ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
সারনাথে ঋষিপত্তন মৃগদাবে বুদ্ধদেব পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের নিকট তাঁর প্রথম ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন যা ‘ধর্মচক্রপ্রবর্তনসূত্র’ নামে পরিচিত। প্রথম ধর্মদেশনাতে তিনি চারি আর্যসত্য এবং মধ্যমপন্থা সম্বন্ধে বলেছিলেন। আমরা সংক্ষেপে চারি আর্যসত্য সম্পর্কে আলোচনা করতে চলেছি।
চারি আর্যসত্যের মধ্যেই বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শনের মূল কথা নিহিত আছে। এই চারি আর্যসত্যকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চারি নিদানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেমন: রোগ, রোগের কারণ, রোগের উপশম, রোগ উপশমের উপায়। মানবজীবনের জন্মজন্মান্তর ধরে বহমান দুঃখ হল রোগতুল্য, দুঃখের কারণ হল রোগের কারণ সদৃশ, দুঃখ নিবৃত্তি হল রোগ উপশমতুল্য, দুঃখনিবৃত্তির উপায় হল রোগ উপশমের উপায় সদৃশ। দুঃখকেই প্রথম ও প্রধান সত্য বলা হয়েছে। কারণ দুঃখ অপেক্ষা জীবজগতে বড় কোন সত্য নেই। এই দুঃখের কারণ বা হেতু আছে। হেতু ব্যতীত কোন কিছুর উৎপত্তি সম্ভব নয়। দুঃখের হেতু হল দ্বিতীয় প্রধান সত্য। দুঃখ যেহেতু হেতু প্রভব অর্থাৎ হেতু বা কারণজাত, এই দুঃখকে ধ্বংস করা যায়, দুঃখের নিবৃত্তি আছে। ইহা তৃতীয় প্রধান সত্য। দুঃখ নিবৃত্তির উপায় কল্যাণমিত্র বুদ্ধ আবিষ্কার করেছেন এবং তা হল অষ্টাঙ্গিক মার্গ। ইহাই চতুর্থ আর্যসত্য।
প্রথম আর্যসত্য: দুঃখ
বুদ্ধদেবের মতে জগত ও জীবন দুঃখময়। ধর্মচক্রপ্রবর্তনসূত্রে বুদ্ধদেব মানবজীবনের দুঃখরাশিকে সংক্ষিপ্ত করে আটটি পর্যায়ভুক্ত করেছেন। যথা: জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ, অপ্রিয়-সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিচ্ছেদ দুঃখ, ঈপ্সিতের অপ্রাপ্তি দুঃখ, পঞ্চোপদান স্কন্ধময় এই দেহ ও মন দুঃখপূর্ণই। জন্মজন্মান্তর ধরে জীব সকল এই দুঃখ ভোগ করে আসছে। এই দুঃখ সর্বজনীন। জাতি বর্ণনির্বিশেষে, দেশকাল নির্বিশেষে কারোর দুঃখ হতে পরিত্রাণ নেই। বুদ্ধদেব জড় চেতনময় অস্তিস্ত্বকে ‘নামরূপ’ বলেছেন। নামরূপ বিধৃত সংসার নিরবচ্ছিন্নভাবে দুঃখময়। জগতে কেবল দুঃখেরই উৎপত্তি, স্থিতি ও বিলয় হচ্ছে। দুঃখ ব্যতীত অন্য কিছু উৎপন্ন হয় না, দুঃখ ব্যতীত অন্য কিছু নিরুদ্ধ হয় না।
দ্বিতীয় আর্যসত্য: দুঃখ সমুদয়
