শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সেই উলের স্মৃতি বুনতে বুনতে মনে আসছে আরও এক মুহূর্ত। একবার পুজোর সময় মানে দুর্গাপুজো শুরুর বেশ কয়েকদিন আগে মাসির জন্য পিওর সিল্কের শাড়ি নিয়ে গেলাম। সেদিন বাবার সঙ্গে আমার মাও সঙ্গে গিয়েছিলেন। মা শাড়ির প্যাকেট ওঁর হাতে দিতেই বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে একমুহূর্তে শাড়ির প্যাকেট খুলে ফেললেন। তারপর সেই সহজাত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, কি সুন্দর শাড়ি গো!

সেই অর্থে এগুলোর কোনওটাই সেরকম মহামূল্যবান কিছু নয়। দেশের এক বিশিষ্ট মানুষ কিন্তু সেই ছোট ছোট জিনিসই এত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতেন যে, সেই প্রসন্নচিত্ত আজও মনের খাতায় সযত্নে রয়ে গিয়েছে। সেই সব ছোট ছোট মূহুর্ত আজ এতবছর পরেও স্পষ্ট। উজ্জ্বল। আগ্রা ঘরানার সেই অগ্রজশিল্পী চলনেবলনে কথাবার্তায় হাবভাবে ঠিক এরকমই এক সহজ মানুষ।
আবার ফিরে আসি আমার ফেলে আসা সেই দিনগুলোয়। ঘড়ির কাঁটা মেনে ঠিক সকাল সাড়ে ছ’টায় আকাশবাণী যশস্বী শিল্পীদের গানের ডালি নিয়ে হাজির হত। সঙ্গীতের বিশেষ অনুষ্ঠান বর্ণালী ও মঞ্জুষা শুরু হতো শ্যামাসংগীত নজরুলগীতি রাগপ্রধান মূলত এই ধরনের সনাতনী বাংলা গান দিয়েই।

যেমন করেই হোক সময়টাকে বাগে এনে শুনতেই হবে সে অনুষ্ঠান। সেই প্রথম হল শোনা “আমার মনের বেদনা”। শিল্পী দিপালী নাগ। মায়ের কাছ থেকে শুনলাম ওঁর নানান সাফল্যের অনেক কথা। এর আগে আমি ওঁর গান আলাদা করে কখনও শুনিনি।
আরও পড়ুন:

ফেলে আসা স্মৃতি: সুরসম্রাজ্ঞী দীপালি নাগ, পর্ব-২: ‘হ্যাঁ, যাঁর কাছে ও এতদিন শিখছে তা সঠিক’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

মা বললেন, প্রতি রবিবার ওঁর কাছেই তোমাকে যেতে হবে। মাসির সঙ্গে একদম প্রথম দিন কথা বলার পর বর্ণালীতে প্রথম তাঁর গান শোনা কাকতালীয় হলেও একেবারেই ছিল সত্যি।

তবে আমার মা আর বাবার উৎসাহ ছাড়া আমার গান শেখাও হতো না আর মাসির কাছাকাছি পৌঁছনোর তো প্রশ্নই নেই। আসলে মা খুবই ভালো গাইতেন। কম বয়েসে হালিশহর বা উত্তর ২৪ পরগণার অন্যত্র, কলকাতার মুরারি স্মৃতি সঙ্গীত বা অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো মিউজিক কম্পিটিশন-সহ নানান নামিদামি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

বারবার চোখে ভাসছে মাসির সিনিয়র ছাত্রীদের সেই মুখগুলো। দিপুদি শিবানিদি ঝর্ণাদি…যাঁদের তান শুনতে শুনতে নিয়মিত গানঘরে ঢুকতাম। যাঁরা ছিলেন সপ্তসুরের কান্ডারি। সপ্তসুর ছিল মাসির সঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র। একদিন জোরদার প্র্যাকটিসে ছোট্ট ব্রেক। দিদিদের মধ্যে কেউ বাবাকে বললেন, মেয়েকে আমাদের সঙ্গে ছেড়ে দিন। আমরা দিদির কাছে প্রায় ওর মতো বয়স থেকেই শিখছি। এই তো সামনেই ওয়ালটেয়ারের প্রোগ্রাম।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’

বাবা বললেন, একে তো স্কুল। তার ওপর বাড়ি দূরে। ওখান থেকে কলকাতা ফিরতে দেরি হলে সেদিন রাতে বাড়ি ফেরাটা সমস্যা। কয়েক মিনিটের জন্য মাসি ছিলেন না। কিন্তু গানঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাবার কথাটা কানে শোনামাত্র মাসি বলে উঠলেন বাড়িতে ফিরতে হবে কেন রাতে ও আমার কাছে থাকবে।

তারপর থেকে আজ পর্যন্ত নানাভাবে অনেক বিশিষ্ট গুণী মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি। কিন্তু মাসির মতো এমন মানুষ আমি আজও খুঁজে পাইনি। সপ্তসুরের প্রায়ই নানাজায়গায়অনুষ্ঠান থাকতো। আমার গান শেখা হয়ে গেলে ওদের রিহার্সাল শুনতাম। রিহার্সালের গায়ন রীতির ত্রুটি-বিচ্যুতি শুধরে নিতে বাজতে থাকতো টেপ রেকর্ডার। “শাওন আয়া ডালে ঝুলা’ বা “ঘিরঘির আহিরে” এসব গানকে ভর করে সে ঘরের বাতাসে খেলতো সুরলহরী। বাড়িফেরার সময় মনভরে থাকতো সুরে সুরে।

দীপালি নাগ প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত শিক্ষণকেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত।

ফিরে ফিরে আসছে নানা ছবি। একবার কলামন্দিরে সপ্তসুরেরঅনুষ্ঠান হবার কথা। মাসি আমার আর বাবার দুটো কার্ড দিয়েছেন দেখতে যাওয়ার জন্য। প্রবল বৃষ্টিতে কলকাতা প্রায় ভাসছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। খারাপ আবহাওয়ার জন্য অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেল। কিন্তু সেটা আমি জানি না। আমরা অনেকটা দূরে থাকি। তাই শুধু এটুকু খবর দেবার জন্য উনি সকালবেলা আমার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে ছিলেন।

ওই রকম একজন মানুষ যার প্রজ্ঞা সুদৃঢ় শিকড়ের মতো বহু গভীরে বিস্তৃত। যিনি দেশে-বিদেশে নানান গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের গুরুদ্বায়িত্বে। আকাশবাণীর সহ-প্রযোজিকা। বাংলা রাগপ্রধান নিয়ে অবিরাম চর্চা। আজ এতদিন পর উপলব্ধি করতে পারি শুধু গান গাওয়া বা শেখানো তো নয় এছাড়াও তাঁর কত ব্যস্ততা। তাঁর আমার মতো নতুন শিক্ষার্থীর জন্য এতটা ভাবনা!—চলবে।
* লেখিকা চন্দ্রাণী সরকারের ভালোবাসা গান, সংসার, বেড়ানো, ভ্রমণকথা লেখা।

Skip to content