এক বিশেষ মুহূর্তে...
মাধবীদির সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল ‘মহানগর’ ছবি নিয়ে। তাঁর কথায়: ‘ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’র শ্যুটিং আগে শুরু হলেও মানিকদার ‘মহানগর’ই প্রথম মুক্তি পেয়েছিল৷ ১৯৬৩ সালের কথা৷ দেখতে দেখতে প্রায় ৬০ বছর হয়ে গেল৷ কারও কারও হয়তো মনে আছে ‘মহানগর’-এ আমার চরিত্রের নাম ছিল আরতি মজুমদার৷ আমার স্বামীর ভূমিকায় ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়৷ স্বামীর চাকরি চলে যায়৷ সংসার চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে আরতিকে সেলসগার্লের চাকরি নিতে হয়৷ একদিন তার সহকর্মী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধু এডিথেরও চাকরি চলে যায়৷ এডিথের চাকরি যাওয়ায় এই প্রথম ক্ষোভে ফেটে পড়ে আরতি৷ এর বিরুদ্ধে অফিসের ‘বস’-এর কাছে সে প্রতিবাদ জানায়৷ প্রতিবাদস্বরূপ চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ এই প্রথম একটা নিজস্ব সত্তা তৈরি হল আরতির৷’
সত্যজিৎ রায় কত বড় মাপের পরিচালক ছিলেন সে সম্পর্কে মাধবীদি স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, ‘মানিকদা পুরো চিত্রনাট্য যখন আমাকে পড়ে শোনালেন, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ এত জোরালো চিত্রনাট্য ভাবা যায় না৷ টেকনিশিয়ানস স্টুডিওতে শ্যুটিংয়ের কথা আজও মনে পড়ে৷ একটা ছোট্ট বাংলো মতো ঘর দেওয়া হল আমাকে৷ এটা ছিল কাননদেবীর ঘর৷ উনি এই ঘরে বসতেন৷ বাংলোর ওপরে বড় একটা গাছ ছিল৷ সেই গাছে আবার তক্ষকের পুরনো বাসা৷ আমার তো দারুণ আনন্দ হচ্ছিল কাননদির ঘর আমাকে দেওয়া হয়েছে৷ আমার পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল৷ একদিন শ্যুটিং-ব্রেকের পর একটা পান খেয়েছিলাম৷ মানিকদা বললেন, জিভটা একটু মুছে এসো৷ আর একদিন উনি অনিলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাতে মেয়েরা কীভাবে শোয়? অনিলবাবু বললেন, আমি ঠিক জানি না৷ আমি কাছেই ছিলাম৷ একটু ভয়ে ভয়েই বললাম, সাধারণত একটা বিনুনি করে শোয়৷ মানিকদা আমার কথা মেনে নিলেন৷ আর একদিন চুল বাঁধছি, কথা বলছি৷ খাটের ওপর ক্যামেরা বসানো৷ দৃশ্যটা টেক করা হবে৷ খাটটা হঠাৎ ভেঙে গেল৷ হাসতেও পারছি না৷ খাটের ওপর বসে মানিকদা, সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র ও তাঁর সহকারী ফটিকবাবু৷ তাঁরাও হুড়মুড়িয়ে পড়লেন৷’
সত্যজিৎ রায় কত বড় মাপের পরিচালক ছিলেন সে সম্পর্কে মাধবীদি স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, ‘মানিকদা পুরো চিত্রনাট্য যখন আমাকে পড়ে শোনালেন, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ এত জোরালো চিত্রনাট্য ভাবা যায় না৷ টেকনিশিয়ানস স্টুডিওতে শ্যুটিংয়ের কথা আজও মনে পড়ে৷ একটা ছোট্ট বাংলো মতো ঘর দেওয়া হল আমাকে৷ এটা ছিল কাননদেবীর ঘর৷ উনি এই ঘরে বসতেন৷ বাংলোর ওপরে বড় একটা গাছ ছিল৷ সেই গাছে আবার তক্ষকের পুরনো বাসা৷ আমার তো দারুণ আনন্দ হচ্ছিল কাননদির ঘর আমাকে দেওয়া হয়েছে৷ আমার পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল৷ একদিন শ্যুটিং-ব্রেকের পর একটা পান খেয়েছিলাম৷ মানিকদা বললেন, জিভটা একটু মুছে এসো৷ আর একদিন উনি অনিলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাতে মেয়েরা কীভাবে শোয়? অনিলবাবু বললেন, আমি ঠিক জানি না৷ আমি কাছেই ছিলাম৷ একটু ভয়ে ভয়েই বললাম, সাধারণত একটা বিনুনি করে শোয়৷ মানিকদা আমার কথা মেনে নিলেন৷ আর একদিন চুল বাঁধছি, কথা বলছি৷ খাটের ওপর ক্যামেরা বসানো৷ দৃশ্যটা টেক করা হবে৷ খাটটা হঠাৎ ভেঙে গেল৷ হাসতেও পারছি না৷ খাটের ওপর বসে মানিকদা, সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র ও তাঁর সহকারী ফটিকবাবু৷ তাঁরাও হুড়মুড়িয়ে পড়লেন৷’