দুঃখসমুদয় বা দুঃখের কারণ হল দ্বিতীয় প্রধান আর্যসত্য। দুঃখের কারণ সম্বন্ধে বুদ্ধদেব বলেছেন -তৃষ্ণাই দুঃখের কারণ। মোহমুগ্ধ ও মোহান্ধ মানুষের সকল প্রকার কর্ম সম্পাদনের মূলে হল এই তৃষ্ণা যা মানুষকে প্রতিনিয়ত বিষয় হতে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণ করায়। যত প্রকার তৃষ্ণা আছে সেগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়—
● কাম তৃষ্ণা— বিষয় বাসনাই কাম তৃষ্ণা।
● ভব তৃষ্ণা— ভব তৃষ্ণা হল পুনর্জন্মের তৃষ্ণা।
● বিভব তৃষ্ণা— বিভব তৃষ্ণা হল উচ্ছেদবাদীর ভোগতৃষ্ণা।
তৃষ্ণোৎপত্তির কারণরূপে অবিদ্যার কথা বলা হয়েছে। অবিদ্যা হতে কিভাবে তৃষ্ণা উৎপন্ন হয় তা প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতিতে কার্যকারণ শৃঙ্খলায় ব্যাখ্যা করা আছে। এই কার্যকারণ শৃঙ্খলা হল—অবিদ্যা→ সংস্কার→বিজ্ঞান→ নামরূপ→ ষড়ায়তন→ স্পর্শ→ বেদনা→ তৃষ্ণা→ উপাদান→ ভব→ জাতি→ জরামরণ কার্যকারণ শৃঙ্খলের দ্বাদশটি অঙ্গ। তাই একে ‘দ্বাদশ নিদান’ বলা হয়। এরা কার্যকারণ শৃঙ্খল বা চক্রের আকারে সংযুক্ত হয়ে মানুষকে জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহে আবর্তিত করে। তাই এই কার্যকারণ শৃঙ্খলকে ‘ভবচক্র’ বলা হয়। এই কার্যকারণ শৃঙ্খলে যা একদিক থেকে কারণ, তাই অন্যদিক থেকে কার্য। বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় পরিভাষায় একে বলে প্রতীত্যসমুৎপাদ। প্রতীত্যসমুৎপাদ হল কোন কিছুর উপর নির্ভর করে কোন কিছুর উৎপত্তি। ভবচক্র বলে যে, মানুষের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। বৌদ্ধ দর্শনে বলা হয়েছে যে, মানুষের সমস্ত প্রকার দুঃখের কারণ তার নিজের কর্ম এবং সমস্ত কর্মের মূলে তার তৃষ্ণা এবং তৃষ্ণার মূলীভূতকারণ অবিদ্যা। মানুষের দুঃখের মূলে কোন অতিপ্রাকৃত শক্তি বা ঈশ্বরের ভূমিকা নেই।
তৃতীয় আর্যসত্য: দুঃখ নিরোধ
বুদ্ধ প্রদর্শিত তৃতীয় আর্যসত্য হল দুঃখ নিবৃত্তি। দুঃখের কারণ থাকলে দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব। তৃতীয় আর্যসত্যে আমরা পাই তৃষ্ণা থাকলে দুঃখ হয়। তৃষ্ণার উৎপত্তিতে দুঃখের উৎপত্তি হয়। আবার যা কিছু উৎপন্ন হয় তার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। দুঃখ যদি উৎপন্ন হয়ে থাকে তার বিনাশ ও সম্ভব। কারণকে দূর করলে কার্যের উৎপত্তি হবে না। রোগের জীবাণু নষ্ট করলে রোগেরও উপশম হবে। তাই তৃষ্ণার নিবৃত্তিতে দুঃখেরও নিবৃত্তি হবে। তৃতীয় আর্যসত্যের মূল কথা হল— ‘তৃষ্ণার অশেষ নিরবশেষ বিরাগ নিবৃত্তি ত্যাগ ও বিচ্ছেদ’। এখানে ‘অশেষ’ ও ‘নিরবশেষ’ কথা দুটি তাৎপর্যপূর্ণ। বিন্দুমাত্র তৃষ্ণাও যদি বর্তমান থাকে তাহলে দুঃখ নিবৃত্তি হবে না। চিত্তস্তরে জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত কর্মবীজ বেদনা বা অনুভূতির আকারে দেহস্তরে প্রকটিত হয় -যা কখন ও সুখকর কখনও দুঃখকর অনুভুতি। এই অনুভূতিকে ভোগ করলে পুরাতন তৃষ্ণার ক্ষয় হয় না বরং নতুন নতুন তৃষ্ণা পূর্বাপর তৃষ্ণার সাথে যুক্ত হয়ে তৃষ্ণার বোঝা বাড়িয়ে তোলে। এখন উৎপদ্যমান বেদনা বা অনুভূতিকে ভোগ না করে উপক্ষীণ করতে পারলেই নতুন তৃষ্ণা উৎপন্ন হবে না এবং পুরাতন তৃষ্ণা একে একে ক্ষয় হবে। অতএব, বেদনার অনুভূতির নিবৃত্তিতে তৃষ্ণার নিবৃত্তি। তৃষ্ণার নিবৃত্তিতে উপাদান নিবৃত্তি। উপাদান নিবৃত্তিতে ভব নিবৃত্তি। ভব নিবৃত্তিতে পুনর্জন্মের নিবৃত্তি। পুনর্জন্মের নিবৃত্তিতে জরামরণাদি উপশান্ত হয়ে সমূলে দুঃখের নিবৃত্তি হবে। এই দুঃখের নিরবশেষ নিবৃত্তিকে বৌদ্ধ শাস্ত্রে নির্বাণ বলা হয়েছে। ‘নির্বাণ’ শব্দের অর্থ নির্বাপণ। রাগ, দ্বেষ মোহ রূপ অগ্নির নির্বাপণ। ‘বান’ শব্দের অর্থ তৃষ্ণাও হয়। নির্বাণ তাহলে তৃষ্ণার ক্ষয়। বস্তুতঃ নির্বাণ লাভ হলে পুনর্জন্মের সম্ভাবনা থাকে না। আর এই জন্মেই পরম শান্তি পাওয়া যায়। সুতরাং, যদি দুঃখের নিবৃত্তি সূচক তৃতীয় আর্যসত্য তথা নির্বাণ না থাকত তাহলে বুদ্ধের ধর্ম দুঃখবাদী, নৈরাশ্যবাদী হত। কিন্তু কল্যাণমিত্র বুদ্ধ নির্বাণ এবং নির্বাণ লাভের পথ নির্দেশ করে প্রমাণ করেছেন তাঁর ‘ধম্ম’ আশাব্যঞ্জক ও পরম শান্তিদায়ক।
চতুর্থ আর্যসত্য: দুঃখ নিরোধ মার্গ
দুঃখ নিবৃত্তির উপায় বুদ্ধদেব আবিষ্কার করেছেন এবং তা হল অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই মার্গের আট অঙ্গ নিম্ন রূপ—
● সম্যক্ দৃষ্টি
● সম্যক্ সংকল্প
● সম্যক্ বাক্
● সম্যক্ কর্মান্ত
● সম্যক্ আজীব
● সম্যক্ ব্যায়াম্
● সম্যক্ স্মৃতি
● সম্যক্ সমাধি
সম্যক্ দৃষ্টি হল সত্য দৃষ্টি বা সত্য জ্ঞান। আত্মা এবং জগত সম্পর্কে মিথ্যা দৃষ্টি হল দুঃখের মূল কারণ। তাই নৈতিক সংস্কারের প্রথম স্তর হল সত্য দৃষ্টি বা সত্য জ্ঞান। চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অষ্টাঙ্গিক মার্গের ভিত্তিস্বরূপ। জগতের অনিত্যতা জাগতিক বস্তুর প্রতি তৃষ্ণা ও আসক্তিই যে জন্ম এবং তজ্জনিত দুঃখের কারণ — সে বিষয়ে জ্ঞানই সম্যক্ দৃষ্টি।
