ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
উচ্চমাধ্যমিকের পরবর্তী শিক্ষাস্তরে কলা বিভাগে বিষয় নির্বাচন নিয়ে এক ভাবনা জাগে। ছাত্রছাত্রীদের নিরন্তর সংশয় দূর করতেই, আমি ‘দর্শন’ বা ‘ফিলোসফি’—এই বিষয় নিয়ে কিছু আলোচনা করছি। আমি বিশ্বাস করি দর্শন আগামীতে আশার আলো দেখাতে পারে।
দর্শন বা ফিলোসফি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বিষয়। ‘ফিলোসফি’ শব্দের অর্থ হল জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ। এটি সব শাস্ত্রের ধাত্রী। অধিকাংশ বিষয়েরই দর্শন থাকে, যেমন ফিলোসফি অফ ম্যাথামেটিক্স, ফিলোসফি অফ সায়েন্স ইত্যাদি। বিজ্ঞানের যেখানে শেষ, সেখানেই দর্শনের শুরু। জানা যায়, সুদীর্ঘ অতীতে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের প্রায় সকলেই দার্শনিক ছিলেন। দর্শন এক অনুসন্ধিৎসু মন তৈরি করে। আত্মজিজ্ঞাসা তথা জীবন জিজ্ঞাসার অনুসন্ধানই দর্শন। অনেকের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে দর্শন একটি মৃতপ্রায় বিষয়, এটি মূলত ঈশ্বর, পরজন্ম নিয়েই বুঝি আলোচনা করে। সাধারণ ধারণায় বলা হয় দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে দর্শনের কোনও যোগ নেই তাই দর্শনপাঠের ভবিষ্যৎ মূল্য নেই। এটি একটি ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ। নব নব উন্মেষশালিনী জ্ঞানই দর্শনের দান। দর্শনপাঠের বিরাট উপযোগিতা জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে।
দর্শন আমাদের জ্ঞানপিপাসা মেটায়, আমাদের চিন্তন শক্তির বৃদ্ধি ঘটিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। এই শাস্ত্র সাধারণ দৈনন্দিন ও জটিল সমস্যা সমাধানের পথ দেখায় ও আমাদের বিচার এবং অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত করে, এককথায় একটি অনুসন্ধিৎসু মন গঠন করে। দর্শন আমাদের লেখার ক্ষমতা, বাচনিক ও বিশ্লেষণী দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। দর্শনের শিক্ষা আমাদের সৃজনশীল, যৌক্তিক, বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ও নৈতিক হতে শেখায়।
দর্শনের মতো উপযোগী একটি বিষয় নিয়ে পড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সফল হওয়া যায়।
দর্শন নিয়ে পড়ে উচ্চশিক্ষায় যাওয়া যায়—এম.এ করে তারপর গবেষণার সুযোগ থাকছেই যারা একাডেমিক দিকে থাকতে আগ্রহী। অনেকে হয়তো ভাবতে পারে গবেষণার ক্ষেত্রে খরচ অনেক, এই প্রসঙ্গে বলি প্রচুর স্কলারশিপ-এর ব্যবস্থা আছে যেমন : NET JRF, SRF, single Girl child scholarship, Maulana Azad National fellowship, National fellowhip for SC, ST, OBC, State Level JRF, Swami Vivekananda merit cum means scholarship ইত্যাদি। বিদেশেও স্কলারশিপ নিয়ে গবেষণা করতে যাওয়ার সুযোগ আছে।
নেট/সেট পরীক্ষা দিয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনার অবকাশ তো আছেই। এ ক্ষেত্রে বলি, নেট-সেট-এ অনার্স পত্র ছাড়াও একটি জেনারেল পত্র থাকে, যেখানে লজিক্যাল রিজনিং-এর প্রশ্ন থাকে, যা দর্শনশাস্ত্রের ছেলেমেয়েদের একটু সুবিধাজনক জায়গা কারণ তারা শাস্ত্রের অন্তর্গত ‘লজিক’ এই বিষয়টি পড়ে।
স্কুল শিক্ষকতার পথও খোলা থাকছে, নবম ও দশম শ্রেণিতে লজিক বিষয় থাকে, এগারো-বারো ক্লাসে ফিলোসফি তো থাকেই। তাই এসএসসি, পিএসসি এসবের মাধ্যমে স্কুলে পড়ানোর সুযোগ থাকছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা তার অন্তর্গত বিভিন্ন সেন্টারে অনেক রিসার্চ প্রজেক্ট চলে, সেসব জায়গায় প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও কাজের সুযোগ হতে পারে।
