শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


বন্ধু’র কাছে শোনা, তার জবানিতেই বলি…
নর্থ ইস্টে যাব। সকালবেলা প্লেন। গাড়িঘোড়া কী পাই না পাই। যতক্ষণের প্লেন চড়া তার চেয়েও বেশি সময় হাতে রেখে বাড়ি থেকে পাড়ি দিলাম দমদম এয়ারপোর্টে। সময় মতো পৌঁছনো আছে। ব্যাগেদের মধ্যে আত্মনেপদী পরস্মৈপদী এ সব ভাগ বাটোয়ারা আছে। বড় হওয়া স্বাধীন ব্যাগেরা কত বড় হয়েছে সেটা অবশ্যই তাদের ওজন থেকে জানা যাবে। জরিমানার ভয়ে ব্যাগপত্তর ওজনের সময় সিঁটিয়ে সংখ্যার নাচানাচি লক্ষ্য করা আছে। তারপর দিদিমণির কাছ থেকে নিজের টিকি ব্যাগের টিকি নিয়ে, যে যার কোলের ব্যাগ সামলে, স্বাবলম্বী ব্যাগদের বিদায় জানাবার পর একটু নিশ্চিন্ত!

কিন্তু এ কী! নীল রঙের চেন দেওয়া বিগ-শপারটা? আমরা মোট চারজন। চারজনের সঙ্গে নিয়মমাফিক চারটি পোষ্য। তারা নেহাত কচিটি নয়। পেটভর্তি। বেশ নধরকান্তি ধেড়ে হয়ে উঠেছে। ওজন নিলেই কেলেংকারি। তাই দিদিমণির চোরা-নজর থেকে বেচারাদের বাঁচাতে সকলেই সক্রিয় ছিল। যৌথ-দায়িত্বে থাকা নীল বিগ-শপার ছিল ভাগের ব্যাগ। নজর পায়নি।

চাপাস্বরে দোষারোপের প্যানেল ডিসকাশন শুরু হল। ব্যাগ নিয়ে খানিক ব্যাগাডুলি খেলার পর একজন সহৃদয় কর্মী জানতে চাইল—
‘কী হয়েছে?’
‘ব্যাগ। মিসিং।’
‘কোথায়?’
‘বোধহয় গেটে ফেলে এসেছি’
‘তাতে ছিল কী?’
কয়েক মূহুর্ত নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ির স্তব্ধতা।
‘অনেক কিছু।’
‘কোন ফ্লাইট?’
‘ না-হাতে খানিকটা সময় আছে।’
‘আমার সঙ্গে আসুন!’
দিনকাল এমন কেউ যদি নিজের থেকে কারও উপকার করতে চান তাহলেও আমাদের মনে সন্দেহের ছোঁয়া, চোখে-মুখে বিশেষ করে ভুরুতেই অবিশ্বাসের ৪৪০ ভোল্ট। তবু পরিজনদের চোখে চোখে জানালাম অসুবিধে নেই। নিজের কাঁধে-ঝোলানো আত্মনেপদীকে দিয়ে এলাম যাতে আমি শেষমূহুর্তে ঝাড়া হাতপা ঢুকে যেতে পারি।

“তোমরা সিকিউরিটি চেক করে ঢুকে যাও। আমার ব্যাগটা খেয়াল রেখ’’।
নিজের টিকি থুড়ি বোর্ডিংপাস নিয়ে আমার বিচারে ‘সেরা সমাজসেবী’ পাওয়া সেই কর্মীর পেছনে পেছনে ছুটলাম। তারই চেষ্টায় এয়ারপোর্টের মেনগেটের নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা গলে বাইরে গিয়ে দেখালাম কোথায় এসে নেমেছিলাম ব্যাগ কোথায় রেখেছিলাম ইত্যাদি।

এগিয়ে এলেন কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিক। সব শুনে সিনেমায় দেখা তৎপরতায় কাউকে ফোন করে কিছু নির্দেশ দিলেন। কান থেকে মোবাইল সরিয়ে আমাকে একটাই প্রশ্ন করলেন—
‘কটায় এখানে নেমেছিলেন। রাফলি।’

