বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ভরতবংশীয় কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পন্ন হল। বৎসরকাল পরে, ধৃতরাষ্ট্র, যুধিষ্ঠিরকে, যুবরাজপদে অভিষিক্ত করলেন। ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন জন্মান্ধ। তাঁর মায়ের কারণে এই দৃষ্টিহীনতা। মহামান্য, বেদব্যাস, মা সত্যবতীকে জানিয়েছিলেন, এই পুত্র শতপুত্রের জনক হবেন ঠিকই তবে মায়ের দোষেই ইনি হবেন দৃষ্টিহীন। অস্য চাপি শতং পুত্রা ভবিষ্যন্তি মহাত্মনঃ। কিন্তু মাতুঃ বৈগুণ্যাদন্ধ এব ভবিষ্যতি।। অন্ধ কুমার রাজা হওয়ার যোগ্য নন। সত্যবতী, ভাবি যোগ্য বংশধরের কথা চিন্তা করে বললেন, নান্ধঃ কুরূণাং নৃপতিরনুরূপস্তপোধন!

হে তপোধন, অন্ধ মানুষ কুরুদের যথার্থ রাজা হবেন কী করে? মহর্ষি বেদব্যাস, বিচিত্রবীর্য্যের বিধবা পত্নী, অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন। ঋষি বেদব্যাস, মা সত্যবতীর অনুরোধে, কুরুবংশরক্ষার্থে, শাস্ত্রসম্মত এবং ধর্মসঙ্গত মিলনে সম্মত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে কুরুবংশের উত্তরাধিকারী সত্যবতীপুত্র চিত্রাঙ্গদ গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই কুরুকুমার চিত্রাঙ্গদ ছিলেন বুদ্ধিমান, মহাবীর, শৌর্যশালী। বিখ্যাত কুরুশ্রেষ্ঠ শান্তনুর মৃত্যুর পর সেই বীর চিত্রাঙ্গদ রাজা হলেন। রাজা চিত্রাঙ্গদ যুদ্ধে অপরাজিত, মনুষ্যং ন হি মেনে স কিঞ্চিৎ সদৃশাত্মনঃ। তিনি কোন মানুষকে তার নিজের তুল্য বীর মনে করতেন না। নিজের শৌর্যের কারণে, গর্বিত চিত্রাঙ্গদ, দেবগন, অসুরগণ ও মানুষদের তিরস্কার করতেন। একদিন চিত্রাঙ্গদ নামে এক শৌর্যশালী গন্ধর্বরাজ মুখোমুখি হলেন কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদের। ত্বয়াহং যুদ্ধমিচ্ছামি ত্বৎসকাশন্তু নামতঃ। আগতোঽস্মি বৃথাভাষ্য ন গচ্ছেন্নাম তে মম।। আপনার সঙ্গে আমি যুদ্ধে ইচ্ছুক। আপনারও আমার নাম এক।সেই কারণেই আমি এসেছি।এই যুদ্ধের আহ্বান,বৃথা আস্ফালন নয়। আপনার ও আমার দুজনের এক নাম হতে পারে না। বস্তুত এটি ছিল দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান। দুজনে মহাসংগ্রাম শুরু হল। তিন বছর ধরে চলল এই যুদ্ধ। মায়ার আশ্রয় নিলেন গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ। গর্বিত কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদের দর্পচূর্ণ করাই ছিল গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদের উদ্দেশ্য। মহাযুদ্ধে বিশেষ অস্ত্রবিদ্যা নিপুণ, গন্ধর্বরাজ, চিত্রাঙ্গদ, মায়া বলে কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদকে বধ করে প্রস্থান করলেন। হয়তো তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদের বিনাশ। তাঁর উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় আর তাঁর উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না।

