বুধবার ২৬ মার্চ, ২০২৫


স্বপ্নলব্ধ গল্প ‘বালক’-এ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত একে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক উপাদানে পুষ্ট করতে মহারাজা বীরচন্দ্রের কাছে পত্র দিয়েছিলেন। তিনি রাজাকে লেখেন—”…মহারাজ বোধ করি শুনিয়া থাকিবেন যে, আমি ত্রিপুরা রাজবংশের ইতিহাস অবলম্বন করিয়া ‘রাজর্ষি’ নামক একটি উপন্যাস লিখিতেছি। কিন্তু তাহাতে ইতিহাস রক্ষা করিতে পারি নাই। তাহার কারণ, ইতিহাস পাই নাই। এ জন্য আপনাদের কাছে মার্জনা প্রার্থনা বিহিত বিবেচনা করিতেছি। এখন যদিও অনেক বিলম্ব হইয়াছে,তথাপি মহারাজ যদি গোবিন্দ মাণিক্য ও তাহার ভ্রাতার রাজত্ব সময়ের সবিশেষ ইতিহাস আমাকে প্রেরণ করিতে অনুমতি করেন,তবে আমি যথাসাধ্য পরিবর্তন করিতে চেষ্টা করিব।
মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য তাঁহার নির্বাসন দশায় চট্টগ্রামের কোন স্হানে কি রূপ অবস্থায় ছিলেন যদি জানিতে পারি, তবে আমার যথেষ্ট সাহায্য হয়। প্রাচীন রাজধানী উদয়পুরের এবং ঐতিহাসিক ত্রিপুরার অন্যান্য স্থানের ফটোগ্রাফ যদি পাওয়া সম্ভব হয় তাহা হইলেও আমার উপকার হয়।…” এই পত্র থেকে এটা সহজেই ধারণা করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বপ্নলব্ধ মানবিক মূল্যবোধের গল্পটিকে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের রূপ দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তিনি গোবিন্দ মাণিক্যের রাজত্বকালীন বিবরণ, প্রাচীন রাজধানীর ফটোগ্রাফ ইত্যাদি মহারাজ বীরচন্দ্রের কাছে চেয়েছিলেন। বীরচন্দ্র এর উত্তরে কবিকে লিখেছিলেন—’মুকুট’ ও ‘রাজর্ষি’ নামক দুইটি প্রবন্ধই আমি পাঠ করিয়া দেখিয়াছি। ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বন্ধ যে যে স্খলন হইয়াছে ,তাহা সংশোধন করা আপনার বিশেষ কষ্টসাধ্য হইবে না।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৮: আজও সকলের হৃদয়ে ‘রাজর্ষি’র গোবিন্দ মাণিক্যই উজ্জ্বল

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭১: ধর্মকার্যের জন্য টাকা জোগাড় করা আর সাদা কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে ধোয়া, দুই-ই সমান

… রাজরত্নাকরে গোবিন্দ মাণিক্যের ও তাঁহার ভ্রাতা ছত্র মাণিক্যের চরিত যে রূপ বর্ণিত আছে, তাহা নকল করান হইয়াছে,সত্বর ছাপান যাইতে পারে কিনা উদ্যোগ করিতেছি; মুদ্রাঙ্কন শেষ হইলেই আপনার নিকট পাঠান যাইবে। ‘রাজর্ষি’র কোন কোন স্হলে ইতিহাস রক্ষিত হয় নাই, তাহা রাজ রত্নাকরে উক্ত উদ্ধৃত ভাগ দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন।…”
রবীন্দ্রনাথের পত্র পাবার আগেই বীরচন্দ্র ‘মুকুট’ ও ‘রাজর্ষি’ পড়ে ফেলেছিলেন বলে তাঁর পত্র সূত্রে জানা যায়। ইতিহাস-আশ্রিত গল্প ‘মুকুট’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন’রাজর্ষি’র আগে। পরবর্তী সময়ে তিনি তার নাট্যরূপ দেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০২: অন্ধকারে কে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১১: মৃণালিনীর মৃত্যুর পর বিবাহ-প্রস্তাবের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ

১২৯২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ ও জৈষ্ঠ-এই দুই সংখ্যার ‘বালক’-এ ‘মুকুট’ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। সে বছরের আষাঢ় সংখ্যা থেকে অর্থাৎ ‘বালক’-এর প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যা থেকে শুরু হয় ‘রাজর্ষি’র প্রকাশ। মাঘ, ১২৯২ পর্যন্ত এর ২৬টি অধ্যায় প্রকাশিত হয়। মহারাজা অমর মাণিক্যের রাজত্বকাল হচ্ছে ‘মুকুট’-এর পটভূমি। অমর মাণিক্য রাজত্ব করেছিলেন ‘রাজর্ষি’র গোবিন্দ মাণিক্যের অনেক কাল আগে। তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হয়, ত্রিপুরার ঐতিহাসিক উপাদান রবীন্দ্রনাথ আগেই কিছুটা পেয়ে গিয়েছিলেন। অন্তত অমর মাণিক্য, মগদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ, মুকুট নিয়ে তাঁর পুত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-এ সব কবির জানা হয়ে গিয়েছিল আগেই।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৭: সুন্দরবনের পাখি — ফিঙে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’

ঠাকুরবাড়ির কিশোরদের জন্য মাসিক ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল। মুখ্যত বাড়ির ছেলেমেয়েদের লেখালেখির জন্যই সেদিন এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু শুধু তাদের লেখার উপর নির্ভর করে তো আর পত্রিকা চলবে না! তাই দায়িত্ব অর্পিত হয় রবীন্দ্রনাথের উপর। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন—”পাঠকদের কাছে মাসিক পত্রের প্রধান আকর্ষণ হইতেছে গল্প ও উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথকে মাসিকের সেই চাহিদা পূরণ করিতে হইল। প্রথমেই লিখিলেন নাতিদীর্ঘ গল্প ‘মুকুট’ ও তৎপরেই শুরু করিলেন ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রাজর্ষি’। উভয়েরই বিষয়বস্তু সংগৃহীত হইল ত্রিপুরা-রাজবংশের প্রাচীন কাহিনি হইতে। ত্রিপুরার ইতিহাস হইতেই দুইটি গল্পের আখ্যান ভাগ গ্রহণের কোনো কারণ আছে কি না, সে সম্বন্ধে অনুসন্ধান নিরর্থক নহে।…”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২

ইতিহাস আশ্রিত কোনও গল্প লেখা কিংবা ‘স্বপ্নলব্ধ’ কোনও গল্পকে ঐতিহাসিক উপাদানে পুষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার দিকে দৃষ্টি দিলেন কেন? ত্রিপুরা ছাড়া অন্যান্য অঞ্চল, এমন কী বঙ্গদেশের বর্ণাঢ্য ইতিহাসও তো তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত? হয়তো ‘ভগ্নহৃদয়’-এর জন্য তাঁকে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্রের অভিনন্দন কিংবা বীরচন্দ্রের পিতা কৃষ্ণকিশোরের সময় থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে এই রাজপরিবারের যোগাযোগ রবীন্দ্রনাথকে ত্রিপুরা সম্পর্কে প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সে জন্য ‘বালক’-এর গল্প রচনায় পটভূমি এসে যায় ত্রিপুরার ইতিহাস। ‘রাজর্ষি’কে ঐতিহাসিক উপাদানে পুষ্ট করতে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার দিকেই দৃষ্টি দেন। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content