বিমানবন্দরের সেই কর্মীকে একটু দাঁড়াতে বলে নিজের মোটরবাইকে আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে তুলে নিয়ে গেলেন কাছাকাছি সিকিউরিটি কন্ট্রোলরুমে।
অবাক চোখে সিসিটিভির ফুটেজে নিজেদের গাড়ী থেকে নামা ব্যাগ নিয়ে গেটের দিকে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে দেখা মিলল আমাদের হারানিধির।
‘ওই যে’
আরও পড়ুন:

রিভিউ: ২০০ কোটি টাকার চোখ-ধাঁধানো দক্ষিণী অ্যাকশন ছবি ‘থুনিবু’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫০: স্বপ্নের ‘যাত্রা হলো শুরু’

হারিয়ে যাওয়া শিশুর মতো আমাদের নীলরঙা বিগ-শপারকে পিছনে ফেলে রেখে আমরা গেটের মধ্যে অদৃশ্য হলাম। এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি যাচ্ছে আসছে। আর ‘ব্যাগ অ্যালোন’-এর মতো একা রাস্তায় পড়ে রয়েছে আমাদের সেই নীলরঙা বিগ-শপার।

ঘন ঘন সফরসঙ্গীদের ফোন আসছে। মনিটরে চোখ রেখে ‘ফেলুদা’ আধিকারিকের আশ্বাসবাণী
‘গেটে পৌঁছে দেব। দুমিনিট। ফাস্ট ফরোয়ার্ড।’

দুহাতে দুপাশে গুলি চালানোর মতো হিরোগিরি দক্ষতায় ফেলুদার নির্দেশ একইসঙ্গে আমায় ও মনিটরের সামনে বসা স্টাফকে। দেখে আমি ককিয়ে উঠি—
‘ব্যাগটা নেই’
‘হুঁ! স্লো। এক ফ্রেম এক ফ্রেম।
ফেলুদার চোখ মনিটরে আমি দেখছি প্যান্ট আর খয়েরি পাঞ্জাবি-পরা একটা রোগাটে ছেলে এদিকওদিক দেখতে দেখতে আমাদের ব্যাগটা তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
‘কী কী ছিল ব্যাগে?’
‘অনেক কিছু। ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।’
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৭: প্রতিশোধের আগুন কি ডেকে আনল মৃত্যুমিছিল?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

দমদম ছেড়ে আকাশে ওঠার জন্যে প্লেন যখন নড়তে শুরু করল তখন হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল এয়ার পোর্টের রাস্তায় পড়ে থাকা সেই নীল রঙের বিগ-শপারটা। মনটা আরও ভেঙে গেল যখন এক কাঁড়ি পয়সা খরচ করে পেট ভরাতে প্যাকেটের বিস্বাদ খাবার চিবোতে হচ্ছে তখন। এই হোটেল থেকে আসা প্যাকেটের খাবারগুলো হয় একই শেফ বানায়, না হয় কোনও এক বিশেষ মশলা দিয়ে বানানো হয়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত দুটি একটি ছিটকে যাওয়া ব্যতিক্রম ছাড়া সবকটা রান্না করা প্যাকেটজাত খাবারের বর্ণ-স্বাদ-গন্ধ একই রকম।

