শনিবার ১৯ এপ্রিল, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রামচন্দ্রের প্রতি যা কিছু অবিচার হয়েছে, তাঁর প্রতিকারে বদ্ধপরিকর কৈকেয়ীপুত্র ভরত। তিনি রামচন্দ্রের প্রাপ্য রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকার ফিরিয়ে দেবেন। রামকে অযোধ্যায় নিয়ে যাবেন ভরত। অনেক দুরূহ পথ পার করে অবশেষে জ্যেষ্ঠ রামের সম্মুখীন হলেন ভরত। সুদীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার অবসান হল। ভরত, চিত্রকূটের মহারণ্যে প্রাণপ্রিয় জ্যেষ্ঠর সন্ধান পেলেন। যুগান্তের সূর্যের মতো দুর্নিরীক্ষ্য ভরতকে দেখলেন রাম। ভরতের মুখখানি বিবর্ণ ও শীর্ণকায়, কোনও মতে তাঁকে চিনতে পারলেন রাম। হাত বাড়িয়ে দিলেন তাঁর দিকে।

ভরতের মস্তক আঘ্রাণ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন। তাঁকে ক্রোড়ে বসিয়ে,রাম প্রশ্ন করলেন, তুমি যে অরণ্যে এসেছ, তোমার পিতা কোথায় আছেন? তাঁর জীবদ্দশায় তুমি তো বনে আসতে পার না। *ক্ব নু তেঽভূৎ পিতা তাত যদরণ্যং ত্বমাগতঃ। ন হি ত্বং জীবতস্তস্য বনমাগন্তুমর্হসি।। রাম বললেন, দীর্ঘদিন পরে, দূর হতে, অরণ্যে সমাগত ভরতকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর প্রশ্ন, মলিনবদন ভরতকে চেনা যায় না, এই অরণ্যে কেন তিনি এসেছেন? তবে রাজা দশরথ কি ভাবে প্রাণধারণ করে আছেন? দুঃখী রাজা হঠাৎ লোকান্তরিত হননি তো? হে সৌম্যদর্শন, বালকের শাসনাধীন চিরন্তন রাজ্যটি বিনষ্ট হয়নি তো? হে সত্যপরাক্রম, তুমি পিতার সেবা করছ তো? কচ্চিৎ সৌম্য ন তে রাজ্যং ভ্রষ্টং বালস্য শাশ্বতম্। কচ্চিচ্ছুশ্রূষসে তাত পিতুঃ সত্যপরাক্রম।।
রামের জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। রাজসূয় ও অশ্বমেধযজ্ঞকর্ত্তা ধর্মে স্থিরমতি,সত্যপ্রতিজ্ঞ রাজা দশরথ, কুশলে আছেন তো? সেই বিদ্বান ব্রাহ্মণ,সতত ধর্মবুদ্ধি যাঁর, মহাপ্রভাবশালী ইক্ষ্বাকুকুলের মহান উপাধ্যায় (মহর্ষি বশিষ্ঠ) যথোচিত সম্মানিত হন? দেবী কৌশল্যা ও পুত্রবতী সুমিত্রা? দেবী কৈকেয়ী সুখী হয়েছেন, তিনি আনন্দে আছেন তো? বিনয়ী, সৎকুলজাত, বহুশাস্ত্রে পারঙ্গম, অসূয়াহীন, অন্তর্দ্রষ্টা পুরোহিতের প্রতি, ভরত, সদ্ব্যবহার প্রদর্শন করেন তো? অগ্নিকার্যে (হোম) যুক্ত, সে বিষয়ে অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান, সরলমতি, হোতাগণ যথাসময়ে হুত ও হবনীয় বিষয়সম্বন্ধে অবহিত করেন ভরতকে? ভরত দেবগণ, পিতৃগণ, ভৃত্যবর্গ, গুরুগণ, পিতৃতুল্য বৃদ্ধদের, বৈদ্যগণ ও ব্রাহ্মণগণকে সম্মান প্রদর্শন করেন তো?