মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


কনকলতা বড়ুয়া ও নলিনীবালা দেবী। ছবি: সংগৃহীত।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই সময়টিকে অগ্নিযুগ বলাই যেতে পারে। যে অগ্নিযুগে দেশকে স্বাধীন করার আগুন জ্বলে উঠেছিল প্রত্যেক ভারতবাসীর মনে। আবালবৃদ্ধবনিতা অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন। নিজের জীবনের থেকেও প্রাধান্য দিয়েছিলেন প্রাণাতিরিক্ত প্রিয় দেশকে। কেউ বা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ অহিংস নীতি মেনে আন্দোলন করছিলেন। অসমের হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অসমের নারীরাও ঘরে বসে থাকেনি। তাঁরাও স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। অসমের মহিলারা যে ত্যাগ ও দেশ ভক্তির নিদর্শন তুলে ধরেছেন, তা ইতিহাসের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

অসমের নারীরা সব সময়ই রাজনৈতিক বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। আহোম রাজত্বকালেও রাজনীতিতে তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়। ১৮৫৭ সালে মণিরাম দেওয়ান প্রথম ইংরেজের বিরুদ্ধাচারণ করেন। তিনি ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী মিলে ইংরেজদের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে অসমের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইংরেজ বিরোধী মনোভাব তীব্র হতে থাকে। স্বরাজ লাভের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন সম। ‘অসম ছাত্র সম্মিলন’ এবং ‘অসম সাহিত্য সভা’র মাধ্যমে অসমের মহিলারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন।

অসমের প্রথম মহিলা শহিদ হলেন মাংরি ওরাং (মালতি মেম)। তিনি দরং জেলার লালমাটি চা বাগানের চা শ্রমিক ছিলেন। ১৯২১ সালে বিদেশি মদ বর্জন আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন অসমের এই অগ্নী কন্যা। পরে ইংরেজ পুলিশের গুলি লাগে তাঁর বুকে।
১৯২১ সালে গান্ধীজি অসমে যান। অসমের মহিলাদেরকে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করতে উৎসাহিত করেন। বহু সংখ্যক মহিলা অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। গান্ধীজির অসমে যাওয়ায় অসমের মহিলাদের জীবনযাত্রা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপুল পরিবর্তন আসে।

১৮ আগস্ট ১৯২১ সালে গান্ধীজি গুয়াহাটিতে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন। সেই সভায় বিপুল সংখ্যক মহিলারা উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুৎ প্রভাদেবী, হেমন্তকুমারী দেবী, স্নেহলতা ভট্টাচার্য, গুণেশ্বরী দেবী মতো কংগ্রেসের সদস্যারা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। গান্ধীজির অনুপ্রেরণাতে বিদেশি বস্ত্র ত্যাগ করে অসমের মহিলা চরকায় সুতো কেটে বস্ত্র তৈরি করেতে শুরু করেন। আইন অমান্য আন্দোলনে অসমের মহিলারা অংশগ্রহণ করেন। প্রভাতফেরি এবং বিভিন্ন সভার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেন। নবীন চন্দ্র বড়দলৈ, তরুণরাম ফুকন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, চন্দ্রকুমার আগরওয়ালের মতো কিছু দেশপ্রেমী মানুষের জন্যই অসমের মহিলারা রক্ষণশীল সমাজের প্রকুলতা পেরিয়ে বাইরের জগতে এসে দেশের জন্য আত্মনিয়োগ করতে পড়েছিলেন।

নলিনীবালা দেবী অসম সাহিত্য সভার প্রথম সভাপতি ছিলেন। তিনি নবীনচন্দ্র বড়দলৈর কন্যা। তিনি তাঁর দেশভক্ত পিতার মতোই আদর্শবাদী ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন এবং স্বদেশী আন্দোলনে তিনিও অংশগ্রহণ করেছিলেন। অসমে খাদিবস্ত্র এবং দ্রব্যের উৎপাদনের জন্যও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। নলিনী দেবী একাধিক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৫৭ সালে স্বাধীন ভারতে তিনি ‘পাত্মশ্রী’ উপাধি লাভ করেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব ১৩: অসমে প্রথম আত্মদানের গৌরব লাভ করেন অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্য

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৪: উদয়পুর অভিযানে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়া ভেঙে দিয়েছিল

অসমের শোনিতপুর জেলার কুমালী দেবীর কথাও উল্লেখ করতে হয়। ভারত ছাড় আন্দোলনে ‘মৃত্যবাহিনী’ দল ঢেকিয়াজুলি পুলিশ স্টেশনে পতাকা উত্তোলনের দায়িত্ব দেয় কুমলী দেবীর পুত্র গোলক এবং আরও দু’জন তরুণকে। কুমলী দেবীও ১৯৪২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সেই ছেলের সঙ্গে মিছিলে যোগদান করেছিলেন। পুলিশ সেই সময় পতাকা উত্তোলনে বাধা দেয় এবং সত্যাগ্রহীদের উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। মিছিলের প্রথমে থাকা মানবর নাথ পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। তাঁর পাশেই ছিলেন গোলক, কুমলী দেবী তখন ছেলের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজে ছেলের সামনে এসে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন। মাতৃত্ব এবং দেশভক্তির এক অতুলনীয় নজির তুলে ধরলেন কুমলী দেবী।

