশক্তিমান। তবে এও ঠিক যে, কল্যাণ অবাধ নয়, নিমেষেই সকল কিছু নিষ্কলুষ হয়ে যায় না। তাই বুঝি, শিবের অসাধ্যি অনেক কিছুই।

মঙ্গলময় শিব জগতের কল্যাণবিধান করবেন। তিনি আশুতোষ, রেগে যান চট করে, শান্ত-ও হন দ্রুত। তিনি শঙ্কর বলেই শম্ বা শান্তিবিধান করেন। সেই সেবার, অপমানিত হয়ে সতীর দেহ নিয়ে শোকে ক্ষোভে জগৎ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ালেন স্বয়ং কালাগ্নির মতোই। প্রলয়কালে তাঁর তাণ্ডবনৃত্যে ধ্বংসের বজ্রনির্ঘোষ, সৃষ্টিতে তাঁর নৃত্যচঞ্চল পদযুগলে আনন্দতাণ্ডব। তিনি সদাশিব, তিনি অর্ধনারীশ্বর, দেবীর সঙ্গে যুগলরূপে হৃদয়পুরের অধীশ্বর, তিনি নটরাজ, তাঁর নৃত্যে ছন্দের তালে তালে জেগে ওঠে জন্ম-মৃত্যু, দুলে ওঠে জগৎ, তাঁর পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে আলোর নাচন, মহাসৃষ্টির আনন্দধ্বনি, মহাধ্বংসের ভৈরব সংকেত।
তারপর নবজন্মে পার্বতী শিবকে লাভ করলেন। পঞ্চশর কামদেব মদন ত্রিগুণাতীত মৃত্যুঞ্জয় শিবের নেত্রাগ্নিতে পুড়ে ভস্ম হলেন। কাম হল অতনু, রতি সাকার থাকল। কবি বলবেন, এতো শেষ নয়, ধ্বংস নয়। শরীরী কাম অমর্ত্য প্রেম হয়ে বুঝি জগতে এবার ছড়িয়ে পড়ল। উমা পার্বতী তপস্যায় মনোহরণকে পেলেন। দিবসে যে ধন হারায়, তাকেই তো আঁধার রাতে ফিরে পাওয়ার সময়। তাই শিব এলেন, পার্বতী অপর্ণা হয়ে অমর্ত্যকে লাভ করলেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৯: বুলবুলি

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৪: মনের ইচ্ছে থাকলেই কার্যসিদ্ধি সম্ভব

শিবরাত্রির ব্রতকথায় জানা যাবে, কোনও ব্যাধ একদিন শিকার না পেয়ে বনের পথ হারিয়ে বেলগাছে রাত কাটালো। গাছের নিচে অজ্ঞাতে থাকা শিবলিঙ্গে খসে পড়ল বেলপাতা। অভুক্ত ব্যাধ তার ওই রাত্রিবাসেই নিজের অজ্ঞাতে শিবকে তুষ্ট করে ফেলল। তারপর যেদিন তার মৃত্যু হল, যমদূত আর শিবদূতের দল এসে তাকে নিয়ে যেতে চাইল। কারোর দাবিই কম নয়। সারাজীবন প্রাণিহত্যা করে সে নরকবাসী হবে। কিন্তু রত্নাকরের মধ্য থেকেই যেমন বাল্মীকির উত্থান, তেমন ঐ একটি অজ্ঞাত পুণ্যকর্মেই সে শিবলোক পেল।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৪: খরগোশ ও কচ্ছপ

মঙ্গলকাব্যের শিব সংসারী, দরিদ্র, নেশাখোর, অকর্মার ঢেঁকি, অসহায়। অতিবড় বৃদ্ধ পতি, সিদ্ধিতে নিপুণ, যে তাঁকে বিয়ে করেছে তার কপাল পুড়েছে। সেই অভাগা স্বামীও কপালপোড়া। এই সমাজচিত্রের অন্তরালে থেকে যায় দর্শনের তত্ত্ব। কর্মপ্রবণ অচেতন প্রকৃতি ও অকর্মা চৈতন্যময় পুরুষের তত্ত্ব। সাধক তাঁকেই কালরূপিণী কালীর পদতলে চৈতন্যময়, সৃষ্টির কর্তৃরূপে দেখেন। তিনিই নীলকণ্ঠ হয়ে বিপুল জাগতিক বিষের বিনাশ করেন। তিনিই রুদ্র হয়ে মৃত্যুদূত, তিনিই ক্রমে ক্রমে গিরিশ, শঙ্কর, ভূতনাথ হয়ে শিব হবেন। পাঞ্চভৌতিক এই জগতের কল্যাণ বিধান করবেন, আবার প্রলয়ে মহাকাল হয়ে গ্রাস করবেন তাকে। এ জগতের অলঙ্ঘ্য নিয়ম।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৬: এক সন্ধ্যায় মা সারদার বলা ভূতের গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’