রামের আরও প্রশ্ন,ভরত কী শর ও অস্ত্রবিদ্যাবিদ, অর্থবিদ্যাবিশারদ, সেই উপাধ্যায় সুধন্বাকে, মান্যতা দেন? নিজের তুল্য বীর, বহুশাস্ত্রজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, কুলীন, ইঙ্গিতজ্ঞ (শারীরিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে মনোভাব জ্ঞাপনে ও অবহিত হতে সক্ষম) ব্যক্তিগণকে, ভরত, মন্ত্রীপদের দায়িত্ব দিয়েছেন কি না? সুন্দরভাবে মন্ত্রণার গোপনীয়তা রক্ষা করতে সক্ষম, মন্ত্রণাবিষয়ে অভিজ্ঞ, বহুশাস্ত্রবিদ মন্ত্রীদের মন্ত্রণা হল রাজাদের বিজয়ের মূল।

ভরত কখনও নিদ্রার বশীভূত হয়ে অবস্থান করেন না তো? যথাসময়ে জেগে ওঠেন তো? শেষ রাতে অর্থ চিন্তা হয় তো? ভরত কখনও একাকী কখনও বা বহুজনের সঙ্গে মন্ত্রণা করেন কী? তাঁর মন্ত্রণা রাষ্ট্রমধ্যে প্রকাশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে না তো? উদ্দেশ্যসম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে প্রারম্ভে লঘুভাবে, পরিণামে মহাফলপ্রদ কাজটি দ্রুত আরম্ভ করেন তিনি? কাজটি রূপায়ণে বিলম্ব করেন না তো? কখনও ভরতের কোন শুভ কাজ, কোনও পরিসমাপ্ত কাজ বা কর্তব্যবিষয়ে ভাবি পরিকল্পনা, অন্য রাজারা জানতে পারেন না তো? রাম আশা করেন, অন্য কেউ, তর্ক, যুক্তি প্রভৃতির অবতারণা করে,অমাত্যদের সঙ্গে ভরতের মন্ত্রণা,জানতে পারেননি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৯: আধুনিক যুগে দাবানলের ফলে বনদহনের সঙ্গে খাণ্ডব বনদহনের সাদৃশ্য আছে কী?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৩: মা সারদার সঙ্গে সরলাদেবীর কাশীভ্রমণ

রাম মনে করেন, ভরত নিশ্চয়ই সহস্র মূর্খদের অপেক্ষা একজন পণ্ডিতকে ভরসা করেন। কারণ অর্থসঙ্কটের সময়ে, একজন পণ্ডিত মহৎ উপকার সাধন করে থাকেন। রাজা যদি সহস্র অথবা দশ সহস্র মূর্খব্যক্তিকে কাজে নিযুক্ত করেন, তাঁদের কাছ থেকে কোন সহায়তাই পাবেন না তিনি। একজন মেধাবী, বীর, নিপুণ, বিচক্ষণ অমাত্য, রাজা বা রাজপুত্রের মহৎ সমৃদ্ধি সাধন করেন। ভরত উত্তম, মধ্যম, অধম কার্যভেদে যথাক্রমে উত্তম, মধ্যম ও অধমশ্রেণির ভৃত্যদের নিয়োগ করেন তো? রামের প্রত্যাশা, ভরত নিশ্চয়ই যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, যাঁরা পিতৃপিতামহক্রমে সৎপরম্পরার অধিকারী এমন অমাত্যদের সর্বোত্তম রাজকার্যে নিযুক্ত করেছেন। রাম, কৈকেয়ীপুত্র ভরতের কাছে আশা করেন, ভরত উগ্র দণ্ডপ্রয়োগ করে, প্রজাদের উত্যক্ত করে তোলেননি। মন্ত্রীগণ তাঁর কাজের দর্শক মাত্র নন।

