রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


মাজুলির অন্যতম শিল্প মুখোশ।

শিল্পকলা একটি জাতি কিংবা রাজ্য, দেশকে এক বিশেষ পরিচয় প্রদান করে। গুণীজনদের হাতের কাজ সর্বজন সম্মুখ্যে যখন দেশের কিংবা জাতির পরিচায়ক হয়ে উঠে তখন শিল্পী এক স্বর্গীয় সুখ লাভ করেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অসমে এমন অনেক কিছুই রয়েছে যা শিল্পীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে অনন্য হয়ে উঠে, সমগ্র বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। অসমের সাধারণ মানুষের সৌন্দর্যবোধের পরুচায়ক অসমের একাধিক শিল্পকলা। এই শিল্পকলা সমূহ সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলে মিশে গিয়েছে।

অসমের এই কুটির শিল্প অতি প্রাচীন। কালিকা পুরাণে অসমের পাট বস্ত্রের এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এক ধরনের স্বর্নবর্ণের সূর্যের মতো উজ্জ্বল বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। অসমের কুটির শিল্পে এন্ডি মুগার বস্ত্র নির্মাণ, মাটির জিনিস, ধাতুর বাসনপত্র নির্মাণ এবং আরও অনেক কিছু রয়েছে। বর্তমানে অসমের শিল্ক বহিঃবিশ্বের মানুষ যথেষ্ট পছন্দ করছেন। মূল্যবান এই সিল্কগুলি হচ্ছে মুগা, এরি বা এন্ডি এবং পাটের থেকে তৈরি।
উল্লেখ্য এই সুতা থেকে অসমীয়া নারী-পুরুষেরা নিজেদের ঘরেই কাপড় তৈরি করেন। অসমের মুগা সুতাকে অনেকে সোনালি সূতাও বলেন। আহোম রাজা স্বর্গদেও প্রতাপসিংহের রাজত্বকালে অসমের এই বস্ত্র শিল্পের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অসমের আহোম রাজারা মুগা শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা শিল্পীদেরকে মাটির কর থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। শোনা যায়, রাজা প্রতাপসিংহ তাঁর প্রধানমন্ত্রী মোমাই তামুলি বরবড়ুয়ার তত্বাবধানে প্রত্যেক প্রজাদের বাড়িতে মুগার কাপড়ের তাঁত বসান এবং ফরমান জারি করেন যে, প্রত্যেকে যেন নিজেদের বাড়ি থেকে কাপড় তৈরি করে রাজকোষে জমা করেন।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩৪: কাঁচাকান্তি মন্দিরের কথকতা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

মুগা সুতা এক ধরনের পোকা থেকে তৈরি করা হয়। এই পোকা থেকে সুতো তৈরি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়। অ্যানথেরিয়া আসামা (Antheraea assama) নামক এক ধরনের পোকা ঠেকে তৈরি হয় এই বহু মূল্যবান মুগা কাপড়। অসমের জলবায়ু মুগা কাপড় তৈরি করার জন্য উপযোগী। সুন্দর সোনালি রঙের উজ্জ্বল এই কাপড়টি তৈরি করা কিন্তু এতো সহজ নয়। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যথেষ্ট সময় নিয়ে এই পোকা থেকে তৈরি সুতো এবং তাঁর পর তৈরি হয় পরিধেয় বস্ত্র।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

পাট বস্ত্রকে এক বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। বলা হয়, অনেক বছর আগে পাটের আবিষ্কার করেন চিনের এক রানি। চিনের রানি চি-লিং-ছিয়ে তাঁর বাগানে পাট গাছ এবং তার সুতোর আবিষ্কার করেছিলেন। অসম পাটের জন্য বিশ্ব দরবারে সমাদৃত হয়। অসমীয়া সমাজে পাটের ব্যবহার প্রচুর।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

