বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

আধ্যাত্মিক জীবন, শুধু খাদ্য-পানীয়ের নিরিখে বিচার যোগ্য নয়। তার থেকেও অধিকতর বড় বিষয় হল মানসিক শুদ্ধতা। সাধকের ক্ষেত্রে, অনেক সময় সাধন অপেক্ষা এ বিচার অধিকতর অর্থবহ হয়ে পড়ে যে কী গ্রহণযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়, তা সাধন পথে একপ্রকার বিঘ্ন।

শ্রবণ, মনন ও নিধিধ্যাসন বা ঈশ্বর প্রণিধান যে সাধন, তা অবহেলিত হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ভক্তিলাভই আসল। এ হেন সময় মাস্টার মহাশয়ের অতুলনীয় বিচার খুব প্রণিধানযোগ্য। মণি ঠাকুরকে বলছেন, ‘আপনি কি উপবাস নিয়ে অন্য খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে কঠোর হতে বলেন না, যিশুখ্রিষ্টও বলেছিলেন, ওরা খাবে খুব করে; যতদিন বর সঙ্গে আছে, বরযাত্রীরা আনন্দই করবে।’
মণি ঠাকুরের কথা আর আর যিশুখ্রিষ্ট বাণী তুলনা করে বোঝাতে লাগলেন। বালক ভক্তদের ভিতর কামিনী কাঞ্চন ঢোকেনি, তারা তত্ত্ব উপদেশ ধারণাও করতে পারবে, আর পালনও করতে পারবে। নতুন হাঁড়িতে দুধ রাখার মতো। যিশুখ্রিষ্ট বলেছেন, ‘পুরানো বোতলে নতুন মদ রাখলে বোতল ফেটে যেতে পারে, আর পুরানো কাপড়ে নতুন তালি দিলে শীঘ্রই ছিঁড়ে যায়।’ (কথামৃত পৃঃ ৯০৪)

এর অর্থ এই যে, কামিনী কাঞ্চনে আসক্তিশূণ্যরা তত্ত্বজ্ঞান লাভ ও ধারণার ক্ষেত্রে শীঘ্রই সফলতা পায়। শুদ্ধ মনে ঈশ্বরের উপলব্ধি সহজে হতে পারে। ঠাকুর যেমন বলেন—মা এবং তিনি এক। তেমন যিশু বলেন, তিনি ঈশ্বরের (পিতার) সন্তান। তাঁরা এক। মণি আরও বলছেন—ঠাকুর বলেন ব্যাকুল হয়ে ডাকলে ঈশ্বর শুনবেনই শুনবেন। সেই রকম যিশুও বলেছেন, ব্যাকুল হয়ে দোরে ঘা মারো দোর খুলে যাবে। (knock and it shall be opened unto you.)
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬৮: অমৃতের সন্ধানে মাস্টারমশাই /৪

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া

শ্রীঠাকুর নিজের অবস্থাটি ও তাঁর শরীরধারণের কারণটি মণির চোখের সামনে প্রকাশ করেন। মণির ভাবাকাশে তা কীভাবে প্রতীয়মান হয়, তা মণিও সময় সময়ে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্বের রূপক-তাৎপর্য তুলে ধরলেও তার গুরুত্ব ও ব্যাপকত্ব মাস্টার মহাশয় প্রকাশ করেন এবং তাঁর স্বরূপটি যাচাই করে দেখেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তা জেনে সন্তুষ্ট হন। তিনি মাস্টারকে বলছেন, তাকে কেউ কেউ পূর্ণ অবতার বলে; তবে মাস্টারমশাই যদি অবতার বলে থাকেন, তবে তিনি কি বলবেন, তা পূর্ণ, না অংশ, না কলা?

মাস্টার মহাশয়ের ভাবআকাশে প্রতিভাত হল পূর্ব পূর্ব অবতারদের সাথে শ্রীরামকৃষ্ণের সাদৃশ্য। তাঁর গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে ভগবানের পরিচয়। বলছেন, ‘আমার বোধহয় তিনজনেই এক বস্তু। যিশুখ্রিষ্ট, চৈতন্যদেব আর আপনি এক ব্যক্তি।’ পরক্ষণেই শ্রীঠাকুর সেই মন্তব্যে সম্মতি জানিয়ে বলছেন, এক, এক, বইকি! তিনি (ঈশ্বর), …দেখছ না,…যেন এর উপর এমন করে রয়েছে। (কথামৃত পৃঃ ৮৮৭) ঠাকুর অনেকবার এই রকম নিজের স্বরূপ উদঘাটন করেছেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?