রামের বিশ্বাস, যাজকরা পতিতবৎ ভরতকে ঘৃণা করেন না, যেমন বহু উপহারগ্রহীতার অদাতা কামী পুরুষকে নারীরা ঘৃণা করেন। (রোগবৃদ্ধিকর) উপায়োদ্ভাবনে নিপুণ বৈদ্য, একজন ক্ষতিকারক ভৃত্য এবং ঐশ্বর্যলোলুপ বীরকে যে রাজা হত্যা করেন না, তিনি তাদের দ্বারাই নিহত হন। ভরত কী কোন সন্তুষ্ট, বীর, ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমান, পবিত্র-হৃদয়, সৎকুলজাত, অনুগত, সুদক্ষ ব্যক্তিকে সেনাপতিপদে নিযুক্ত করেছেন? বলশালী, যুদ্ধবিদ্যাবিদ,যাঁদের অবদান পরীক্ষিত এমন প্রধান শৌর্যশালী যোদ্ধৃবৃন্দদের যথোচিত মর্যাদায় সম্মানিত করেছেন তো? ভরত, সৈন্যদের যথাপ্রাপ্য দৈনিক রসদ ও বেতন, যথাসময়ে প্রদান করেন তো? বিলম্ব হয় না তো? যথাকালে রসদ ও বেতন না পেলে, তাঁরা প্রভুর প্রতি কুপিত হন, বিরুদ্ধাচারণ করেন,ফলে মহা অনর্থের সূচনা হয়। ভরতের নিকটতম জ্ঞাতিগণ তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত আছেন? তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভরতের জন্য প্রাণপরিত্যাগেও কুণ্ঠিত নন তো? জনপদবাসীদের মধ্যে বিদ্বান, কর্মদক্ষ, প্রতিভাধর, যথোক্তবক্তা, কোনও ব্যক্তিকে দূতরূপে বরণ করা হয়েছে কী? পরস্পরের অপরিচিত এমন তিনজন গুপ্তচরের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের অষ্টাদশ ও স্বপক্ষের পঞ্চদশ ব্যক্তিকে, ভরত, বিশেষভাবে পরীক্ষা করেন তো?রামচন্দ্রের প্রশাসনবিষয়ে আরও অনেক জিজ্ঞাস্য আছে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৬: পরাগপাখি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১১: বিপদ যখন আসে

রামের বিশ্বাস, অরিন্দম ভরত নিশ্চয়ই, সেই দুর্বল শত্রুদের অবহেলা করেন না, যাঁরা একদা বিতাড়িত হয়েও আবার ফিরে এসেছেন? ভরতের প্রশাসনের প্রতি রামের আশা, লোকায়ত দর্শনে বিশ্বাসী (চার্বাকপন্থী) বিষয়াভিলাষী ব্রাহ্মণ,যাঁরা মনকে বিভ্রান্ত করতে কুশল, অপরিণতবুদ্ধি অথচ নিজেদের পণ্ডিত মনে করেন এমন ব্রাহ্মণদের, ভরত নিশ্চয়ই সেবা করেন না। এই দুর্বুদ্ধি ব্রাহ্মণরা, প্রধান ধর্মশাস্ত্রগুলি (বেদ) বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আন্বীক্ষিকী বা তর্কবিদ্যার আশ্রয় নিয়ে অর্থহীন মতবাদ প্রকাশ করতে উদ্যোগী হন।

