শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।
সারদা মা যেন স্বয়ং মালক্ষ্মী। লক্ষ্মী যেমন সদা নারায়ণের পদসেবারতা, শ্রীমাও তেমনি ঠাকুরের বিশ্রামের সময় তাঁর পদসেবা করছেন। কখনও বা রন্ধনকর্মে ব্যস্ত থেকেছেন। ঠাকুরের স্নানের আগে তাঁকে তেল মাখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা বুঝে যেটা রুচিকর ও পুষ্টিকর হবে, সেরকম খাবার তৈরি করেছেন। তাঁর মতো ঠাকুরের অবস্থা কেউই বুঝত না। ঠাকুরকে সন্তুষ্ট করার সামর্থ্য ছিল তাঁর। প্রচলিত সংস্কার অনুযায়ি একবার তিনি তিনদিন ঠাকুরের জন্য রান্না করেননি। অন্যলোকের হাতে খাবার খেয়ে ঠাকুর অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
তিনি পরে সারদার কাছে এই মেয়েলি সংস্কারের জন্য অনুযোগ করেন। তিনি বলেন, শরীরের রক্ত, মাংস, হাড়, এসব কিছু অশুদ্ধ নয়। মনের মধ্যে বিকার না থাকলে মেয়েদের এই শারীরিক অবস্থায়ও সব কাজ করা যায়। সেই থেকে সারদা ওই তিনদিনও ঠাকুরের জন্য রান্না করে দিতেন। ঠাকুরও খাবার খেয়ে হাসতে হাসতে শ্রীমাকে রসিকতা করে বলতেন, ‘দেখতো, তোমার রান্না খেয়ে আমার শরীর কেমন ভাল আছে’।
তিনি পরে সারদার কাছে এই মেয়েলি সংস্কারের জন্য অনুযোগ করেন। তিনি বলেন, শরীরের রক্ত, মাংস, হাড়, এসব কিছু অশুদ্ধ নয়। মনের মধ্যে বিকার না থাকলে মেয়েদের এই শারীরিক অবস্থায়ও সব কাজ করা যায়। সেই থেকে সারদা ওই তিনদিনও ঠাকুরের জন্য রান্না করে দিতেন। ঠাকুরও খাবার খেয়ে হাসতে হাসতে শ্রীমাকে রসিকতা করে বলতেন, ‘দেখতো, তোমার রান্না খেয়ে আমার শরীর কেমন ভাল আছে’।
ক্রমে শ্রীমাকে ছাড়া ঠাকুরের অসুবিধে হত। শ্রীমা তাঁর ভাসুরপোর বিয়ের জন্য কিছু দিন জয়রামবাটিতে গিয়ে থাকেন। তখন ঠাকুরের খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তীব্র হওয়ায় তিনি চিঠি লিখে সারদাকে দেশ থেকে ডেকে আনেন। ঠাকুর পাতে বেশি ভাত দেখলে ভয় পেতেন। তাই সারদা ভাত বেড়ে দু’হাত দিয়ে ভাত চেপে সরু করে দিতেন। ঠাকুরকে শিশুর মতো সর্বদা ভুলিয়ে শ্রীমা খাওয়াতেন এবং তাঁর খেয়াল রাখতেন, যা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ঠাকুরের জন্য রোজ গয়লা আধসের দুধ দিত। দুধ বিক্রি করে যে দুধ বাঁচত, তা পুরোটাই দিয়ে যেত। যেদিন আধসেরের বেশি দুধ হত, সেদিন সারদা সেটা ফুটিয়ে ঘন করে রাখতেন যাতে খাওয়ার সময় দুধের বাড়তি পরিমাণ ঠাকুর ধরতে না পারেন। নিকুঞ্জদেবীকে তিনি একবার বলেছিলেন যে, ঠাকুরের কাছে তখন একজন ব্রহ্মচারি থাকত, সে যদি ঠাকুরের কোনও ক্ষতি করে এই ভয়ে শ্রীমা তাকে দশ টাকা দিতে যান, সে যাতে খুশি হয়। সেটি টের পেয়ে ঠাকুর নহবতে এসে বলেন, ‘আমার মা আছে, কে মন্দ করবে’?
ঠাকুরের জন্য রোজ গয়লা আধসের দুধ দিত। দুধ বিক্রি করে যে দুধ বাঁচত, তা পুরোটাই দিয়ে যেত। যেদিন আধসেরের বেশি দুধ হত, সেদিন সারদা সেটা ফুটিয়ে ঘন করে রাখতেন যাতে খাওয়ার সময় দুধের বাড়তি পরিমাণ ঠাকুর ধরতে না পারেন। নিকুঞ্জদেবীকে তিনি একবার বলেছিলেন যে, ঠাকুরের কাছে তখন একজন ব্রহ্মচারি থাকত, সে যদি ঠাকুরের কোনও ক্ষতি করে এই ভয়ে শ্রীমা তাকে দশ টাকা দিতে যান, সে যাতে খুশি হয়। সেটি টের পেয়ে ঠাকুর নহবতে এসে বলেন, ‘আমার মা আছে, কে মন্দ করবে’?
