শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


পুরোনো হাওড়া রেলস্টেশন। ছবি: সংগৃহীত

হঠাৎ দেখা

ভাগ্য ভালো দু’পা এগোতেই ‘চায়ে-চা’! মাথায় লাল সালু মোড়া চুবড়িতে মাটির ভাঁড় আর হাতে রাক্ষুসে কেটলি নিয়ে চা-ওলা হাজির। চা খেয়ে ধীরে-সুস্থে মাকে নিয়ে রেলের কামরায় যেতে কোনও অসুবিধে হল না—ভাগ্য ভালো জানলার ধারে সিট—কিন্তু রেল যেদিকে যাবে তার উলটো মুখে বসা। চোখে রেল-পথের ধুলো লাগার ভয় কম। সুটকেস বেডিং সিটের তলায় ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া গেল। তারাপদবাবু বলে দিয়েছিলেন তাই মালপত্তরে চেন লাগিয়ে তালা মেরে দেওয়া হল।

চিঠি পাওয়ার চার দিনের মধ্যেই কাশী রওনা দেওয়া গেল। পিটারসন সাহেবের নির্দেশে তারাপদবাবু কাশীর রামপুরা লাক্সা রোড, সিধগিরিবাগে মঠের ঠিকানায় একটা টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে দিয়েছেন।
Swami Nikhilananda Maharaaj Ramkrishna Math Varanasi

Received letter. Now at Kolkata. Will reach soon with mother.

– Binoy Kanti Dutta , 12/ C Telipara Lane, Shyambazar Kolkata

ঠিক দশটা ইংরেজি শব্দে তারাপদবাবু সবটুকু লিখে দিয়েছেন। বিনয়রা এখন কলকাতায়। চিঠি পেয়েছে। সত্বর মাকে নিয়ে রওনা দেবার ব্যবস্থা হয়েছে—সবটুকু। এমনকী মহারাজের কাছে বিনয়দের বর্তমান ঠিকানাটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে মেসেজ নিশ্চয় আগেই পৌঁছে যাবে। অসুস্থ মানুষটাকে তো এটা জানিয়ে শান্তি দেওয়া যাবে যে তাঁর পরিবারের লোকজন তাঁর খবরাখবর পেয়েছে।

এ পর্যন্ত লিখে সুবর্ণকান্তির মনে হল—শ্যামবাজারের পিনকোড তো ৭০০০০৪৷ কিন্তু পিনকোড তো তখন চালু হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় প্রশ্ন এল তবে কবে চালু হয়েছে? গুগুল বলল, ১৯৭২-এর ১৫ অগস্ট। শ্রীরাম ভিকাজি নামের মিনিস্ট্রি অফ কমিউনিকেশন-এর একজন অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি আমেরিকার জিপকোড বা ইউরোপের পোস্টকোডের ধাঁচে আমাদের দেশে পোস্টাল ইন্ডেক্স নাম্বার বা পিনকোড চালু করেছিলেন।

বগি শুরুর দরজাটার তিনটে জানালা পরে বিনয়দের বসার জায়গা—ওঠানামার সুবিধা হবে এটা ভেবে বিনয় বেশ নিশ্চিন্ত৷ রেল ছাড়ার আর মাত্র মিনিট দুয়েক বাকি।

প্রবীণ তারাপদ পাল বিনয়কে তার একটা পুরনো রিস্টওয়াচ উপহার দিয়েছেন। বিনয়ের নিতে খুব অস্বস্তি হয়েছিল৷ তারাপদবাবু বলেছিলেন—

—এটা নিতে তোমার যত কুণ্ঠা। তার চেয়ে বেশি কুণ্ঠা আমার এই পুরনো জিনিসটা তোমায় দিতে। পারলে আমি তোমায় একটা নতুন ঘড়িই কিনে দিতুম। আসলে এটা আমার বাবার রিস্ট ওয়াচ। পুরনো আমলের সাহেব কোম্পানির ঘড়ি। রাধাবাজারের গলিতে ঘড়িটা দেখিয়ে অয়েলিং করে নিয়েছি—পিটারসন সাহেব বলেছে—আমিও বিশ্বাস করি তুমি একদিন অনেক আগে এগিয়ে যাবে। সেদিন আমি হয়তো থাকব না—কিন্তু আমার বাবার এই পুরনো ঘড়িটা হয়তো চলবে। এটা তখন তোমায় আমার কথা মনে করিয়ে দেবে বিনয়।