ক্রমাগত আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন যাতে সন্দেহের অবকাশ না থাকে। আরেকটি দেখার বিষয় যে, তিনি একবারও ‘আমি’ বলছেন না। নিজের শরীরের প্রতি অঙ্গুলির নির্দেশ করছেন, যেন এটাই বোঝাতে চান ঈশ্বর, তারই শরীর ধারণ করে এ বার অবতীর্ণ হয়েছেন। মাস্টারমশায়ের শ্রেষ্ঠ উপলব্ধি বলছেন, ‘আজ্ঞে পূর্ণ, অংশ, কলা ওসব বুঝি না, তবে যেমন বলেছিলেন ওটা বেশ বুঝেছি। যেন দিগ্ দিগন্তব্যাপী মাঠ পড়ে রয়েছে। ধু-ধু করছে। সম্মুখে পাঁচিল রয়েছে বলে আমি দেখতে পাচ্ছি না, … সেই পাঁচিলে কেবল একটি গোল ফাঁক। আর সে ফাঁকটি আপনি। আপনার ভিতর দিয়ে সব দেখা যায়, সেই দিগ্-দিগন্তব্যাপী মাঠও দেখা যায়।’ (কথামৃত পৃঃ ৮৮৮)

প্রসন্ন চিত্তে অন্য এক স্থানে বলছেন, “দুই তিন ক্রোশ একেবারে দেখা যায়। যেমন সূর্যের দিকে তাকানো যায় না, কিন্তু তার জলে পড়া প্রতিবিম্বের দিকে বেশ তাকানো যায়। অবতারের সঙ্গে ভক্তের আহ্লাদ চলে। যেমন মাছেরা জলে পড়া চাঁদের প্রতিচ্ছায়ার সাথে খেলা করে।” তিনি অনন্ত, তাঁকে সাধারণের বোঝা বা উপলব্ধি করা অসাধ্য। তিনি আসেন নাম রূপ ধরে ভক্তের কল্যাণে। অবতারের মধ্য দিয়ে তাঁকে সহজে উপলব্ধি করা যায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

ঈশানের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের মিলনে, বার বারই ঈশানকে তান্ত্রিক মতে, আগম নিগম পথে সাধনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। বলছেন, তা শুধু মুখে বললে হবে না, ধারণা করতে হবে সাধনার দ্বারা। চিত্তশুদ্ধি হলেই তা ধারণা হয়, তিনিই কর্তা, তিনি মন,প্রাণ, বুদ্ধির উপায়। তিনি চৈতন্যরূপেও সবার মধ্যে অবস্থান করছেন। যে তাঁকে জানতে যাবে তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যাবে। তাঁকে দর্শন করা হলে সব সমস্যা মিটে যায়। সংশয়, দ্বন্দ্ব না থাকলে এটাই অনুভূত হয় যে, তিনি বিভু রূপে সর্বত্র প্রকাশিত থাকেন। যেমন সমুদ্রের কাছে গেলে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ পাওয়া যায়। সেই রকম যারা শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে থেকেছেন, তারা সর্বদায়, অন্তর্মুখী, কালী নামে বিভোর শ্রীরামকৃষ্ণকে বোঝার ও জানার চেষ্টা করেছেন। নরেন্দ্র, রাখাল, অধর, হাজরা, মাস্টার প্রত্যেকেই শুধু শুনেছেন, রয়েছেন তা নয় বরং তাঁকে সর্বস্তরে বোঝার এবং জানার চেষ্টা করেছেন। যখনই সুযোগ হয়েছে আধ্যাত্মিকতার অতলান্তহীন মানুষটিকে বোধগম্য করার চেষ্টা করেছেন। ‘তদ্ দূরে তদ্ বদ্ অন্তিকে’। তিনি দূরে আবার অতি নিকটে। তিনি ‘গূঢ়ম্’ অর্থাৎ তাঁকে সহজে অনুভূত করা যায় না।
আরও পড়ুন:

সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

শ্রীরামকৃষ্ণ মাতৃভাবে মাতোয়ারা আবার নির্বিকল্প সমাধি-সুখে নিমগ্ন। উপনিষদে ব্রহ্মতত্ত্ব ব্যাখ্যায় এমনটি দেখা যায়। ‘আপনি সরল আবার গভীর, আপনাকে বোঝা বড় কঠিন।’ হিমশৈলের অধিকাংশই যেমন সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত থাকে, যেমন তাকে উপর থেকে ধারণা করা যায় না, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণ, বেশ ধারণ করে আছেন রাজার রাজ্য পরিদর্শন করার মতো। তিনি তাঁর প্রকাশকে ঢেকে সর্বদাই লোককল্যাণ হেতু বিচরণ করতেন। তাঁর প্রতি সকলের চিন্তা ঈশ্বরকেন্দ্রিক এবং তিনি স্বয়ং সর্বভাবের আধাররূপে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকেন এবং জীব কল্যাণে অন্তহীন অমৃত বিতরণ করেন।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content