জ্যেষ্ঠ পিতৃব্য, ভীষ্মের ব্যবস্থাপনায়, রাজা হলেন চিত্রাঙ্গদের কনিষ্ঠ বিচিত্রবীর্য। মা সত্যবতীর নির্দেশমতো ভীষ্মের অভিভাবকত্বে, কিশোর বিচিত্রবীর্য্য রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। যৌবনে উপনীত বিচিত্রবীর্য্যের বিবাহের উপযুক্তপাত্রী প্রয়োজন। ভীষ্ম শুনলেন, অপ্সরাতুল্য সুন্দরী কাশীরাজের তিন কন্যা আছেন। অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকা। তাঁদের স্বয়ম্বরসভায় উপস্থিত হলেন ভীষ্ম। সেখানে উপস্থিত রাজবৃন্দের আলোচনার বিষয় হলেন তিনি। বড়ই ধর্মাত্মা এই ভীষ্ম। বৃদ্ধ, চুলে পাক ধরেছে, পেশী শিথিল, এই নির্লজ্জ এখানে কেন? লোকে কেন বলবেনা? মিথ্যাপ্রতিজ্ঞা করেছেন ইনি। ছদ্ম ব্রহ্মচারী নামেই ইনি বিখ্যাত হয়েছেন নিশ্চয়ই। লোকে কেন একথা বলবে না? মিথ্যাপ্রতিজ্ঞো লোকেষু কিং বদিষ্যতি ভারত! ব্রহ্মচারীতি ভীষ্মো হি বৃথৈব প্রথিতো ভুবি।।
রাজাদের আলোচনা শুনে মাননীয় ভীষ্ম আটপ্রকার বিবাহের সংজ্ঞা নির্দেশ করলেন। ক্ষত্রিয়দের পছন্দ স্বয়ংবরের মাধ্যমে পাত্রী নির্বাচন। ক্ষত্রিয়রা বিপক্ষকে পরাজিত করে, কন্যা হরণ করে বিবাহই শ্রেয় বলে মনে করেন। তাই তিনি কাশীরাজের তিন কন্যাকে হরণ করছেন। উপস্থিত সমবেত রাজাদের প্রতিরোধকে খান খান করে, সর্ব অস্ত্রনিপুণ, ভীষ্ম, কাশীরাজের তিন কন্যাকে নিয়ে হস্তিনাপুরে প্রস্থান করলেন। শুধুমাত্র অসাধারণ শক্তিমান রাজা শাল্ব, স্ত্রীলাভের আশায়, ভীষ্মের অনুসরণ করলেন। প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেন ভীষ্ম। কেবলমাত্র শাল্বরাজা বাঁধা দিলেন ভীষ্মকে।

শেষপর্যন্ত এক দর্শনীয় যুদ্ধে শাল্বরাজার প্রাণটি অবশিষ্ট রেখে ভীষ্ম তাঁকে ছেড়ে দিলেন। নিজের ভগিনীর মতো কাশীরাজার তিন কন্যাকে, তিনি, বিচিত্র বীর্যের সঙ্গে বিবাহের পাত্রী হিসেবে মনোনীত করলেন। অম্বা শাল্বরাজাকেই বরণ করবেন মনস্থ করেছিলেন। তাঁকে শাল্বরাজের কাছে গমনের অনুমতি দিলেন মহান ভীষ্ম। অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের পরিণয় সম্পন্ন করলেন তিনি। কুরুরাজ বিচিত্রবীর্য্য সুন্দরী, সুতনু, তন্বী, সুলক্ষণা দুই স্ত্রীরত্নের সান্নিধ্যে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। তিনি ধার্মিক থেকে কামপরায়ণ হয়ে উঠলেন বেশি। তাঁর কামনা নারীদের চিত্তে ঝড় তুলল, এমনই ছিল তাঁর কামুকতা। শেষে, সাত বছর বিবাহিত জীবনযাপনের পর যক্ষারোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন বিচিত্রবীর্য। কুরুবংশের কোন উত্তরাধিকারী রইল না। ভীষ্ম আছেন। তিনি পিতার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চিরকুমারত্বের কঠিন প্রতিজ্ঞার তাঁর। শান্তনুপত্নী সত্যবতী তাঁকে অনুরোধ জানালেন, পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকা সাথে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে কুরুবংশ রক্ষা কর। অথবা সিংহাসনে আরোহন করে, রাজ্য শাসন কর। বিবাহ কর,নির্বংশ হওয়ার কারণে পিতৃপুরুষদের নরকগমন বন্ধ হোক। অনমনীয়, ভীষ্ম জানালেন, ত্রিলোক এমনকি দেবরাজ্য এবং এর থেকেও বেশি কিছু থাকলে, তাও ত্যাগ করতে পারি কিন্তু সত্যকে কোনমতেই পরিত্যাগ করতে পারি না। পরিত্যজ্যেয়ং ত্রৈলোক্যং রাজ্যং দেবেষু বা পুনঃ। যদ্বাপ্যধিকমেতাভ্যাং ন তু সত্যং কথঞ্চন।। তিনি কুরুরাজ শান্তনুর বংশধারা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেই চিরন্তন ক্ষত্রিয়ধর্মের অঙ্গ নিয়োগপ্রথার বর্ণনাপ্রসঙ্গে একটি কাহিনির অবতারণা করলেন।