'চারুলতা' ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাধবীদি অনেক অজানা কথা বললেন ‘মহানগর’ নিয়ে। ‘মহানগর’-এ ইনডোর বেশি ছিল, আউটডোর কম৷ টেকনিশিয়ানসে অনেকদিন শ্যুটিং হয়েছিল৷ তবে প্রথম দিনের শ্যুটিংয়েই একটা জোর ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেলাম৷ আমার চোখে আঞ্জনি৷ মানিকদার কপালে চিন্তার ভাঁজ৷ শ্যুটিং ক্যানসেল করা মানে আর্থিক ক্ষতি৷ ত্রাতার ভূমিকায় সুব্রত মিত্র৷ তিনি ছিলেন পৃথিবীবিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফারদের একজন৷ ক্যামেরার জাদুকর৷ শ্যুটিং হল৷ বোঝাই যায়নি আমার চোখে আঞ্জনি৷ মেকআপ যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য গ্লিসারিন লাগানো থাকত আমার দু’গালে৷ আমার ননদের চরিত্রে অভিনয় করেছিল জয়া ভাদুড়ি৷ জয়া বচ্চনের কথা বলছি৷ তখন মাত্র বারো বছর বয়স ওর৷ একটা দৃশ্য ছিল আমার গালে ননদ চুমু খাবে৷ জয়া চুমু খেয়ে বলেছিল, দিদি তোমার গালটা কী মিষ্টি গো! আসলে মিষ্টি গ্লিসারিন ওর মুখে গিয়েছিল৷ ‘মহানগর’-এর শেষ দিনের শ্যুটিং৷ ইউনিটের সকলেরই মন খারাপ৷ মানিকদা আমার কাছে একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কবে আবার একসঙ্গে কাজ করব?’ কথাটা শুনে আমি রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম৷ মনে মনে ভাবলাম, যে প্রশ্নটা আমার বলা উচিত ছিল তা উনিই বলে ফেললেন৷ এতে ওঁর মহত্ত্বই প্রকাশ পেয়েছিল৷
সত্যজিৎ রায়ের একটা সংলাপ যদি মিস হয়ে যায় তাহলে বাকি সংলাপের মজাটাই ধরা যায় না৷ পরিচালকদের কাজ অনেকটা কলেজের অধ্যাপকদের মতো৷ কোনও কোনও অধ্যাপক হয়তো নানান ব্যাখ্যা করে ছাত্রছাত্রীদের পড়া বোঝানোর চেষ্টা করেন৷ আবার এমন অধ্যাপকও আছেন যিনি দু-চার কথা বললেই পুরো পাঠক্রম জলের মতো সহজ হয়ে যায়৷ মানিকদা ছিলেন তেমনই৷ ওঁর চিত্রনাট্য একবার মনের গভীরে রেখাপাত করতে পারলেই ব্যস, নতুন করে আর কিছু বোঝার দরকার পড়ত না৷ একেকটা দৃশ্যের চিত্রায়ন কীভাবে করব তা আপনাআপনিই অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সাবলীলভাবে প্রকাশ পেত৷ আর প্রতিটি দৃশ্য যেন ছবির ফ্রেম থেকে সহজভাবে বেরিয়ে এসে দর্শকদের এক অসাধারণ অনুভূতিতে জড়িয়ে রাখে৷’
আরেক দিন এক ঘরোয়া আড্ডায় সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে তাঁর এমনই সব পর্যবেক্ষণের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন মাধবীদি।—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
সত্যজিৎ রায়ের একটা সংলাপ যদি মিস হয়ে যায় তাহলে বাকি সংলাপের মজাটাই ধরা যায় না৷ পরিচালকদের কাজ অনেকটা কলেজের অধ্যাপকদের মতো৷ কোনও কোনও অধ্যাপক হয়তো নানান ব্যাখ্যা করে ছাত্রছাত্রীদের পড়া বোঝানোর চেষ্টা করেন৷ আবার এমন অধ্যাপকও আছেন যিনি দু-চার কথা বললেই পুরো পাঠক্রম জলের মতো সহজ হয়ে যায়৷ মানিকদা ছিলেন তেমনই৷ ওঁর চিত্রনাট্য একবার মনের গভীরে রেখাপাত করতে পারলেই ব্যস, নতুন করে আর কিছু বোঝার দরকার পড়ত না৷ একেকটা দৃশ্যের চিত্রায়ন কীভাবে করব তা আপনাআপনিই অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সাবলীলভাবে প্রকাশ পেত৷ আর প্রতিটি দৃশ্য যেন ছবির ফ্রেম থেকে সহজভাবে বেরিয়ে এসে দর্শকদের এক অসাধারণ অনুভূতিতে জড়িয়ে রাখে৷’
আরেক দিন এক ঘরোয়া আড্ডায় সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে তাঁর এমনই সব পর্যবেক্ষণের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন মাধবীদি।—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।