শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


নাগমহাশয় মানুষটি যথার্থ সাধু, তাঁর কোনও চাহিদা বা জিজ্ঞাসা নেই সারদা মায়ের কাছে। তাঁর চেহারায় ক্লান্তির ছাপ শ্রীমায়ের দৃষ্টি এড়াইনি। কোনও অভিযোগ নেই তার। শুধু মা-মা বলে অবিরত চোখের জল ফেলছেন। শ্রীমা তাঁর কোনও গভীর বেদনা আছে কিনা, জানেন না। তাঁর অনুভবে নাগমহাশয়ের আনন্দের আতিশয্যই অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। শ্রীমার দেওয়া একখানি কাপড় তিনি ভক্তিতে মাথায় জড়িয়ে রাখতেন। মা সারদার সঙ্গে দেখা হওয়ার কিছুদিন পর তিনি চলে যান ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে। মা সারদা শুনে গভীর ব্যথা পান। তিনি ভক্ত নাগমহাশয়ের একটা ছবি নিজের কাছে রেখেছিলেন। পরে শ্রীমতী শচীবালা সরকার মা সারদার কলকাতার বাড়িতে গিয়ে দেখে ছিলেন, শ্রীমা তাঁর ঠাকুরঘরের দেওয়ালে টাঙানো স্বামীজি, গিরীশচন্দ্র ঘোষ ও নাগমহাশয়ের ছবি এক-এক করে ভিজে গামছায় মুছে প্রত্যেকের ছবিতে চন্দনের ফোঁটা দেন এবং হাত স্পর্শ করে চুম্বন করেন। তারপর নাগমহাশয়ের ছবিটি হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলেন, ‘কত ভক্তই তো আসচে, এমনটি আর দেখচি নি’।
যখন মা সারদা নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে ছিলেন, তখন তাঁর এক অভিনব দর্শন হয়। তিনি দেখেন যে, ঠাকুর গঙ্গায় নামলেন, নামামাত্র তাঁর দেহ গঙ্গার জলে মিলিয়ে গেল। আর স্বামীজি ‘জয় রামকৃষ্ণ, জয় রামকৃষ্ণ’ বলতে বলতে সেই গঙ্গার জল নিয়ে দু’হাতে চারদিকের অসংখ্য মানুষের মাথায় ছিঁটিয়ে দিতে লাগলেন ও সকলে জীবন্মুক্ত হয়ে চলে যেতে লাগল। এই দৃশ্যটি শ্রীমার মনে এতটাই রেখাপাত করেছিল যে, ভয়ে তিনি কিছুদিন গঙ্গাস্নান করতে পারেননি, যাতে ঠাকুরের গায়ে তার চরণস্পর্শ না হয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল

এই নীলাম্বরবাবুর বাড়িতেই মা সারদা যোগীনমার সঙ্গে পর পর পাঁচদিন পঞ্চতপা অনুষ্ঠান করেন। পঞ্চতপা ব্রতের সবকিছু পাঁচ সংখ্যাকে নিয়ে। পাঁচটি তাপের মাঝে বসে পাঁচদিন ধরে তপস্যা করা হল এর নিয়ম। শ্রীমাও পাঁচদিন ধরে অনুষ্ঠান করেছিলেন বলে শোনা যায়। তার জন্য একতলার ছাদে মাটি ফেলে এই ব্রত করা হয়েছিল। শ্রীমা স্বয়ং বলেছেন যে, ঠাকুরের তিরোভাবের পর তিনি অস্থির হয়ে পাগলের মতো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে থাকেন। কোথাও তিনি মনে শান্তি পান না। তাঁর এইরকম মনের অবস্থা দেখে যোগীনমা পরামর্শ দেন যে, মা আর তিনি একসঙ্গে পঞ্চতপা অনুষ্ঠান করবেন, তবেই অন্তরের জ্বালা দূর হবে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

পঞ্চতপার জন্য চারদিকে পাঁচ হাত পর পর চারটি অগ্নিকুণ্ড করা হল, তাতে ঘুঁটে দিয়ে আগুন জ্বালানো হল। আর মাথার উপরে সূর্যের তেজ, এই নিয়ে হল পঞ্চতপা। সারদা মা বলেছেন, ‘বুঝতেই তো পার, ব্যাপার কি! সকালে স্নান সেরে এসে দেখি, আগুন খুব জ্বলচে। প্রাণে বড় ভয় হল, কি করে এর ভিতর যাব আর সূর্যাস্ত পর্যন্ত বসে থাকব! যোগেন বল্লে, কোন ভয় নেই মা, এস। তখন মনে মনে ঠাকুরের নাম নিয়ে ঢুকে দেখি, আগুনের কোন তাপ নেই! তবে পাঁচ পাঁচদিন এমন কাজ করায় শরীর যেন পোড়া কাঠ হয়েছিল’। এই ব্রতানুষ্ঠান করার আগে দেশে থাকার সময় শ্রীমা কিছুদিন ধরে একজন কিশোরবয়সী সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পেতেন। তাঁর মাথায় রুক্ষ চুল ও গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ছিল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৫: রাজা সবকিছু হাতে করে প্রজার মুখে তুলে দেবেন এমনটা ভাবার আর সময় নেই

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

শ্রীশ্রীমায়ের কথার দ্বিতীয় ভাগ অনুসারে উমেশ দত্ত সন্ন্যাসিনীর স্থলে দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসীর কথা বলেছেন। কিন্তু ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য এবিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে, মার পক্ষে সন্ন্যাসিনী দেখাই স্বাভাবিক, কারণ, ওই মূর্তি আসলে তাঁর নিজেরই প্রতিরূপ। শ্রীমাও বলেছেন যে, পঞ্চতপা করার পর এই সন্ন্যাসিনী তাঁর দেহে মিলিয়ে যান। স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি দেখতুম, দশ-বার বছরের একটি মেয়ে, গেরুয়া পরা, সঙ্গে সঙ্গে ফিরচে আর আমাকে যেন কিছু কত্তে বলচে। তখন আমার ভিতর থেকে উঠল, ‘পঞ্চতপা’। পঞ্চতপা কি জানতুম না। যোগেনকে বল্লুম পঞ্চতপা কি’? উমেশ দত্তও পরে একটি চিঠিতে সন্ন্যাসী দেখা নিয়ে নিজ স্মৃতি বিভ্রম স্বীকার করেছেন।

এ প্রসঙ্গে স্বামি অরূপানন্দ শ্রীমাকে বলেছিলেন, ‘পঞ্চতপা-টপা এসব করে শরীরকে কষ্ট দেওয়া কেন’? এর উত্তরে মা সারদা বলেন যে, এসব করা লোকের জন্য। না হলে, লোকে বলবে, কই সাধারণের মতন খায়, দায় আছে। আর পঞ্চতপা-টপা হল মেয়েলি ব্রত, যেমন সব করে না? পার্বতীও এই ব্রত শিবের জন্য করেছিলেন’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content