প্রাচীনকালে ঋষি উতথ্যর প্রিয়পত্নী ছিলেন মমতা। একদা উতথ্যঋষির ভাই, দেবতাদের পুরোহিত, তেজস্বী, বৃহস্পতি, উতথ্যপত্নী মমতার কাছে উপস্থিত হলেন। মমতা তখন গর্ভধারণ করেছেন। তার গর্ভস্থ, স্বামী উতথ্যর ঔরসজাত পুত্র, গর্ভে অবস্থানকালে, ইতিমধ্যে ষড়ঙ্গসহ সমগ্র বেদ অধ্যয়ন করে ফেলেছেন।বৃহস্পতি ছিলেন অমোঘরেতাঃ অর্থাৎ বৃহস্পতির রেত অর্থাৎ শুক্রাণু ব্যর্থ হয় না। তাই তার ফলে গর্ভে পুত্রের উৎপত্তি হবেই। এক গর্ভে দুটি সন্তানের স্থান সংকুলান হবে না। মমতার অনুরোধ—বৃহস্পতি যেন বিরত হন। কামার্ত বৃহস্পতির মনোবিকার হল। তিনি কামনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না।একজন কামার্ত পুরুষ, একজন কামবিমুখ নারীর সঙ্গে কামকলায় রত হলেন। গর্ভস্থ সন্তান তাকে বাঁধা দিলেন। এখানে স্থান অল্প আমি আগেই এসেছি আপনার রেত ব্যর্থ হবার নয়। আপনি আমাকে কষ্ট দেবেন না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩২: প্রাসাদ রাজনীতিতে দাসী মন্থরার প্রভাব, চিরন্তন মনস্তাত্বিক দূষণ, কোথায় নেই?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা

অল্পো২বকাশো ভগবন্! পূর্ব্বঞ্চাহমিহাগতঃ। অমোঘরেতাশ্চ ভবান্ পীড়াং কর্ত্তুং ন মেঽর্হতি।। বালক বীর্যপাতের সময় বীর্যের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করলেন পা দুটি দিয়ে। বীর্য স্থানচ্যুত হয়ে ভূমিতে পড়ল। বিরক্ত, ক্রুদ্ধ, বৃহস্পতি মমতার গর্ভস্থ সন্তানকে অভিশাপ দিলেন। দীর্ঘদিন অন্ধত্বের অন্ধকারে থাকবে তুমি তমো দীর্ঘং প্রবেক্ষ্যসি অর্থাৎ অন্ধত্বের অভিশাপ নিয়ে জন্ম নিলেন উতথ্যপুত্রটি। তার নাম হল দীর্ঘতমা। অভিশাপ অনুযায়ী দীর্ঘং তমঃ অন্ধত্বম্ দীর্ঘ তম অর্থাৎ আঁধারে অবস্থানের কারণে তাঁর নাম হল দীর্ঘতমা। তিনি তপস্যায় বৃহস্পতিকেও অতিক্রম করলেন। বেদজ্ঞ, যশস্বী, দীর্ঘতমা তাঁর বিদ্যাবত্তাবলে প্রদ্বেষী নামে সুন্দরী, ব্রাহ্মণন্যার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন। ঋষি উতথ্যের বংশবৃদ্ধি করলেন দীর্ঘতমা।