দ্বিতীয় মার্গ হল সম্যক্ সংকল্প। নির্বাণ লাভের জন্য কেবল সত্য জ্ঞানলাভই যথেষ্ট নয়। সত্য জ্ঞান অনুযায়ী জীবন যাপন না করলে জ্ঞান বৃথা হয়ে পড়ে। তাই জ্ঞান অনুযায়ী জীবন যাপনের সংকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিষয়ের প্রতি আসক্তি, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসা পরিত্যাগ করার সংকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সম্যক্ বাক্ হল তৃতীয় মার্গ। এর অর্থ হল বাক্য সংযম। অর্থাৎ সত্য ও প্রীতি পূর্ণ কথা বলা। মিথ্যা কথা বর্জন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন।
সম্যক্ কর্মান্ত বুদ্ধ কথিত পঞ্চশীলের অন্তর্গত। অহিংসা অর্থাৎ হিংসা বর্জন, সত্য অর্থাৎ মিথ্যাভাষণ বর্জন, অস্তেয় অর্থাৎ পরদ্রব্য অপহরণ বর্জন, ব্রহ্মচর্য পালন অর্থাৎ সকল প্রকার ব্যভিচার থেকে বিরতি এবং সুরা মাদক দ্রব্য বর্জন।
সম্যক্ আজীব বলতে বোঝায় এমনভাবে জীবন যাপন করা যাতে পঞ্চশীল লঙ্ঘিত না হয়। জীবিকা অর্জনের জন্যও হিংসা করা, মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা বর্জনীয়। নির্দোষ নিষ্পাপ জীবিকাই অবলম্বনীয়।
সম্যক্ ব্যায়াম হল একান্ত অনবদ্য সৎ মানসিক ইচ্ছা বা প্রচেষ্টা। নির্বাণ লাভের জন্য যাবতীয় কুচিন্তা দূর করতে হবে এবং মনকে সৎ চিন্তার দ্বারা পরিপূর্ণ করতে হবে।
প্রতি মুহূর্তে কায় ও মনে যে সকল অবস্থা উৎপন্ন হয় তার প্রতি অতি সজাগ দৃষ্টি দিয়ে সন্তপর্ণে সেগুলিকে মনে মনে পর্যবেক্ষণ করাই সম্যক্ স্মৃতি। জগত জীবনের অনিত্যতা, আত্মা বলে নিত্য বা শাশ্বত সত্তা নেই -এগুলি প্রতিনিয়ত স্মরণে রাখাই সম্যক্ স্মৃতি। সম্যক্ স্মৃতি কুশলকে নিয়ত জাগ্রত রাখে, অকুশল উৎপত্তির অবকাশে বাধা প্রদান করে।
সম্যক্ সমাধি হল যা সত্য ও কল্যাণকর তার নিয়ত অনুধ্যান, দৃঢ় সংকল্পের দ্বারা ইচ্ছা ও কামনা বাসনার নিয়ন্ত্রণ সমাধি লাভের পথকে সুগম করে। নিরবচ্ছিন্ন সমাধির ফলে প্রজ্ঞা লাভ হয়। প্রজ্ঞা হল চতুরার্যসত্য সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান। সমাধির চারটি স্তর আছে। প্রথম স্তরে বিতর্ক, বিচার অর্থাৎ চারটি আর্যসত্য বিষয়ে মনকে নিবদ্ধ করা হয়। এটি মন থেকে আসক্তি দূর করতে সাহায্য করে। এর ফলে মনে একটি সুখের উদ্ভব হয়। সমাধির শেষ স্তরে আসক্তি দূরীভূত হয়ে একটি উদাসীনতার ভাব আসে। এই অবস্থার প্রজ্ঞার উদয় হয় এবং সাধক নির্বাণ লাভ করেন।
এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গকে শীল সমাধি ও প্রজ্ঞা এই তিনভাগে ভাগ করা যায়। সম্যক্ বাক্, সম্যক্ কর্মান্ত ও সম্যক্ জীবিকা শীলের অন্তর্গত। শীল সমাধি ও প্রজ্ঞা পরস্পর সাপেক্ষ। শীল সমাধির সোপান। সচ্চরিত্র গঠন ব্যতীত সাধনা সম্ভবপর নয়। সাধনা দ্বারাই প্রজ্ঞা বা তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়। আবার, জ্ঞানের আলোকে চরিত্র নির্মল হয়, সাধনা সমুজ্জ্বল হয়।
সম্ভাব্য প্রশ্ন: গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত চতুরার্যসত্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
চারি আর্যসত্যের মধ্যেই বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শনের মূল কথা নিহিত আছে। এই চারি আর্যসত্যকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চারি নিদানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেমন: রোগ, রোগের কারণ, রোগের উপশম, রোগ উপশমের উপায়। মানবজীবনের জন্মজন্মান্তর ধরে বহমান দুঃখ হল রোগতুল্য, দুঃখের কারণ হল রোগের কারণ সদৃশ, দুঃখ নিবৃত্তি হল রোগ উপশমতুল্য, দুঃখনিবৃত্তির উপায় হল রোগ উপশমের উপায় সদৃশ। দুঃখকেই প্রথম ও প্রধান সত্য বলা হয়েছে। কারণ দুঃখ অপেক্ষা জীবজগতে বড় কোন সত্য নেই। এই দুঃখের কারণ বা হেতু আছে। হেতু ব্যতীত কোন কিছুর উৎপত্তি সম্ভব নয়। দুঃখের হেতু হল দ্বিতীয় প্রধান সত্য। দুঃখ যেহেতু হেতু প্রভব অর্থাৎ হেতু বা কারণজাত, এই দুঃখকে ধ্বংস করা যায়, দুঃখের নিবৃত্তি আছে। ইহা তৃতীয় প্রধান সত্য। দুঃখ নিবৃত্তির উপায় কল্যাণমিত্র বুদ্ধ আবিষ্কার করেছেন এবং তা হল অষ্টাঙ্গিক মার্গ। ইহাই চতুর্থ আর্যসত্য।
বুদ্ধদেবের মতে জগত ও জীবন দুঃখময়। ধর্মচক্রপ্রবর্তনসূত্রে বুদ্ধদেব মানবজীবনের দুঃখরাশিকে সংক্ষিপ্ত করে আটটি পর্যায়ভুক্ত করেছেন। যথা: জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ, অপ্রিয়-সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিচ্ছেদ দুঃখ, ঈপ্সিতের অপ্রাপ্তি দুঃখ, পঞ্চোপদান স্কন্ধময় এই দেহ ও মন দুঃখপূর্ণই। জন্মজন্মান্তর ধরে জীব সকল এই দুঃখ ভোগ করে আসছে। এই দুঃখ সর্বজনীন। জাতি বর্ণনির্বিশেষে, দেশকাল নির্বিশেষে কারোর দুঃখ হতে পরিত্রাণ নেই। বুদ্ধদেব জড় চেতনময় অস্তিস্ত্বকে ‘নামরূপ’ বলেছেন। নামরূপ বিধৃত সংসার নিরবচ্ছিন্নভাবে দুঃখময়। জগতে কেবল দুঃখেরই উৎপত্তি, স্থিতি ও বিলয় হচ্ছে। দুঃখ ব্যতীত অন্য কিছু উৎপন্ন হয় না, দুঃখ ব্যতীত অন্য কিছু নিরুদ্ধ হয় না।