ভোরবেলা ব্রেকফাস্ট না করে বেরোনো। সেই জন্যে আগের রাত থেকে অনেক প্ল্যান করে ধবধবে সাদা ময়দার লুচি, লালচে হলুদ কষা আলুর দম সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল যথেষ্ট পরিমাণে। প্রাতরাশের পরিকল্পনা দু-দফায়। এয়ারপোর্টে টেররিস্ট চেকিং-এর পর তীর্থের কাকের মতো বসে থাকার সময় একবার। আর আকাশে উড়ে জানলায় মেঘ-রোদ্দুরের খেলা দেখতে দেখতে আরেকবার। সব মাটি হয়ে গেল। মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আরও একটা কারণে সেই বিগ-শপারে ছিল দু বাক্স-বোঝাই এলিয়ে থাকা ভুঁড়ির মতো নিটোল তালশাঁস সন্দেশ। এত সব ঐশ্বর্য ভরা ছিল আমাদের সেই নীল রঙা বিগ শপার।
যাইহোক গন্তব্যের এয়ারপোর্টে পৌঁছে ‘স্বাবলম্বী’ ব্যাগেদের ‘চাকার দোলনা’ থেকে নামিয়ে সবে কয়েক পা এগিয়েছি, অমনি কুরকুর করে মোবাইল বেজে উঠল। অচেনা নম্বর।
‘আমি এস আই স্যান্নাল। কলকাতা পুলিশ।’
পুলিশ শুনেই পেটটা গুরগুর করছে।
‘আরে! দমদম এয়ারপোর্ট। নীল রঙের বিগ-শপার।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন।
খেয়াল হল আসার সময় তাড়াহুড়ো করে নাম ফোন নং দিয়ে এসেছিলাম।
মানতে হবে কলকাতা পুলিশের দক্ষতা। কোনওভাবে বাধা না পেলে এঁদের কর্মক্ষমতা প্রশ্নাতীত। এস আই স্যান্নাল বারবার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে সেই ব্যাগ নিয়ে যাওয়া লোকটিকে স্পট করে ফেলেছেন। সে একটি গাড়ির ড্রাইভার। প্রাইভেট পার্কিং-এ অন্য একটা ক্যামেরা ফুটেজে ওই লোকটিকে ওই বিগ শপার নিয়ে গাড়িতে উঠতে দেখা গিয়েছে। গাড়ির নম্বরও দেখা গিয়েছে। গাড়ির নম্বর ট্রেস করা গিয়েছে। গাড়ির মালিককে ফোন করে ড্রাইভারকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ড্রাইভার এসেছে।
এর মধ্যে এত কাণ্ড হয়ে গেল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৯: হিমসিম খাও কেন এসো বোসো আহা রে! / খাওয়াব এমন খাওয়া এগ কয় যাহারে

‘নিন কথা বলুন। আপনার বিগ শপার টিফিনবক্স সব এখানে এসে ফেরত দিয়েছে। ওই যে অফিসে আপনি এসেছিলেন! ফেরার দিন মনে করে আমায় একটা ফোন করে পিকআপ করে নেবেন, আমি বলে রাখব। নিন শ্রীমান এর সঙ্গে কথা বলুন।
ভাঙা-গলায় একজন বলে উঠল

‘স্যার মাফ করে দিন স্যার। আর কোনওদিন এমন অপরাধ করব না। মাঝেমধ্যে এয়ারপোর্ট ডিউটি করি। এরকম ব্যাগে দেখেছি ভেতরে ভাল-মন্দ খাবার পাওয়া যায়। আপনারা তো আর বেরিয়ে এসে ব্যাগটা নিতেন না। মানে কেউই খাবারব্যাগের জন্যে আর…। হয়তো কুকুরে মুখ দিত। তার বদলে আমি আর আমার এক বন্ধু ভাগাভাগি করে খেয়েছি। ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা চাইছি। আপনি না বলে দিলে আমায় চুরির কেস দিয়ে দেবে।’

স্যান্যালকে মানা করা ছাড়া আমার সে বন্ধু সেদিন কোনও জবাব দিতে পারেনি। দিন পনেরো বাদে ফেরার সময় এসআই সান্যালকে ফোন করেছিল। সেই নীল বিগ শপার ফেরত নেওয়ার সময় আলাদা আলাদা বাক্সে স্পেশাল মিষ্টি তুলে দিয়ে দিয়েছিল। একটা স্যান্যালের আর অন্যটা সেই অপরিচিত ড্রাইভারের। যে মাঝে-মধ্যে এয়ারপোর্ট ডিউটি করে। যাকে বলে মধুরেণ সমাপয়েৎ।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content