কনকলতা বড়ুয়া মাত্র আঠেরো বছর বয়সে দেশের জন্য প্রাণ দেন। ১৯২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। বাবর কৃষ্ণ কান্ত এবং মায়ের নাম কর্ণেশ্বরী বড়ুয়া। স্বাধীনতা সংগ্রামী কনকলতা অল ইন্ডিয়া স্টাডেন্টস ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। ভারত ছাড় আন্দোলনের সময় মৃত্যু বাহিনীতে তিনি যোগদান করেন। ১৯৪২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কনকলতার দল সিদ্ধান্ত নেয়, স্থানীয় গোহপুর থানায় ভারতের পতাকা উত্তোলন করবে। ১৭ বছরের অল্প বয়সি মেয়েটি পুলিশের হুমকিকে পরোয়া না করে পতাকা হাতে নিয়ে নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেন। পুলিশও গুলি চালাল, পতাকা হাতে নিয়েই গুলিবিদ্ধ হলেন কনকলতা। তাঁর পাশেই ছিলেন মুকুন্দ কাকোতি, তিনি পতাকাটি তুলে ধরেছিলেন। ইংরেজ পুলিশ তাঁকেও গুলি করে। দু’ জনেই সে দিন ভারতের পতাকার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ দেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৬: আচমকা ‘বন্ধু’ কিশোরের প্রয়াণে ভেঙে পড়েছিলেন পঞ্চম

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৭: তিনটি মেয়ের তিনটি কলম!

অসমের মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীরদের প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে পুষ্পলতা দাসের কথা বলতেই হয়। তিনি ১৯১৫ সালে উত্তর লক্ষ্মীমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম রামেশ্বর সৈকিয়া এবং মায়ের নাম স্বর্ণলতা। তিনি খুব অল্প বয়সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। ভগত সিংহের ফাঁসির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে বিক্ষোভ জানিয়ে ছিলেন। পুষ্পলতা আইন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। ছাত্র জীবনেও তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পুষ্পলতা অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমইটির সদস্যও ছিলেন। একাধিকবার দেশ মাতার জন্য কারাবরণ করেছেন। দেশের স্বার্থে তাঁকে আত্মগোপনও করতে হয়েছে।

ভানুমতি তালুকদার অসমের আরেক মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯২১ সালে গান্ধীজি অসমে যান। সেই সময় মহাত্মা গান্ধীর বক্তৃতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। এর পরে তিনি দেশের জন্য সংগ্রামে অংশ নিতে মনস্থির করেন। গান্ধীজি তাঁকে অসমের সরোজিনী বলে উল্লেখ করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন এবং বিদেশি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা করেন।
অসমের আরেক স্বনামধন্যা স্বাধীনতা সংগ্রামী কিরণবালা বড়া। ১৯০৪ সালে কিরণবালা অসমের নওগাঁও জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কমলচন্দ্র পণ্ডিত এবং মা সরোজ এইডেও। কিরণবালা গান্ধীজির আদর্শ মেনে চলতেন। অসহযোগ আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন। বিদেশি বস্ত্র বিসর্জনের আন্দোলন যখন সারা দেশ জুড়ে চলছে, তখন তিনিও তাঁর নিজের বাড়ির বহু মূল্যবান জিনিসপত্র জ্বালিয়ে দেন। আফিং এবং ভাংয়ের মতো স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর বস্তু সেবন করার বিরুদ্ধে সমাজে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলন কেন জরুরি, তা সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪২ এর ভারত ছাড় আন্দোলনের সময় তিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কারাবরণও করেন। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশের জন্য লড়াই করেছেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৩: বিপর্যয়ের দিনে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ

ওজন বেড়েই চলেছে? এই সব আয়ুর্বেদীয় বিধি বিধানগুলি মেনে চললে ওজন থাকবে নিয়ন্ত্রণে

অসমের আরেক অগ্নিকন্যা ভোগেশ্বরী ফুকননী। জন্ম ১৮৮৫ সালে। বাবার নাম আত্মরাম বুড়াগোহাই এবং মা ছিলেন নীলেশ্বরী বুড়াগোহাই। গান্ধীবাদী ভোগেশ্বরী ভারত ছাড়ো আনোদোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে একাধিক প্রতিবাদী মিছিলে অংশগ্রহণ করেন।

অসমের মাটিতে জন্মানো আরেকজন বীরাঙ্গনার নাম চন্দ্রপ্রভা শইকীয়ানী। জন্ম ১৯০১ সালে। তাঁর পিতার পদবী ছিল মজুমদার, কিন্তু তিনি নিজেকে শইকীয়ানি পদবীতে পরিচিত দিতেন। উল্লেখ্য, তাঁর ভগ্নী রজনীপ্রভা শইকিইয়ানী অসমের প্রথম মহিলা চিকিৎসক ছিলেন। পড়াশোনো করার জন্য অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। তিনি নওগাঁও-এ একটি স্কুলে পড়াতেন। চন্দ্রপ্রভা অল অসম প্রাদেশিক মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা করেছিলেন।

১৯১৮ সালে তেজপুরে হওয়া অসম ছাত্র সম্মেলনে তিনি একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন। সেই সভায় দাঁড়িয়ে নেশা জাতীয় বস্তুর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েচিলেন। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে স্বচেষ্ট হয়েছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় এবং তার আগেও তিনি দেশের জন্য কারাবরণও করেছিলেন।

অসমের রাজরিনীতিতে মহিলাদের স্বক্রিয় ভূমিকা আমরা সব সময়ই লক্ষ করে থাকি। স্বরাজ লাভের জন্য অসমের মহিলাদের এগিয়ে আসা এবং দেশের জন্য আত্মবলিদান দিতে তাঁরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। —চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content