দুঃখসমুদয় বা দুঃখের কারণ হল দ্বিতীয় প্রধান আর্যসত্য। দুঃখের কারণ সম্বন্ধে বুদ্ধদেব বলেছেন -তৃষ্ণাই দুঃখের কারণ। মোহমুগ্ধ ও মোহান্ধ মানুষের সকল প্রকার কর্ম সম্পাদনের মূলে হল এই তৃষ্ণা যা মানুষকে প্রতিনিয়ত বিষয় হতে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণ করায়। যত প্রকার তৃষ্ণা আছে সেগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়—
তৃষ্ণোৎপত্তির কারণরূপে অবিদ্যার কথা বলা হয়েছে। অবিদ্যা হতে কিভাবে তৃষ্ণা উৎপন্ন হয় তা প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতিতে কার্যকারণ শৃঙ্খলায় ব্যাখ্যা করা আছে। এই কার্যকারণ শৃঙ্খলা হল—অবিদ্যা→ সংস্কার→বিজ্ঞান→ নামরূপ→ ষড়ায়তন→ স্পর্শ→ বেদনা→ তৃষ্ণা→ উপাদান→ ভব→ জাতি→ জরামরণ কার্যকারণ শৃঙ্খলের দ্বাদশটি অঙ্গ। তাই একে ‘দ্বাদশ নিদান’ বলা হয়। এরা কার্যকারণ শৃঙ্খল বা চক্রের আকারে সংযুক্ত হয়ে মানুষকে জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহে আবর্তিত করে। তাই এই কার্যকারণ শৃঙ্খলকে ‘ভবচক্র’ বলা হয়। এই কার্যকারণ শৃঙ্খলে যা একদিক থেকে কারণ, তাই অন্যদিক থেকে কার্য। বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় পরিভাষায় একে বলে প্রতীত্যসমুৎপাদ। প্রতীত্যসমুৎপাদ হল কোন কিছুর উপর নির্ভর করে কোন কিছুর উৎপত্তি। ভবচক্র বলে যে, মানুষের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। বৌদ্ধ দর্শনে বলা হয়েছে যে, মানুষের সমস্ত প্রকার দুঃখের কারণ তার নিজের কর্ম এবং সমস্ত কর্মের মূলে তার তৃষ্ণা এবং তৃষ্ণার মূলীভূতকারণ অবিদ্যা। মানুষের দুঃখের মূলে কোন অতিপ্রাকৃত শক্তি বা ঈশ্বরের ভূমিকা নেই।
বুদ্ধ প্রদর্শিত তৃতীয় আর্যসত্য হল দুঃখ নিবৃত্তি। দুঃখের কারণ থাকলে দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব। তৃতীয় আর্যসত্যে আমরা পাই তৃষ্ণা থাকলে দুঃখ হয়। তৃষ্ণার উৎপত্তিতে দুঃখের উৎপত্তি হয়। আবার যা কিছু উৎপন্ন হয় তার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। দুঃখ যদি উৎপন্ন হয়ে থাকে তার বিনাশ ও সম্ভব। কারণকে দূর করলে কার্যের উৎপত্তি হবে না। রোগের জীবাণু নষ্ট করলে রোগেরও উপশম হবে। তাই তৃষ্ণার নিবৃত্তিতে দুঃখেরও নিবৃত্তি হবে। তৃতীয় আর্যসত্যের মূল কথা হল— ‘তৃষ্ণার অশেষ নিরবশেষ বিরাগ নিবৃত্তি ত্যাগ ও বিচ্ছেদ’। এখানে ‘অশেষ’ ও ‘নিরবশেষ’ কথা দুটি তাৎপর্যপূর্ণ। বিন্দুমাত্র তৃষ্ণাও যদি বর্তমান থাকে তাহলে দুঃখ নিবৃত্তি হবে