রামের উদ্বেগ পিতৃপুরুষের বাসভূমি, সার্থকনামা যে নগরী, যার সুদৃঢ় দ্বারদেশ হস্তী-অশ্ব-রথে সমাকীর্ণ, যেখানে স্বকর্মে নিরত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা বিরাজমান, জিতেন্দ্রিয় মহোৎসাহী সহস্র সহস্র আর্যদের বাস সেখানে এবং যে নগরী বিবিধ প্রাসাদে পরিপূর্ণা, বৈদ্যজন অধ্যুষিতা সেই উদীয়মানা সমৃদ্ধা অযোধ্যানগরী ভরত রক্ষা করছেন তো? সেই জনপদের শোভা বর্ধন করছে শত শত চৈত্য, যেখানে নরনারীরা, নিবিষ্ট চিত্তে বসবাস করছেন, দেবালয়গুলি আচ্ছাদিত পানীয় জলসংরক্ষণের ব্যবস্থাযুক্ত ও তড়াগসমন্বিত, নরনারীরা সেখানে সদা প্রফুল্ল ও স্থানটি সামাজিক উৎসবমুখর। যার সীমানাপর্যন্ত সুন্দরভাবে কর্ষিত, যে স্থানটি পর্যাপ্ত পশুতে পরিপূর্ণ এবং হিংসাবর্জিত, যেখানে ভূমি বর্ষণনির্ভর নয়, নদীজলনির্ভর, হিংস্রপশুহীন, নির্ভয়, খনিসমৃদ্ধ সেই স্থান যেখানে কোন পাপিষ্ঠ জন নেই, পূর্বপুরুষরা যাকে রক্ষা করেছেন, সেই সুসমৃদ্ধ জনপদের অধিবাসীরা সুখে আছেন তো? কৃষি ও পশুপালন যাঁদের জীবিকা তাঁদের প্রতি ভরত সন্তুষ্ট আছেন? কারণ সাম্প্রতিককালে কৃষিকাজ ও পশুপালন করে মানুষ সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে থাকেন। রাম বিশেষভাবে জানতে উৎসুক হলেন, ভরত তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণে যত্নশীল পালনকর্তা হয়ে উঠেছেন তো?কারণ ধর্মানুসারে রাজ্যের প্রজাদের সুরক্ষাপ্রদান রাজার কর্তব্য। আর নারীদের ক্ষেত্রে? ভরত তাঁদের সান্ত্বনাদান করেন এবং সুরক্ষিত রাখেন? রাম অবশ্য বিশ্বাস করেন, নারীদের বাক্য শ্রদ্ধাসহকারে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই, তাঁদের কাছে গুপ্ত তথ্য প্রকাশ না করাই শ্রেয়। হস্তীদের আস্তানা যে বনে সেটি সুরক্ষিত আছে তো? ধেনুগুলি স্থিতাবস্থায় আছে তো?রামের আশা,ভরতের যেন বর্তমান হস্তিনী, হস্তী ও অশ্ব প্রভৃতির সংখ্যায় পরিতৃপ্তিবোধ না হয়।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৬: সিলেটে দেখা মণিপুরী নাচ কবির নৃত্য ভাবনাকে উস্কে দিয়েছিল

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

রাম,ভরতকে প্রজাদের প্রতি ব্যবহারবিধি-পালনবিষয়ে,অবহিত করলেন। প্রত্যহ পূর্বাহ্নে রাজবেশে সজ্জিত হয়ে, প্রধান রাজপথে, রাজপুত্র ভরত, প্রজাসাধারণকে দর্শনদান করেন কী? কর্মচারীবৃন্দ যেন শঙ্কাহীন, এই অবস্থায়, দৃষ্টিগোচর হয় না তো? বা তাঁরা দৃষ্টির অন্তরালে থাকে না তো? রামের অভিমত, এ বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়। রামের লক্ষ্য সবদিকে। দুর্গগুলি ধন, ধান্য, অস্ত্র, জল, যন্ত্র, শিল্পী ও ধনুর্দ্ধরগণে পরিপূর্ণ আছে তো? ভরতের অল্প ব্যয় অপেক্ষা আয়ের মাত্রা বিপুল তো? কোষাগারের অর্থ অপাত্রে ন্যস্ত হয় না তো? রাম আশা করেন, ভরত দেবতা, পিতৃপুরুষ, ব্রাহ্মণ, অতিথি, যোদ্ধা, ও মিত্রগণের জন্যে ধন ব্যয় করছেন কী? পবিত্রহৃদয়, মিথ্যাপবাদে দোষী এমন আর্যব্যক্তিকে, শাস্ত্রজ্ঞ বিচারকের অসাক্ষাতে লোভবশত, ভরত বধ করেন না তো?