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’
মাঝে মাঝে সারদার ইচ্ছা হত, ঠাকুরকে মালা গেঁথে পরাবার। একবার নহবতে তিনি সারাদিন ধরে মনের মতো মালা গেঁথে ঠাকুরকে বলে পাঠান যে, তাঁকে এই মালা পরতে হবে। ঠাকুর এলেন আর মালা শুধু পরলেনই না, গান ধরলেন, ‘ভূষণ বাকি কি আছে রে, জগচ্চন্দ্র হার পরেচি’। ঠাকুরের ভাইঝি লক্ষ্মীদেবী, শীতলার অংশে যাঁর জন্ম, তিনি সারদার সঙ্গে নহবতে কখনও বা থাকতেন। তিনি ব্রজগোপীর ভাবের ঘোরে মাঝে মধ্যে চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পদাবলি গেয়ে শোনাতেন।
শ্রীমা ব্রাহ্মমুহূর্তে রাত তিনটের সময় শৌচাদি সেরে গঙ্গাস্নান করে নহবতে সেই যে ঢুকতেন, আবার সন্ধ্যার পর বেরিয়ে শৌচাদি করতেন। বহুদিন এইভাবে চলার পর যোগীন-মা যখন আসেন, তখন তিনি অনুযোগ করেন যে, এইভাবে শ্রীমায়ের অসুখ হবে। তারপর, নহবতের কাছে সারদার শৌচাদির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সারদা নহবতের কাছে বকুলতলার ঘাটে স্নানে যেতেন। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তিনি এক বিশাল কুমীরের গায়ে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। পরে এই ঘটনার কথা তিনি বিভূতিবাবুকে বলেছিলেন। ‘অন্ধকার রাত্রি, বকুলতলার ঘাটে নামচি। একটা কালোপারা কি দেখলুম, মনে হল যেন জেলেদের হাঁড়ি। কাছে যেতেই হুস্ করে জলে নেমে গেল। আঁশটে আঁশটে গন্ধ। নহবতে ফিরে এলুম। অনেকক্ষণ ধরে বুক দুরদুর করতে লাগল’।
শ্রীমা ব্রাহ্মমুহূর্তে রাত তিনটের সময় শৌচাদি সেরে গঙ্গাস্নান করে নহবতে সেই যে ঢুকতেন, আবার সন্ধ্যার পর বেরিয়ে শৌচাদি করতেন। বহুদিন এইভাবে চলার পর যোগীন-মা যখন আসেন, তখন তিনি অনুযোগ করেন যে, এইভাবে শ্রীমায়ের অসুখ হবে। তারপর, নহবতের কাছে সারদার শৌচাদির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সারদা নহবতের কাছে বকুলতলার ঘাটে স্নানে যেতেন। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তিনি এক বিশাল কুমীরের গায়ে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। পরে এই ঘটনার কথা তিনি বিভূতিবাবুকে বলেছিলেন। ‘অন্ধকার রাত্রি, বকুলতলার ঘাটে নামচি। একটা কালোপারা কি দেখলুম, মনে হল যেন জেলেদের হাঁড়ি। কাছে যেতেই হুস্ করে জলে নেমে গেল। আঁশটে আঁশটে গন্ধ। নহবতে ফিরে এলুম। অনেকক্ষণ ধরে বুক দুরদুর করতে লাগল’।
আশুতোষ মিত্রকে বলেন, স্নান করার সময় হঠাৎ করে এক আতঙ্ক এসে উপস্থিত হয় আর সঙ্গে সঙ্গে নহবত থেকে ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত একটি আলো দেখতে পান, সেই থেকে স্নানের সময় ঐ আলো আপনি এসে উপস্থিত হত।
একবার ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে পঞ্চাশ থেকে ষাট জনের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সব খাবারই শ্রীমা নহবতে তৈরি করেন। তাই নয়, মেয়ে ভক্তরা নহবতেই খেয়েছিলেন। রাতে যোগীন-মা ঠাকুরের কাছে গেলে ঠাকুর বলেন যে, এত রাতে তারা শোবে কোথায়? শোবার জায়গাই বা কোথায়? তিনি তাঁর ঘরের পাশে ঘেরা বারান্দায় শুতে বললেন। ঠাকুরের প্রস্তাব সারদাকে জানাতে এসে যোগীন-মা দেখেন যে, ততক্ষণে নহবতের ঘর পরিষ্কার করে শোবার জায়গা করা হয়ে গিয়েছে।
একবার ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে পঞ্চাশ থেকে ষাট জনের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সব খাবারই শ্রীমা নহবতে তৈরি করেন। তাই নয়, মেয়ে ভক্তরা নহবতেই খেয়েছিলেন। রাতে যোগীন-মা ঠাকুরের কাছে গেলে ঠাকুর বলেন যে, এত রাতে তারা শোবে কোথায়? শোবার জায়গাই বা কোথায়? তিনি তাঁর ঘরের পাশে ঘেরা বারান্দায় শুতে বললেন। ঠাকুরের প্রস্তাব সারদাকে জানাতে এসে যোগীন-মা দেখেন যে, ততক্ষণে নহবতের ঘর পরিষ্কার করে শোবার জায়গা করা হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?