না। চিত্তস্তরে জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত কর্মবীজ বেদনা বা অনুভূতির আকারে দেহস্তরে প্রকটিত হয় -যা কখন ও সুখকর কখনও দুঃখকর অনুভুতি। এই অনুভূতিকে ভোগ করলে পুরাতন তৃষ্ণার ক্ষয় হয় না বরং নতুন নতুন তৃষ্ণা পূর্বাপর তৃষ্ণার সাথে যুক্ত হয়ে তৃষ্ণার বোঝা বাড়িয়ে তোলে। এখন উৎপদ্যমান বেদনা বা অনুভূতিকে ভোগ না করে উপক্ষীণ করতে পারলেই নতুন তৃষ্ণা উৎপন্ন হবে না এবং পুরাতন তৃষ্ণা একে একে ক্ষয় হবে। অতএব, বেদনার অনুভূতির নিবৃত্তিতে তৃষ্ণার নিবৃত্তি। তৃষ্ণার নিবৃত্তিতে উপাদান নিবৃত্তি। উপাদান নিবৃত্তিতে ভব নিবৃত্তি। ভব নিবৃত্তিতে পুনর্জন্মের নিবৃত্তি। পুনর্জন্মের নিবৃত্তিতে জরামরণাদি উপশান্ত হয়ে সমূলে দুঃখের নিবৃত্তি হবে। এই দুঃখের নিরবশেষ নিবৃত্তিকে বৌদ্ধ শাস্ত্রে নির্বাণ বলা হয়েছে। ‘নির্বাণ’ শব্দের অর্থ নির্বাপণ। রাগ, দ্বেষ মোহ রূপ অগ্নির নির্বাপণ। ‘বান’ শব্দের অর্থ তৃষ্ণাও হয়। নির্বাণ তাহলে তৃষ্ণার ক্ষয়। বস্তুতঃ নির্বাণ লাভ হলে পুনর্জন্মের সম্ভাবনা থাকে না। আর এই জন্মেই পরম শান্তি পাওয়া যায়। সুতরাং, যদি দুঃখের নিবৃত্তি সূচক তৃতীয় আর্যসত্য তথা নির্বাণ না থাকত তাহলে বুদ্ধের ধর্ম দুঃখবাদী, নৈরাশ্যবাদী হত। কিন্তু কল্যাণমিত্র বুদ্ধ নির্বাণ এবং নির্বাণ লাভের পথ নির্দেশ করে প্রমাণ করেছেন তাঁর ‘ধম্ম’ আশাব্যঞ্জক ও পরম শান্তিদায়ক।
দুঃখ নিবৃত্তির উপায় বুদ্ধদেব আবিষ্কার করেছেন এবং তা হল অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই মার্গের আট অঙ্গ নিম্ন রূপ—
সম্যক্ দৃষ্টি হল সত্য দৃষ্টি বা সত্য জ্ঞান। আত্মা এবং জগত সম্পর্কে মিথ্যা দৃষ্টি হল দুঃখের মূল কারণ। তাই নৈতিক সংস্কারের প্রথম স্তর হল সত্য দৃষ্টি বা সত্য জ্ঞান। চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অষ্টাঙ্গিক মার্গের ভিত্তিস্বরূপ। জগতের অনিত্যতা জাগতিক বস্তুর প্রতি তৃষ্ণা ও আসক্তিই যে জন্ম এবং তজ্জনিত দুঃখের কারণ — সে বিষয়ে জ্ঞানই সম্যক্ দৃষ্টি।
দ্বিতীয় মার্গ হল সম্যক্ সংকল্প। নির্বাণ লাভের জন্য কেবল সত্য জ্ঞানলাভই যথেষ্ট নয়। সত্য জ্ঞান অনুযায়ী জীবন যাপন না করলে জ্ঞান বৃথা হয়ে পড়ে। তাই জ্ঞান অনুযায়ী জীবন যাপনের সংকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিষয়ের প্রতি আসক্তি, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসা পরিত্যাগ করার সংকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সম্যক্ বাক্ হল তৃতীয় মার্গ। এর অর্থ হল বাক্য সংযম। অর্থাৎ সত্য ও প্রীতি পূর্ণ কথা বলা। মিথ্যা কথা বর্জন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন।