যদি গৃহীত কোনও ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয় এবং যথাসময়ে তিনি কারণসহ দোষী প্রমাণিত হন,তাহলে ধনলোভবশত তাঁকে কখনও মুক্ত করা উচিত নয়। ভরতের বহুশাস্ত্রজ্ঞানী মন্ত্রীরা ধনাঢ্য ও দুর্বল ব্যক্তির বিবাদের বিপন্নদশা তাচ্ছিল্যভরে পর্যবেক্ষণ করেন না তো? রামের অনুভব হল, শুধুমাত্র সুখানুভবের কারণে, যাঁদের মিথ্যাপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাঁদের অশ্রুজলে, দণ্ডদাতার পুত্র ও পশুসমূহ বিনষ্ট হয়। রাম জানতে চাইলেন, ভরত কী বৃদ্ধ, বালক, প্রধান চিকিৎসকদের দান, সপ্রেম হৃদয়, সস্নেহ বাক্য, এই তিনটি উপায়ে আপ্যায়িত করেন? গুরুগণ, বৃদ্ধদের, তাপসগণ, দেবতা, তিথি, চৈত্যগুলিতে ও সিদ্ধার্থ ব্রাহ্মণদের, ভরত প্রণতি নিবেদন করেন?

রাম, ভরতের ত্রিবর্গপ্রীতির বিষয়ে জানতে উৎসাহী। ভরতের রাজকীয় জীবনচর্চায় ধর্ম, অর্থ, কাম এই ত্রিবর্গের মধ্যে কখনও অর্থ, ধর্ম ও কামের, কখনও ধর্ম বাকি দুটির, কখনও বা বিষয়াসক্তিজনিত সন্তোষলাভের জন্য কামনা, ধর্ম ও অর্থের বাধা হয় না তো? ভরত, ত্রিবর্গ অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কামের যথাসময়ে সমবিভাগের মাধ্যমে সমানভাবে সেবা করেন কী? পুরবাসী ও জনপদবাসীদের সঙ্গে সর্বশাস্ত্রবিদ ব্রাহ্মণগণ ভরতের কল্যাণ কামনা করেন? নাস্তিকতা, মিথ্যাচার, ক্রোধ, বিভ্রান্তি, দীর্ঘসূত্রতা, জ্ঞানীদের অদর্শনজনিত অনবধানতা, আলস্য, পঞ্চেন্দ্রিয়ের বশবর্তিতা, রাজ্য বিষয়ে একাকী চিন্তন (মন্ত্রীদের পরামর্শ ব্যতীত), বিষয়সম্বন্ধে অবহিত নন এমন ব্যক্তিদের পরামর্শগ্রহণ, নির্দ্ধারিত কার্যের আরম্ভের উদ্যোগহীনতা, মন্ত্রণার গোপনীয়তা ভঙ্গ, মাঙ্গলিক কার্যের অভাব, (নিরপেক্ষভাবে) সর্ববিষয়ে একযোগে উদ্যম, ভরত এই চতুর্দশ প্রকার রাজকীয় ত্রুটিগুলি হতে মুক্ত হয়েছেন তো?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৬: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি

ভরতের প্রতি জ্যেষ্ঠ রামের প্রশ্ন, দশপঞ্চচতুর্ব্বর্গান্ সপ্তবর্গঞ্চ তত্ত্বতঃ। অষ্টবর্গং ত্রিবর্গঞ্চ বিদ্যাস্তিস্রশ্চ রাঘব।। ইন্দ্রিয়াণাং জয়ং বুদ্ধ্যাং ষাড্গুণ্যঞ্চ দৈবমানুষম্। কৃত্যং বিংশতিবর্গঞ্চ তথা দশবর্গ অর্থাৎ মৃগয়া, অক্ষক্রীড়া, দিবানিদ্রা, পরিবাদ, নারীদের প্রতি অত্যাসক্তি, নৃত্য, গীত, বাদ্যে অতিরিক্ত আকর্ষণ, উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ (এই দশ প্রকার কামজ ব্যসনজনিত দোষ) পঞ্চবর্গ (পাঁচটি দুর্গ যথা জল দুর্গ, গিরি দুর্গ, নৃদুর্গ, বৃক্ষাচ্ছাদিত দুর্গ, ধন্বদুর্গ অর্থাৎ মরুভূমিতে শস্যহীনস্থানে নির্মিত দুর্গ), চতুর্বর্গ (সাম, দান, দণ্ড, ভেদ), সপ্তবর্গ (রাজা, অমাত্য, রাষ্ট্র, দুর্গ, কোশ, বল ও সুহৃৎ প্রভৃতি রাজ্যের সপ্ত অঙ্গ), অষ্টবর্গ (পৈশুন্য অর্থাৎ অবিজ্ঞাত দোষাবিষ্কারের প্রবণতা, সাহস অর্থাৎ সাধুব্যক্তির বধ বন্ধনাদি অত্যাচার, দ্রোহ অর্থাৎ গুপ্তহত্যা, ঈর্ষা অর্থাৎ অন্যদের গুণ সহ্য করতে না পারা, অসূয়া অর্থাৎ অন্যদের গুণের মধ্যে দোষাবিষ্কারের প্রবণতা, সৎব্যক্তির নিন্দা, বাগদণ্ড অর্থাৎ পরুষবাক্য দ্বারা নির্যাতন, দণ্ডপারুষ্য অর্থাৎ শারীরিক নির্যাতন প্রভৃতি), ধর্ম, অর্থ, কাম এই ত্রিবর্গ, ত্রিবিদ্যা (বেদবিদ্যা, দণ্ড ও বার্তা অর্থাৎ কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্যবিষয়ক জ্ঞান), এগুলি অবগত হয়ে, ইন্দ্রিয়জয়ের বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করে, দৈব (অগ্নিকাণ্ড, জলোচ্ছ্বাস, ব্যাধির প্রাদুর্ভাব, দুর্ভিক্ষ ও মড়ক) ও লৌকিক (রাজপুরুষ হতে, চৌর্যবৃত্তিহেতু, শত্রু হতে, রাজার প্রিয় ব্যক্তি হতে, স্বয়ং রাজা হতে) প্রতিকূলতাগুলি ও ষাড্গুণ্য (সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধীভাব, সংশ্রয়) — এগুলি সম্বন্ধে ভরতের সম্যক জ্ঞান আছে তো? বিংশতিবর্গ (যেগুলির অন্তর্গত বালক, বৃদ্ধ, দীর্ঘদিন ধরে রোগাক্রান্ত, জ্ঞাতিদের দ্বারা বহিষ্কৃত, ভীরু অর্থাৎ কাপুরুষ, ভীরুদের দ্বারা পরিবৃত ব্যক্তি, লুব্ধ, লুব্ধজনপরিবৃত, যিনি অমাত্য ও অন্যান্যদের বহিষ্কার করেছেন, দোলাচলচিত্ত যার, যিনি দেবতা ও ব্রাহ্মণদের নিন্দা করেন, যিনি বৈষয়িক আনন্দে মত্ত, যিনি ভাগ্যবিড়ম্বিত ব্যক্তি, যাঁরা সব বিষয়েই নিয়তিকে দোষারোপ করেন, যিনি দুর্ভিক্ষের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত, সৈন্য ক্ষয়ের ফলে বিপন্ন, বহুদিনের জন্য প্রবাসী ব্যক্তি, যাঁর অনেক শত্রু, যিনি দুঃসময়ের শিকার, যিনি সত্যধর্মনিষ্ঠ নন) এনাদের সঙ্গে কখনও সন্ধি নয়, এঁরা সর্বদাই বিগ্রহের অর্থাৎ বিরোধিতার