ধার্মিক, উদারহৃদয়, বেদবিদ্যায় পারঙ্গম, দীর্ঘতমা, স্বর্গের কামধেনু সুরভির পুত্রের কাছে সম্পূর্ণ গোধর্ম শিক্ষা করলেন। দীর্ঘতমা, নির্ভীকভাবে এই ধর্মে বিশ্বাস রেখে, আচরণের মাধ্যমে গোধর্ম প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। গোধর্ম হল, প্রকাশ্যে মৈথুন। বেদজ্ঞ ঋষি দীর্ঘতমা প্রকাশ্যে স্ত্রীলোকের সঙ্গে রমণে রত হলেন। অনুসরণ করলেন গোধর্ম। প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোন রমণীর সঙ্গে রমণ একজন ঋষির ধর্মবিরুদ্ধ আচরণ। ক্রোধে, নিন্দায় দীর্ঘতমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন আশ্রমবাসীরা। তাঁরা স্থির করলেন, আমরা সকলেই এই পাপাত্মাকে ত্যাগ করব। তস্মাদেনং বয়ং সর্ব্বে পাপাত্মানং ত্যজামহে। দীর্ঘতমা পত্নী প্রদ্বেষীরও বিরাগভাজন হলেন। দীর্ঘতমার পত্নী প্রদ্বেষী জানালেন, সাধারণত স্বামী, স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়ভার গ্রহণ করে থাকেন। তাই তাঁরা ভর্তা। আর স্ত্রীকে পালন করেন তাঁরা তাই পতি। এর বিপরীত আচরণকারী ব্যক্তি স্বামী নন। তিনি এতকাল, নিজে, একাধারে স্বামী ও পুত্রদের ভরণপোষণ করে আসছেন। তিনি ক্লান্ত, আর কাজ করতে পারছেন না।ভীষণ রাগে ফেটে পড়লেন দীর্ঘতমা।বললেন, আমাকে কোন ক্ষত্রিয়বাড়িতে নিয়ে চলো। সেখানেই ধনলাভ হবে।অর্থাৎ ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিতে চাইছেন স্বামী দীর্ঘতমা। প্রদ্বেষী রাজি হলেন না। অন্ধস্বামীর সঙ্গে ভ্রমণ শ্রমসাধ্য। এই কাজ করতে পারবেন না তিনি।প্রদ্বেষী, জানালেন,আর পূর্বের মতো স্বামীর ভরণপোষণের দায়িত্বও তিনি নিতে পারবেন না। ন ভরেয়ং যথা পুরা সাফ কথা, ওই রকমটি আর নয়।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

ভীষণ ক্রুদ্ধ দীর্ঘতমা বললেন, আজ হতে পৃথিবীতে স্ত্রীলোকের একজন মাত্র স্বামী থাকবেন। স্বামী মারা গেলে বা জীবিত থাকলে স্ত্রীলোক অন্য প্রতি গ্রহণ করতে পারবেন না। এই নিয়ম লঙ্ঘন করে পরপুরুষ সংসর্গে বিধবার পাপ হবে, তিনি পতিত অর্থাৎ জাতিচ্যুত হবেন, স্বামীর ধনভোগ থেকেও বঞ্চিত হবেন তিনি। এ অবস্থায় যদি স্বামীর ধনভোগ করেন তবে আত্মীয় বন্ধুরা তাকে ত্যাগ করবেন। দীর্ঘতমাপত্নী প্রদ্বেষী পুত্রদের আদেশ দিলেন, এনাকে তোমরা গঙ্গায় নিয়ে যাও। গঙ্গায়াং নীযতামেব পুত্রা ইত্যেবমব্রবীৎ। পৈতৃক ধনলাভের আশায় এবং মায়ের কথায়, পিতার পরিত্যাগের সিদ্ধান্তে, পুত্ররা মোহগ্রস্ত হয়ে একটি ভেলায় করে অন্ধ দীর্ঘতমাকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন। দীর্ঘতমার পুত্ররা বলাবলি করতে করতে বাড়ি ফিরলেন, কেন এই অন্ধ বৃদ্ধকে প্রতিপালন করব? কস্মাদন্ধশ্চ বৃদ্ধশ্চ ভর্ত্তব্যোঽয়মিতি এই অন্ধ দীর্ঘতমাকে গঙ্গার স্রোতে ভাসমান অবস্থায় দেখতে পেলেন বলি রাজা। ধার্মিক, রাজা বলি, দীর্ঘতমার পরিচয় জেনে নিয়ে, তাঁকে পুত্র উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করলেন।