সেদিন তারাপদবাবুর শীর্ণ হাত দুখানা ধরে যুবক বিনয়কান্তি দেখেছিল তারাপদবাবুর মোটা ঘোলাটে চশমার কাচের ওপারে চোখ দুখানা জলে ভরে গেছে। মাত্র কদিনের চেনা কারও প্রতি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের মনের এই যে নির্ভেজাল আবেগ। তাঁর হৃদয়ের স্পর্শমাখা স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থহীন স্নেহ। মানুষের প্রতি মানুষের এই ভালোবাসার যে পরম্পরা—সেই ট্রাডিশনকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিলেন বিকেডি—বাঁচতে চেয়েছিলেন বিনয়কান্তি দত্ত। আজীবন!! পেরেছিলেন কি? সে প্রশ্নের জবাব আছে উত্তরকালের কাছে।

কিন্তু এই মুহূর্তে মনের মধ্যে নানান উৎকণ্ঠা। বিনয় দেরি করে ফেলল না তো? সঙ্গে সঙ্গে যাওয়াই কি উচিত ছিল না? কিন্তু এতটা পথ যাওয়া, রেলের টিকিট, টাকাপয়সার জোগাড়…. চারটে দিন তো মাত্র। আর কোম্পানির দিকটাও তো…। মা অবশ্য এ নিয়ে বিনয়কে কিছুই বলেনি। বিনয় মা’র দিকে তাকায়। মা’র মুখে আশঙ্কার মেঘ ছেয়ে আছে। বিনয়ও তো সেই একই দুর্ভাবনায় সিঁটিয়ে আছে…. যদি গিয়ে শোনে তারা দেরি করে ফেলেছে?

ল্যাপটপের কিবোর্ডে ‘কন্ট্রোল-এস’ টিপে লেখাটা সেভ করলেন সুবর্ণকান্তি। অটোসেভ আছে—কিন্তু মানুষের মতো যন্ত্রের ওপরেও বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে।

রেল যেন নড়ে উঠল—বসুন্ধরা হাসিমুখে ইঙ্গিত করল—এবার ছাড়ল!! জানলার বাইরের দিকে নজর গেল বিনয়ের।

প্ল্যাটফর্মে একটা ব্যস্ততা নজরে পড়ল। সকলেই প্ল্যাটফর্ম-এর শুরুতে অর্থাৎ স্টেশনের দিকে উদগ্রীবভাবে তাকিয়ে। তবে কি কেউ শেষ মুহূর্তে রেল ধরতে দৌড়ে আসছে। হঠাৎ বিনয়ের খেয়াল পড়ে সে আর মা ছাড়া তাদের চৌখুপিতে আর কোনও যাত্রী নেই। মনে হল তবে কি তাদের সহযাত্রীরাই শেষ মুহূর্তে দৌড়ে আসছে? তবে তো তাদের সাহায্য করার জন্য তার কামরার দরজায় গিয়ে দাঁড়ানো উচিত।

—আমি একটু আসছি মা। মনে হয় এই সিটে যাঁরা বসবেন তাঁরাই শেষ মুহূর্তে স্টেশনে পৌঁছে, দৌড়ে আসছে রেল ধরতে। আমি দরজাতেই থাকছি যদি ওদের কোনও সাহায্য লাগে।

বসুন্ধরা ছেলেকে চেনেন তিনি জানেন ছেলের এই উপকারী স্বভাবের কথা তাই ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। বিনয় ছুটে গেল তাদের সিটের কাছাকাছি বগির প্রথম দরজার দিকে। মুখ বাড়িয়ে দেখল সে যা ভেবেছিল তাই৷ বছর পঞ্চাশের একজন ভদ্রলোক সঙ্গে তাঁর স্ত্রী পিছনে সম্ভবত তাঁদের মেয়ে ছুটে আসছে আর মালপত্র নিয়ে টাল খেতে খেতে আসছে তাঁদের কুলি। রেল তখনও ছাড়েনি কিন্তু টানা বাঁশি বাজিয়ে ছাড়বার উপক্রম। তাঁরা বিনয়ের বগির দিকেই ছুটে আসছে৷ বেশ কাছাকাছি তাঁরা। বয়স্ক মানুষ তাই হাঁপিয়ে পড়েছেন। বিনয় কামরা থেকে নেমে দাঁড়ায়। রেলের গার্ড সাহেব নিশ্চয়ই ছুটে আসা এই পরিবারকে দেখতে পেয়ে সবুজ বাতি দেখাতে কয়েক মুহূর্ত দেরি করছেন। ভদ্রলোক ঘেমেনেয়ে গেছেন— আর দম নিতে পারছেন না—তাঁর স্ত্রী তুলনায় ঠিক আছেন। বিনয় চেঁচিয়ে বলে—

—এই বগি তো?