যোগ্য। প্রজাপুঞ্জ, দ্বাদশ রাজমণ্ডল, পঞ্চপ্রকার যুদ্ধযাত্রা (ব্যূহরচনা প্রভৃতি), দণ্ডবিধি (বিভেদ সৃষ্টি প্রভৃতি) সন্ধি ও বিগ্রহ দ্বৈধীভাব, সংশ্রয়সম্বন্ধে ভরতের জ্ঞান আছে তো? এই বিষয়গুলি রাজার অনুমোদনসাপেক্ষ যে। ভরত, শাস্ত্রনির্দেশিত তিন অথবা চার জন মন্ত্রীর সঙ্গে একযোগে বা ভিন্নভাবে মন্ত্রণা করে থাকেন কী? ভরতের বেদজ্ঞান সফল হয়েছে? রাজকর্মগুলি সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে তো? ভরতের দারপরিগ্রহ অর্থাৎ বিবাহ ও শাস্ত্রজ্ঞান সফল হয়েছে তো? ভরতের বুদ্ধি, আয়ু ও যশ বৃদ্ধি করে তো? ধর্ম, অর্থ ও কাম তাঁর বুদ্ধির সহযোগী হয়েছে তো? পুরুষানুক্রমে পিতৃপিতামহের সৎ ও শুভকরী বৃত্তি, ভরত, অবলম্বন করেছেন? সুস্বাদু ভোজ্য কখনও একাকী গ্রহণীয় নয়, যাঁরা এর প্রত্যাশা করেন ভরত, সেই মিত্রদের ভোজ্য প্রদান করেন? পরিশেষে ভরতের প্রতি রামের উপদেশ, বিদ্বান অর্থাৎ বিচক্ষণ রাজা সমগ্র পৃথিবী লাভ করে ধর্মানুসারে প্রজাদের শাসন ও পরিপালন করেন। অন্তিমকালে তিনি ইহলোকচ্যুত হয়ে স্বর্গলাভ করেন।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে ভরতের সঙ্গে বনবাসী রামের সাক্ষাৎ, স্নেহপূর্ণ আলিঙ্গনে ধরা দিলেন ভরত। ভরতের ম্লানমুখ, তাঁর দুঃখদীর্ণ চেহারা দেখে প্রাথমিকভাবে পিতার জন্যে চিন্তাগ্রস্ত হলেন রাম। মায়েদের জন্যেও রামের চিন্তার শেষ নেই। ভরতের পারিপার্শ্বিকে যাঁরা থাকেন, যেমন গুরুগণ, ভৃত্যবর্গ, পিতৃগণ, পিতৃতুল্য বৃদ্ধ, সম্মানীয় বৈদ্যগণ, অস্ত্রবিদ,অর্থবিশারদ ও ব্রাহ্মণদের প্রতি ভরত যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করেন কি না সে বিষয়ে রামের হয়তো ঘোর সন্দেহ আছে। তাই না হলে, তাঁর মনে প্রশ্নের উদ্রেক হবে কেন? আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রপরিচালনায় মন্ত্রণার গুরুত্ব সম্বন্ধে ভাবিত হন রাম, মন্ত্রণার গোপনীয়তা তাঁর চিন্তার বিষয়। সেনাপতি, মন্ত্রণাদাতা অমাত্য, রাজার রাজকার্য পরিচালনায় সহযোদ্ধাদের প্রতি ভরত দায়িত্বশীল কি না এই প্রশ্ন জেগেছে রামের মনে।

ভরত, জনপদবাসী ও ব্রাহ্মণদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছেন কি না সে বিষয়ে রামের গভীর উদ্বেগ।