ত্রিপুরা রাজভবন।
১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রিপুরায় মানিক সরকারের নেতৃত্বে শপথগ্রহণ করে চতুর্থ বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু শুরুতেই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এই সরকারকে। তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে রাজ্যে উগ্রবাদী তৎপরতা যে ভয়াবহ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, চতুর্থ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তা শুধু অব্যাহতই ছিল না, বরং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেতেই থাকে। তখন সরকারের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে। সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ অসহায় বোধ করতে থাকেন।
চতুর্থ বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে কমলপুর মহকুমায়। ১৯৯৮ সালের ৩১ মার্চ কমলপুরের আভাঙ্গা এলাকায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ত্রিপুরার তদানীন্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিংহ এবং তাঁর ছোট ভাই বিদ্যুৎ সিংহ। উগ্রবাদীদের হাতে কিছুদিন আগে অপহৃত তাদের অপর এক ভাই বিক্রম সিংহের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন বিমলবাবু। তখনই জঙ্গিদের গুলিতে ভাই বিদ্যুৎ-সহ তাঁর মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ত্রিপুরা-সহ সারা রাজ্যে। যেখানে রাজ্যের একজন মন্ত্রীর জীবনই বিপন্ন সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোন পর্যায়ে আছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে।
চতুর্থ বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে কমলপুর মহকুমায়। ১৯৯৮ সালের ৩১ মার্চ কমলপুরের আভাঙ্গা এলাকায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ত্রিপুরার তদানীন্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিংহ এবং তাঁর ছোট ভাই বিদ্যুৎ সিংহ। উগ্রবাদীদের হাতে কিছুদিন আগে অপহৃত তাদের অপর এক ভাই বিক্রম সিংহের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন বিমলবাবু। তখনই জঙ্গিদের গুলিতে ভাই বিদ্যুৎ-সহ তাঁর মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ত্রিপুরা-সহ সারা রাজ্যে। যেখানে রাজ্যের একজন মন্ত্রীর জীবনই বিপন্ন সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোন পর্যায়ে আছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে।
বিমলবাবু ছিলেন একজন জনপ্রিয় সিপিএম নেতা। ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি। মন্ত্রী হবার আগে বিমলবাবু রাজ্য বিধানসভার উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব ভার পালন করেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি একজন সুলেখক হিসেবেও তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। সন্ত্রাসবাদীদের হাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিহত হবার পর চতুর্থ বামফ্রন্ট সরকারের সামনে সর্বাধিক গুরুত্ব তথা অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াল সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এটা স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারেন যে, সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা প্রতিরোধ করে যদি রাজ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে না আনা যায় তবে জনকল্যাণে কোনও কর্মসূচীই রূপায়িত করা যাবে না। আগে রাজ্যে শান্তি, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে, পরে উন্নয়ন। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মুখ্যমন্ত্রী অগ্রসর হতে থাকেন।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৭: নৃপেনবাবুকে বহিষ্কার, ইতিহাসের করুণ পরিণতি
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা
সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলায় প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও উদ্যোগী হন তিনি। কেন উপজাতি যুবকদের একাংশ বন্দুকই শেষ কথা ভেবে জঙ্গলে চলে যাচ্ছে, কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যাবে সে সব নিয়ে শুরু হয় চিন্তা ভাবনা। মুখ্যমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদী সমস্যার ক্ষেত্রে ত্রিপুরার পাশাপাশি গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রসঙ্গই তুলে ধরেছিলেন বিভিন্ন সভা সমিতিতে। অর্থাৎ সমস্যাটি যে বিচ্ছিন্ন কোনও রাজ্যের সমস্যা নয়, গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলই এই সমস্যায় পীড়িত, সমাধানের পথও এই লক্ষ্যেই নিতে হবে-মুখ্যমন্ত্রী তা কেন্দ্রকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসবাদীরা যে বিদেশী শক্তির মদত পাচ্ছে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এ সবের পেছনে রয়েছে সে প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন তিনি। সেজন্য গুরুতর এই সমস্যার মোকাবেলায় কেন্দ্রকে সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক
সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার মোকাবেলায় নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি উগ্রবাদীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে উন্নয়নের কাজে সামিল হওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী আহ্বান জানাতে থাকেন। উন্নয়ন কর্মসূচি রূপায়ণে শান্তি সম্প্রীতির পরিবেশ অব্যাহত রাখতে বলেন তিনি। সে সময়ে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়টি ছিল, যে কোনও অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর তা আঘাত হানত। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার রাজ্যের সর্বত্র সভা-সমিতির মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের বিপদ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন এবং বিপথগামী উপজাতি যুবকদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানান। এমনকি সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করেন। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছু কিছু উগ্রবাদী আত্মসমর্পণও করে সে সময়। আবার বৈরি বিরোধী অভিযানে পুলিশ কিছু কিছু সাফল্যও পায়। এ সবের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় কিছুটা রাশ টানা সম্ভব হয়। আর তখনই রাজ্যে ব্যাপক হারে উন্নয়ন কাজও শুরু হয়।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনে ফের বামফ্রন্টের প্রত্যাবর্তন ঘটে। মানিক সরকারের নেতৃত্বে গঠিত হয় পঞ্চম বামফ্রন্ট সরকার। ধীরে ধীরে রাজ্যে উগ্রবাদীদের তৎপরতাও হ্রাস পেতে থাকে। আর তাতে গতি পায় উন্নয়ন কাজও। শুধু চতুর্থ আর পঞ্চমই নয়, মানিক সরকারের নেতৃত্বে ত্রিপুরায় গঠিত হয় ষষ্ঠ ও সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারও। ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একটানা ২০ বছর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব ভার সামলেছেন তিনি। এই সময়কালের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা উত্থান পতন ঘটলেও ত্রিপুরার রাজনৈতিক চিত্র স্হিতিশীল। এই রাজ্যে বজায় ছিল বাম আধিপত্য। এমনকি, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে বামফ্রন্টের পতন ঘটলেও ত্রিপুরায় তাদের প্রভাব যেন আরও বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে বামফ্রন্টের শোচনীয় পরাজয়ের পর ত্রিপুরাতে গেল গেল রব উঠেছিল। এমন ধারণা প্রচার লাভ করেছিল যে ত্রিপুরা থেকেও বামফ্রন্ট উৎখাত হবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ২০১৩ সালে সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ত্রিপুরায় বামফ্রন্টের দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটে।
যাইহোক, মানিক সরকারের দীর্ঘ দুই দশকের মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে ত্রিপুরার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ হয়েছে। বিশেষত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ পরিকাঠামো এবং উচ্চ শিক্ষা উন্নয়নে নানা কাজ হয়েছে। আগরতলায় রেল পৌঁছেছে, উন্নয়ন ঘটেছে বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থার। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে রূপায়িত হয়েছে পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্প।
ত্রিপুরায় একটানা পঁচিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটে ২০১৮ সালে। বামফ্রন্টকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করে ত্রিপুরার ক্ষমতায় আসে বিজেপি জোট। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বাম শাসনের পর ত্রিপুরায় বামদুর্গের পতন ঘটল কেন? আর কীভাবে ঘটল তা? —চলবে।
যাইহোক, মানিক সরকারের দীর্ঘ দুই দশকের মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে ত্রিপুরার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ হয়েছে। বিশেষত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ পরিকাঠামো এবং উচ্চ শিক্ষা উন্নয়নে নানা কাজ হয়েছে। আগরতলায় রেল পৌঁছেছে, উন্নয়ন ঘটেছে বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থার। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে রূপায়িত হয়েছে পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্প।
ত্রিপুরায় একটানা পঁচিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটে ২০১৮ সালে। বামফ্রন্টকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করে ত্রিপুরার ক্ষমতায় আসে বিজেপি জোট। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বাম শাসনের পর ত্রিপুরায় বামদুর্গের পতন ঘটল কেন? আর কীভাবে ঘটল তা? —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।