সম্যক্ কর্মান্ত বুদ্ধ কথিত পঞ্চশীলের অন্তর্গত। অহিংসা অর্থাৎ হিংসা বর্জন, সত্য অর্থাৎ মিথ্যাভাষণ বর্জন, অস্তেয় অর্থাৎ পরদ্রব্য অপহরণ বর্জন, ব্রহ্মচর্য পালন অর্থাৎ সকল প্রকার ব্যভিচার থেকে বিরতি এবং সুরা মাদক দ্রব্য বর্জন।
সম্যক্ আজীব বলতে বোঝায় এমনভাবে জীবন যাপন করা যাতে পঞ্চশীল লঙ্ঘিত না হয়। জীবিকা অর্জনের জন্যও হিংসা করা, মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা বর্জনীয়। নির্দোষ নিষ্পাপ জীবিকাই অবলম্বনীয়।
সম্যক্ ব্যায়াম হল একান্ত অনবদ্য সৎ মানসিক ইচ্ছা বা প্রচেষ্টা। নির্বাণ লাভের জন্য যাবতীয় কুচিন্তা দূর করতে হবে এবং মনকে সৎ চিন্তার দ্বারা পরিপূর্ণ করতে হবে।
প্রতি মুহূর্তে কায় ও মনে যে সকল অবস্থা উৎপন্ন হয় তার প্রতি অতি সজাগ দৃষ্টি দিয়ে সন্তপর্ণে সেগুলিকে মনে মনে পর্যবেক্ষণ করাই সম্যক্ স্মৃতি। জগত জীবনের অনিত্যতা, আত্মা বলে নিত্য বা শাশ্বত সত্তা নেই -এগুলি প্রতিনিয়ত স্মরণে রাখাই সম্যক্ স্মৃতি। সম্যক্ স্মৃতি কুশলকে নিয়ত জাগ্রত রাখে, অকুশল উৎপত্তির অবকাশে বাধা প্রদান করে।
সম্যক্ সমাধি হল যা সত্য ও কল্যাণকর তার নিয়ত অনুধ্যান, দৃঢ় সংকল্পের দ্বারা ইচ্ছা ও কামনা বাসনার নিয়ন্ত্রণ সমাধি লাভের পথকে সুগম করে। নিরবচ্ছিন্ন সমাধির ফলে প্রজ্ঞা লাভ হয়। প্রজ্ঞা হল চতুরার্যসত্য সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান। সমাধির চারটি স্তর আছে। প্রথম স্তরে বিতর্ক, বিচার অর্থাৎ চারটি আর্যসত্য বিষয়ে মনকে নিবদ্ধ করা হয়। এটি মন থেকে আসক্তি দূর করতে সাহায্য করে। এর ফলে মনে একটি সুখের উদ্ভব হয়। সমাধির শেষ স্তরে আসক্তি দূরীভূত হয়ে একটি উদাসীনতার ভাব আসে। এই অবস্থার প্রজ্ঞার উদয় হয় এবং সাধক নির্বাণ লাভ করেন।
এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গকে শীল সমাধি ও প্রজ্ঞা এই তিনভাগে ভাগ করা যায়। সম্যক্ বাক্, সম্যক্ কর্মান্ত ও সম্যক্ জীবিকা শীলের অন্তর্গত। শীল সমাধি ও প্রজ্ঞা পরস্পর সাপেক্ষ। শীল সমাধির সোপান। সচ্চরিত্র গঠন ব্যতীত সাধনা সম্ভবপর নয়। সাধনা দ্বারাই প্রজ্ঞা বা তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়। আবার, জ্ঞানের আলোকে চরিত্র নির্মল হয়, সাধনা সমুজ্জ্বল হয়।