মন্ত্রীদের সঠিক নিয়োগ হয়েছে কি না, তাই নিয়ে রামের চিন্তার অন্ত নেই। ভরত আলস্যমুক্ত হয়ে রাজকার্য সম্পন্ন করেন কিনা তাঁর জিজ্ঞাসার বিষয়। ভরতের শাসনাধীন প্রজারা জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কি না,সেটি জানার জন্যে রামের গভীর আগ্রহ। ভরত, সেনাপতিত্বে কোনও সৎ, দায়িত্বশীল, যুদ্ধবিদ্যাবিদকে নিয়োগ করেছেন কি না, রাম সে বিষয়েও জানতে চাইলেন। শুধু পদমর্যাদায় অভিষিক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে নয়, রাম সাধারণ সৈন্যদের জন্যেও চিন্তা করেন। তাঁরা যেন তাঁদের প্রাপ্য হতে বঞ্চিত না হয়। রাম ভরতকে, মনে করিয়ে দিয়েছেন, দৌত্যে সঠিক ব্যক্তির নির্বাচন প্রয়োজন। রাজ্য শাসনবিষয়ে অযোধ্যার ভাবি প্রশাসক রামের অশেষ কৌতূহল।রামের প্রশ্ন অনুসরণ করে এক দক্ষ প্রশাসকের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। চিত্রকূটের প্রাকৃতিক পরিবেশে রাজ্যপাট হারিয়ে নিরাসক্ত, ভরতের সম্মুখীন রাম। তাঁর প্রশ্নগুলিতে, সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তার সমাহার লক্ষ্য করা যায়, সম্মুখে এসে দাঁড়ান বাস্তবাভিমুখী অযোধ্যার এক দায়িত্বশীল প্রশাসক। সেই প্রশাসক সর্বদাই নিজের রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডল সুরক্ষিত রাখতে ব্যাকুল, সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ রাজা, অমাত্য, রাষ্ট্র, দুর্গ, কোশ, বল ও সুহৃদবিষয়ে রামের জ্ঞানের স্বচ্ছতার দরুণ একজন আদর্শ রাজার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন রামচন্দ্র।

ভরতের প্রতি প্রশ্নগুলি যেন রামের অনুপস্থিতিতে রাজ্য শাসনবিষয়ের হুঁশিয়ারি। যেমনটি না হলে রাজপদে স্থায়ীভাবে টিকে থাকা, বা রাজ্যের অস্তিত্বের স্থায়িত্ব প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় একদা যুবরাজপদে প্রত্যাখ্যাত জ্যেষ্ঠ কুমার, অযোধ্যা নগরীর পিছুটানমুক্ত অরণ্যবাসী রাম কিন্তু,অযোধ্যার প্রতি সমান দায়িত্বশীল রয়েছেন আজও।নিরাসক্তির আবরণে লুকিয়ে আছে রাজকীয় পরম্পরাগত দায়বদ্ধতাপালনের অঙ্গীকার। দক্ষ, বিচক্ষণ, দূরদর্শী, চিন্তাশীল প্রশাসক রামের রাজ্যশাসন বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রকাশ মনোমুগ্ধকর। স্নেহশীল, ভ্রাতৃবৎসল, পিতৃভক্ত, রাজ্যাধিকারলাভে বঞ্চিত রামের সুদক্ষ প্রশাসকপদে পুনরভিষেকের প্রস্তুতি হয়তো প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে যায়। উত্থান-পতনের, চাপান-উতর চলতে থাকে রামের জীবনে। এ সব কিছু সত্ত্বেও ভাবি রামরাজ্যের স্রষ্টা রাম, যেন প্রশ্নচ্ছলে, অযোধ্যার বর্তমান প্রশাসক ভরতের রাজ্যশাসনরীতিবিষয়ে শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content