দর্শন পড়ে তারপর সাংবাদিকতায় আসা যায়। দর্শন যেহেতু বিচার-বিশ্লেষণ, লেখনশক্তি, বাচনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে তাই ফিলোসফি পড়ে এই পেশায় এলে সফল হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
ফিলোসফি পড়লে সাইকোলজি পড়তেই হয়, তাই এই শাস্ত্র পরেও সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং-এ আসা যায়। ফিলোসফি গ্র্যাজুয়েশন-এ পড়ে, পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়সীমার কাউন্সেলিং ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক কোর্স করে জীবনে প্রতিষ্ঠার সুযোগ। অনেক কাউন্সেলিং কোর্স-এ ভর্তির ক্ষেত্রে যোগ্যতামান নির্ধারণে যে সব বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী চাওয়া হয়, ফিলসফি তার মধ্যে অন্যতম।
ফিলসফি পড়ে, পরে কেউ লাইব্রেরি সায়েন্স পড়তে পারে, সেক্ষেত্রে ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে শুরু করে অনেক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা আছে।
দর্শনের ছাত্রছাত্রীরা আইনি পেশায় গেলে যথেষ্ট সফল হওয়ার কথা। নিয়ম, নৈতিকতা, যুক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ, বাচনিক দক্ষতা এ সবই আমরা দর্শন থেকে শিখি যা আইনি পেশায় গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তি বিজ্ঞান আমাদের ভালো-মন্দ যুক্তির মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায় যা আইনি পেশায় খুব প্রয়োজনীয়।
দর্শনপাঠের পর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ব্যাংকিং ও রেলওয়ে সার্ভিসেও আসার পথ খোলা থাকে। অনেক ব্যাংকে অফিসার বা ম্যানেজার পদ-এ কাজের সুযোগ আছে। রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টে অনেক স্তরের কর্মসংস্থানের অবকাশ থাকে এবং সুবিধেও অনেক।
প্রশাসনিক কাজ যথা আইএএস, আইপিএস, ডব্লুবিসিএস, ডব্লুবিপিএস, আইএফএস (IAS, IPS, WBCS WBPS, IFS)
প্রশাসনিক কাজে আসার ও সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এইসব কর্মক্ষেত্রে আসার জন্য যে পরীক্ষা হয় সেখানে নিজেদের অনার্স পত্র যেমন থাকে, পাশাপাশি একটি জেনারেল পত্র ও থাকে যেখানে লজিক্যাল রিজনিং (logical reasoning)-এর প্রশ্ন থাকে যা ফিলোসফি পড়লে সহজেই উত্তর করতে পারার কথা। তাছাড়া বাচনিক ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা এই পেশাগুলির ক্ষেত্রেও খুব প্রয়োজনীয় যা দর্শন শাস্ত্র থেকে লাভ করি।
সমাজসেবামূলক কাজকে পেশা হিসেবে নিতে চায় যারা তারাও ফিলোসফি পড়ার পরবর্তীতে এই ক্ষেত্রে আসতে পারে, বিভিন্ন এনজিও-তে কর্মসংস্থান হতে পারে।
কেউ সফল ব্যবসায়ীও হয়ে উঠতে পারে। নৈতিকতা, বাচনিক দক্ষতা, বিচার ক্ষমতা—এ সবই একজন সফল ব্যবসায়ী হতে সহায়তা করে।
পরিশেষে বলা যায়, দর্শন বা ফিলোসফি মোটেও মৃতপ্রায় কোনও বিষয় নয় বরং মৃতপ্রায় চেতনাকে জগৎ ও জীবনমুখী করে তোলে। জীবনে দর্শনের গভীর তাৎপর্য। চাকরি করে অর্থ উপার্জনই তো শুধু এক প্রাণময় জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। দর্শনের শিক্ষা মানবিক হতে শেখায় এবং সর্বতোভাবে জীবনকে উন্নীত করে। সব মনীষীই আসলে দার্শনিক। দর্শনকে বিষয় হিসেবে নির্বাচন করলে ছাত্র-ছাত্রীরা এক উন্নত ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সন্ধান পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।