মনে পড়বে, ষণ্ড ও ভূতের দল নিয়ে নগ্ন শিব বিয়ের মণ্ডপে হাজির হলেন। আবার, অতুল ঐশ্বর্যের অধীশ্বর চাঁদবণিক ওই ভস্মমাখা বিভূতিভূষণ শিবেই মজলেন। ভাঙলেন, কিন্তু মচকালেন না। তবে তাঁর বাম হাতেই ফুল পেয়ে মনসা সন্তুষ্ট হলেন। এই মনসা বামদেব শিবের মানসকন্যা বলেই প্রসিদ্ধ। এ এক অদ্ভুত উত্তরণের সমাজেতিহাস। যার অন্তরে সামাজিক অভিবাসনের তত্ত্ব, যেখানে রুদ্রের আদিম ভয়প্রদ রূপ থেকে আশুতোষ শিবের রোগ কিংবা শোক, ধরাবন্ধন কিংবা ভয় থেকে মুক্তিদায়ক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর বরাভয়ের যাত্রাপথটা ধরা থাকে। যাঁকে অক্লেশে ঠাট্টা করেন প্রাচীন কবি, অন্তরালে থেকে যায় সেই ব্যোমকেশ অনন্তরূপের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। কোনও গুণ নেই বলে ভর্তসনার আড়ালেই ব্যাজস্তুতিতে থেকে যায় সেই মহাকালের ত্রিগুণাতীত অমৃতরূপ।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

পুরাণাদি শাস্ত্রমতে শিবরাত্রিতেই হরপার্বতীর মহামিলন ঘটেছিল। শিবরাত্রি শিবের বিবাহবার্ষিকী, অ্যানিভার্সারি। তবে শিব স্বয়ম্ভূ। তাঁর কোনও ছেলেবেলা, ছোটবেলা নেই। কৃষ্ণের মতো বাল্যলীলা নেই। শিব্রাম চক্কোত্তির গল্প “লাভের বেলায় ঘণ্টা”তে এক বাচ্চা মন্দিরের ঘণ্টাটার দখল নিতে শিবলিঙ্গের মাথাতেই চড়ে বসেছিল। এতে মহাভারত অশুদ্ধ হলেও শিব বেজায় খুশি হয়েছিলেন, ভক্ত নিজেকেই নিঃশর্তে সঁপে দিয়েছে যে। এই ভক্তির তত্ত্ব ধর্ম, ইতিহাস ও সমাজ-রূপান্তরের যৌথ পরিণতি। ভগবানকে এককালে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হলেও ক্রমে নাকি মানসিক আয়াস, ভজনা, আকাঙ্ক্ষা বা ভক্তিতেই তিনি ধরা দেন।

বৈষ্ণব ভক্তিরসের জোয়ারের পাশেই আশুতোষ শিব ভারতাত্মার কালপুরুষ হয়ে জেগে থাকেন। প্রেমের দেবতা কৃষ্ণের তত্ত্বে দেহাতীত প্রেমের আনন্দআখ্যান। ঈশাবাস্যোপনিষদের যে ঈশের ঐশী শক্তিতে জগত্ সুরক্ষিত, ঐশ্বর্যে ভাস্বর, সেই ঈশ্বরের মঙ্গলরূপ জগতের প্রতিটি প্রকাশেই। তিনি সত্যরূপ, আমাদের সত্যান্বেষী সেই ব্যোমকেশ-ই। সত্যবতীর সঙ্গে কলহ করতে করতে তিনি যেমন সত্য, শিব, সুন্দরের মূলে পৌঁছে যান, তেমনই দেবীর সঙ্গে মহামিলনে অভিন্নাত্মা হয়ে, তাঁকে কর্মপ্রেরণা, চৈতন্য দান করতে করতেই যুগে যুগে কালে কালে অমিতবিত্ত নৃত্যের তালে তালে বিশ্বতনুর অণুতে অণুতে কাঁপন ধরিয়ে সন্ন্যাসী শিব সুন্দর, শঙ্কর, ভয়ংকর হয়ে ওঠেন।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content