বলিরাজার প্রস্তাবে সম্মত হলেন ঋষি দীর্ঘতমা। অন্ধ ও বৃদ্ধ দীর্ঘতমার কাছে যেতে, বলিরাজার রানী সুদেষ্ণার মনে মনে প্রবল আপত্তি।রানি ভীষণ বিতৃষ্ণায় নিজের ধাত্রীকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন দীর্ঘতমার কাছে। সেই শূদ্রা নারী, দীর্ঘতমার ঔরসে এগারোটি পুত্রের জন্ম দিলেন। বেদপাঠরত এই পুত্রদের দেখে খুশীমনে বলিরাজা দাবি করলেন এরা আমারই পুত্র মমেব। রাজাকে বাঁধা দিয়ে বললেন ঋষি দীর্ঘতমা মমেব এরা আমারই। কারণ রানি সুদেষ্ণা আমাকে অবজ্ঞা করেছেন। ধাত্রীতনয়া এক শূদ্রাকে নিজের পরিবর্তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বলিরাজা ঋষিশ্রেষ্ঠকে প্রসন্ন করে আবারও নিজের স্ত্রী সুদেষ্ণাকে পাঠিয়ে দিলেন দীর্ঘতমার কাছে। দীর্ঘতমার ঔরসে রানির যথাক্রমে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সুহ্ম নামে পাঁচটি পুত্র হল। এই পুত্রদের দ্বারা অধিকৃত দেশগুলিও তাঁদের নামে বিখ্যাত হল। অঙ্গদেশ, বঙ্গদেশ, কলিঙ্গদেশ, পুণ্ড্রদেশ, সুহ্মদেশ। ক্ষত্রিয় বলিরাজার বংশরক্ষা হল ঋষি দীর্ঘতমার বদান্যতার ফলে। এইভাবে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর মতো বহুক্ষত্রিয়েরই জন্ম হয়েছিল ব্রাহ্মণপিতার ঔরসে। ভীষ্মের এই কাহিনি শোনাবার উদ্দেশ্য ছিল মা সত্যবতীকে নিয়োগপ্রথার অনিবার্যতা বোঝানো। বংশরক্ষার স্বার্থে সত্যবতীর পুত্রবধূদের পুত্রবতী করে তোলার লক্ষ্যে নিয়োগপ্রথার আশ্রয় আবশ্যক। এটিই ছিল ভীষ্মের গল্পটির মর্মবাণী।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২০: অক্টোবর মাসের ষোলো, কী হল! কী হল?

ষড়রিপুর যে কোন একটিতে আসক্তি পতনের মূল কারণ, ভারতমনীষায় সেটি বারবার প্রমাণিত সত্যরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। দুই কুরুভায়ের অকালপ্রয়াণের কারণ হল দর্প এবং কামাসক্তি। শান্তনুপুত্র চিত্রাঙ্গদ ধরাকে সড়া জ্ঞান করেছিলেন। অপরকে তাচ্ছিল্যকরার মর্মান্তিক পরিণতি, মৃত্যু। সেটিই ঘটল। বিচিত্রবীর্য্যের অকালপ্রয়াণের মূল হল তাঁর অপরিসীম কামাসক্তি। উদারমনা, সত্যনিষ্ঠ ভীষ্ম ক্ষত্রিয়প্রথা মেনে কাশীরাজকন্যাদের হরণ করে এনেছিলেন একটি শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে।জ্যেষ্ঠা অম্বাকে সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিলেন। ভীষ্মের পরিকল্পিত বিবাহ ব্যর্থ হয়েছিল,নিঃসন্তান বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুতে। কারণ বিবাহের উদ্দেশ্যই ছিল বংশরক্ষা। এই বংশক্রম অক্ষুণ্ণ রাখবার তাগিদেই তৎকালীন নিয়োগপ্রথার উদ্ভব হয়েছিল। দৃঢ়চেতা,সত্যনিষ্ঠ,কুরুপ্রধান ভীষ্ম, মায়ের অনুরোধে এর সুযোগ নিতে পারতেন। কিন্তু ধার্মিক ব্যক্তিত্ব কোনও কিছুর মূল্যেই সত্যভ্রষ্ট হন না। সেটিই,মাননীয়া সত্যবতীর অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে মহান ভীষ্ম প্রমাণ করেছিলেন।