পাট সুতা বোমবিক্স মোরি নামক এক ধরনের পতঙ্গের সাহায্যে উৎপাদন করা হয়। পাট বেশ কয়েক প্রকারের হয়। তার থেকে নির্মিত কাপড়গুলিও স্বাভাবিক ভাবেই গুণগত দিক দিয়েও আলাদা হয়

অসমের আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাপড় হচ্ছে এরি বা এন্ডি। এই কাপড়ও তৈরি হয় এক ধরনের পোকা থেকে। এই পোকাগুলি কিছু নিদৃষ্ট গাছের পাতা খায়, তাই এরি চাষ যারা করেন তারা সেই গাছগুলিও চাষ করেন। অসমের লক্ষিমপুর, শিবসাগর, যোরহাট, কামরূপ, গোয়ালপারা, কাছাড়, কোকরাঝাড় এবং আরও অনেক জায়গায় এরি চাষ করা হয়। এই এরি চাষ এবং তার থেকে শেষ পর্যন্ত বস্ত্রনির্মাণ সব কিছু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর যতটা চাষ করা হয় উৎপাদন যে ঠিক ততটাই হবে তাও তো কোনো ঠিক নেই।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

অসমের রেশম শিল্পের মূল পিঠস্থান হচ্ছে শুয়ালকুচি। গুয়াহাটি শহরের প্রায় ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত শুয়ালকুচির এদিকে ওদিকে শুধু তাঁত শিল্প দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এখানে তাঁত থেকে কাপড় তৈরি হয় বলে শুয়ালকুচিকে অসমের ম্যানচেস্টার বলা হয়ে থাকে। শোনা যায়, মহারাজা কুমার ভাস্কর বর্মণে তাঁর পরম বন্ধু উত্তর ভারতের রাজা, মহারাজ হর্ষবর্দ্ধনকে একটি মনোরম বাঁশের ঝুড়ির ভিতর হাতির দাঁতের অলংকার এবং উত্তম মানের পাট বস্ত্র পাঠিয়েছিলেন।

অসমের রাজারা যে অসমের শিল্প সংস্কৃতিকে যথাযোগ্য মান দিতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অসমে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাট কিংবা মুগা বস্ত্র ইত্যাদি উৎপাদন করা হয়। বিশেষ ধরনের কারুকার্য করা এই কাপড়ের গুণগত মান যথেষ্ট উন্নত এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই খুবই দামি এই কাপড়গুলো। রেশম সুতার দামের উপরই নির্ভর করে শাড়ি কিংবা অন্যান্য পরিধেয় বস্ত্রের মূল্য।

অসমের তাঁত ও মুগা শাড়ি।

অসমের শিল্প কলার নিদর্শন আরও রয়েছে যেমন মাজুলির মুখোশ, হাতির দাঁত, সর্থেবাড়ির কাঁসার বাসন এবং আরও অনেক কিছু। মাজুলি অসমের নদী-দ্বীপ। এখানে শিল্পীরা অদ্ভুত রকমের মুখোশ তৈরি করে থাকেন।এই মুখোশগুলি পরিধান করে শিল্পীরা উপনিষদ, পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি কাহিনীর নৃত্য নাটিকা উপস্থাপন করেন। অর্থাৎ একটি শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও একটি শিল্প।

এই মুখোশের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসমের সংস্কৃতিও। বাঁশ, বেত, মাটি তুলা ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিষ দিয়ে তৈরি হয় এই মুখোশগুলি। নাটকের গল্পের প্রয়োজন হিসেবে কখনও তৈরি হয় শঙ্খচূড়ের মুখ, কখনও বা ধেনুকাসুরের মুখ কিংবা হাতি, ছাগল বা কোনও পশু-পাখির মুখ। আধুনিকতার চাপে এই মুখোশ শিল্পীরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ কথা মেনে নিতেই হয়। অসমের বিস্তর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে অসমের শিল্প কলা এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।—চলবে।
*ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content