এই বিষয়ে শরৎ মহারাজ আভাস দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে শ্রীমা অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সমস্ত কাজ করতে পারতেন। ঠাকুর সারদার স্বাচ্ছন্দ সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন না, মাঝে মাঝে তাঁকে পাড়ায় বেরিয়ে আসতে বলতেন। দুপুরে আহারের পর পঞ্চবটি যখন নিরিবিলি থাকত শ্রীমা ঠাকুরের উপস্থিতিতে খিড়কি দ্বার দিয়ে বেরিয়ে কাছের গিন্নীদের বাসায় যেতেন। ছোট ঘরে দীর্ঘদিন থাকার ফলে সারদার বাতের ব্যথার সূত্রপাত হয়, যা তাঁকে আজীবন কষ্ট দিয়েছে। মাকালীর পাচক বাঁকুড়ার ঈশ্বর চাটুজ্যে সারদাকে নিজের মেয়ের মতন দেখতেন। ঠাকুর তাকে কলাইর ডাল হিং দিয়ে রেঁধে ও ভালো ভালো পদ করে শ্রীমাকে খাওয়াতে বলতেন। শ্রীমাকে দুই ছড়া তাবিজ, সোনার বালা ঠাকুর গড়িয়ে দিয়েছেন।
সীতাদেবীকে যখন ঠাকুর দর্শন করেন, তখন তাঁর হাতে যেমন ডায়মনকাটা বালা দেখেছিলেন। তাঁর নির্দেশে শ্রীমার হাতে তেমন বালা করে দেওয়া হয়। যোগীন-মা বলেছেন, শ্রীমা তখন দক্ষিণেশ্বরে সীতাঠাকুরণের মতন থাকতেন। তাঁর পরণে কস্তাপেড়ে শাড়ি, সিঁথিতে সিঁদূর, মাথাভর্তি চুল পা পর্যন্ত নেমেছে। গলায় সোনার কণ্ঠীহার, নাকে বড় নথ, কানে মাকড়ি, হাতে সেই চুড়ি যা মথুরবাবু ঠাকুরের মধুর ভাবসাধনের সময় গড়ে দেন। যোগীন-মার কথায়, তাঁকে দেখে, তাঁর কাছে থেকে বড় আনন্দ হত। ক্রমে ঠাকুরের ভক্তসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তিনি বিশ্রামের সময়ও পেতেন না। পানই তাঁকে কত সাজতে হত। তার মধ্যে যদি একটু ফাঁক পেতেন, ঠাকুর হয়ত একগোছা পাট এনে শিকে পাকিয়ে দিতে বলতেন, ভক্তদের জন্য লুচি,মিষ্টির হাঁড়ি রাখবেন বলে।
আরও পড়ুন:
চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-১: টি-হাউসের সামনের পাহাড়ের শৃঙ্গ-রা যেন রঙের উৎসবে মেতে উঠেছে
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৩: বাড়ির কাজের লোককে নিজের সম্পত্তির অধিকার দিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ দলিল পাল্টেছিলেন
রাতে ভক্তদের খাবার জন্য শ্রীমাকে তিন-সাড়ে তিন সের আটা মাখতে হত। পরে ঠাকুর তাঁকে সাহায্য করার জন্য সেবকের ব্যবস্থা করে দেন। একবার পঞ্চবটীতে বসে লাটু মহারাজ ধ্যান করছিলেন, ঠাকুর ওই দিক দিয়ে যেতে যেতে দেখে বলেন, ‘কার ধ্যান করছিস রে লেটো? যার ধ্যান করছিস, তার গাড়ুতে যে জল নেই রে লেটো’। একথা শুনে লাটু মহারাজ উঠে দাঁড়াতেই ঠাকুর বলে ওঠেন যে, ওই নহবতে সাক্ষাৎ ভগবতী আছেন, তাঁর রুটি বেলে দিতে। এরূপে দিনরাত নিশ্বাস ফেলার অবসর না পেলেও শ্রীমার মনে নিরানন্দভাব দেখা যায়নি। মূর্তিমতী আনন্দস্বরূপা তিনি ঠাকুরের দিব্য সান্নিধ্যে সর্বদা উন্মুখ থাকতেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।