কুরুমুখ্য ভীষ্ম, নিয়োগপ্রথার সমর্থনে যে কাহিনিটি বলেছিলেন সেটির হয়তো নানা মাত্রা আছে।পরিস্থিতি যেমনই হোক, ক্ষত্রিয়পত্নীদের বংশরক্ষার এই মরিয়া চেষ্টা আত্মক্ষয়ী প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। ঋষি উতথ্যর স্ত্রী মমতা তাঁর দেবরদ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিলেন। নারীর অসম্মতিসত্ত্বেও তাঁকে ভোগ করবার ইচ্ছা, ধর্ষণেরই নামান্তর। ধর্ষক একজন খ্যাত ব্যক্তিত্ব। ঋষি উতথ্য এ বিষয়ে নীরব। এইভাবে ধর্ষণ যুগান্তরেও অব্যহত রয়েছে। প্রতিবাদী হয়েছে গর্ভস্থ সন্তান। সে কী ভাবি প্রজন্মের প্রতিনিধি? তিনি বৃহস্পতির রেতস্খলন নিষ্ফল করে দিয়েছেন। অভিশাপের অন্ধত্বের আঁধার তাঁকে ঘিরে ধরেছে। প্রতিবাদীর মর্মান্তিক পরিণতি মনে হয় এমনটাই হয়ে থাকে। কারণ সামাজিক প্রথা পরিবর্তন না হলে, প্রতিবাদ বৃথা।

ধর্মজ্ঞ, প্রতিবাদী, তেজস্বী দীর্ঘতমার শোচনীয় অধঃপতনের সূচক যেন তাঁর এই বিবেকদৃষ্টির আলোর অভাব। সত্যিই যথার্থনামা যেন দীর্ঘতমা। শৈশবের নিষ্পাপ উদারমনটি তাঁকে উদারতা শিখিয়েছে। সেই একই বিদ্বান,বুদ্ধিমান, ঋষি দীর্ঘতমা গোবৃত্তি অবলম্বন করেছেন,যা স্বচ্ছাচারিতার নামান্তর। এই গোবৃত্তি,মানুষের অসংযত জীবনচর্চার নিদর্শন, যেটি সাধারণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু একজন বেদজ্ঞ ঋষি কী সেই আচরণ করতে পারেন?

নিয়োগপ্রথা একটি যুগপ্রথা।অভিজাত ক্ষত্রিয়রা এটিকে বংশরক্ষায় কাজে লাগিয়েছেন,যদিও পাত্রপাত্রীর যুগ্ম সম্মতিতে এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটেনি।সেটি ছিল নিয়োগকর্তার একতরফা সিদ্ধান্ত। শ্রীবেদব্যাস নিজে অম্বা এবং অম্বিকার মনের দিকে তাকাননি, শুধুমাত্র মাতৃ আজ্ঞা পালন করেছেন। তাঁদের মিলন ছিল যান্ত্রিক। পাণ্ডুপত্নী কুন্তী শুধু নিয়োগে নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহার করেছেন। কারণ তাঁর মহান দেবতাদের আহ্বানের সুযোগ ছিল। তিনি ঋষি দুর্বাশা প্রদত্ত বরলাভে সৌভাগ্যবতী ছিলেন। তিনি কিন্তু তাঁর স্বামীর ইচ্ছায় এই বরের যথেচ্ছ ব্যবহার করেননি।পাণ্ডুর আরও পুত্রলাভের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিচিত্রবীর্যের বিধবাপত্নী দু’ জনের বা বলিরাজপত্নী সুদেষ্ণার সেই স্বাধীনতা ছিল না। অম্বা, অম্বিকা, সুদেষ্ণারা অপেক্ষা করেছেন ভীষ্মের মতো উদারমনা ক্ষত্রিয় কোন কুরুমুখ্যের বা অন্তত পছন্দের কোন পুরুষের। উপস্থিত হয়েছেন অনাকাঙ্খিত জরাগ্রস্ত পলিতকেশ বেদব্যাস বা ঋষি দীর্ঘতমা। শ্রীবেদব্যাস অন্ধপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বের দায়ভারও মা অম্বিকার ওপর আরোপ করেছেন। তাঁর নিজের কী কোন দায় ছিলনা?

পিতৃতান্ত্রিক পরিবারতন্ত্রের সিদ্ধান্তগ্রহণে পুরুষপ্রভাব এখনও আছে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। অম্বিকার মতো ভারাক্রান্ত মনে, বদ্ধদৃষ্টিতে অনেক অনিচ্ছার মিলন হয় শুধুমাত্র পুরুষের ইচ্ছায়। উতথ্যপত্নী মমতা থেকে বলিরাজপত্নী সুদেষ্ণা কেউ এর ব্যতিক্রম নন। এখনও মমতা, সুদেষ্ণা, অম্বিকা, অম্বালিকাদের অবরুদ্ধ চোখের জলে মেশা কত দীর্ঘশ্বাস, ভারাক্রান্ত করে তোলে ভরতবংশীয়দের সামাজিক বাতাবরণ, কে তার হিসাব রাখে?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content