মাঝবয়সি ভদ্রলোকের হ্যাঁ বলার ক্ষমতাটুকুও নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে কোনওক্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দেখালেন।

— রেল ছাড়েনি, আপনারা উঠুন মাল আমি তুলছি।

বিনয় ভদ্রলোককে কামরায় তুলে দিল—

—এগিয়ে যান তিন নম্বর জানালার সামনে বোধহয় আপনাদের সিট৷

ভদ্রমহিলা উঠতে গিয়ে থমকে মেয়ের দিকে তাকান—

—আয় সোনা মা দৌড়ে আয়।

এবার রেল নড়ে ওঠে। ভদ্রমহিলা উৎকণ্ঠায় চিৎকার করে ওঠেন—

—ওমা কী হবে? রেল যে ছেড়ে দিল। সোনা মা আয় তাড়াতাড়ি! বাবা উঠে গেছে৷

বিনয় জোর দিয়ে বলে—

—আগে আপনি উঠুন। উনি ঠিক দৌড়ে উঠতে পারবেন। আমি সাহায্য করছি—গেটের কাছটা খালি করুন—

রেল ধীরে ধীরে চলা শুরু করে। ভদ্রমহিলা কামরায় উঠে কান্নাকাটি শুরু করেন। বিনয় ছুটে আসা মেয়েটিকে বলে—

—আপনি রেলের সঙ্গে সঙ্গে একটু দৌড়ে উঠুন সুবিধে হবে—শাড়ি সামলে—ভয় পাবেন না। আমি পিছনে আছি—বগির পাদানিতে পা দেবার আগে—দরজার পাশে ওই হাতলটা ধরুন। ধরুন। এবার পা-টা দিন। ভয় পাবেন না আমি আছি। শাড়িটা সামলে—

বিনয় মেয়েটির গায়ে হাত দিতে চাইছিল না, যদি তিনি অসম্মানিত বোধ করেন৷ কিন্তু সে পিছনে হাত রেখে সঙ্গেসঙ্গে দৌড়চ্ছিল। মেয়েটি রেলকামরায় উঠে গেল৷

—আপনারা ভিতরে গিয়ে বসুন৷ চিন্তা করবেন না, মাল নিয়ে আমি আসছি। গেটের সামনেটা খালি রাখুন, না হলে মাল তুলতে পারব না।

বিনয়ের কথা শুনে মা ও মেয়ে বগির ভিতরে গেল। বিনয় লাফ দিয়ে কামরায় উঠল।

—এক এক কর্কে সামান দো!!

তিন জনের পাঁচটা মাল, দুটো সুটকেস। একটা বড় একটা মাঝারি। একটা বড় হোল্ডল। একটা ঢাকা দেওয়া হাতলওলা বেতের বাক্স ব্যাগ। আর একটা ছোট চেনওয়ালা কিট ব্যাগ। মালপত্র ওঠানোর পর কুলি সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে। নিশ্চয়ই ওর পাওনা বাকি আছে।

—কিতনা পয়সা?

কুলি উত্তর দেওয়ার আগেই পিছন থেকে সেই মেয়েটি বলে উঠল—

—এই যে—এই টাকাটা—ওকে দিয়ে দিন।

এই প্রথম বিনয় ও মেয়েটি পরস্পরকে মুখোমুখি একঝলক দেখল। বিনয় টাকাটা নিয়ে কুলিকে দিল। রেল তখন বেশ জোরেই এগোচ্ছে—প্ল্যাটফর্মের কুলি দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে। বিনয় দরজা থেকে মুখ ফেরাল।

—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

—আরে না না। এজন্য কেন ধন্যবাদ দিচ্ছেন।

এই কথোপকথনের মধ্যেই মেয়েটির মায়ের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর কানে এল।

—ও সোনা মা তোর বাবার শরীরটা খারাপ করছে।—চলবে

আশঙ্কার মেঘ। ছবি: সত্রাগ্নি

পরের পর্ব আগামী রবিবার
জসিডি ছাড়িয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে—গতি আরও বেড়েছে। মা শুয়ে ঘুমোচ্ছে— স্বর্ণময়ীদের সিটে এখনও কোনও নতুন যাত্রী আসেনি। জানালার পাশে যেখানে স্বর্ণময়ী বসেছিল—সেখানেই বসে আছে বিনয়কান্তি। জায়গাটায় একটা হালকা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছে নাকি এটা বিনয়ের মনের ভুল। স্বর্ণময়ী হাতের লেখা ঠিকানাটা একবার খুলে দেখল। আবার ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content