রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত।

দণ্ডকারণ্যের সুরম্য, ভয়াল অরণ্যানী। চলার পথ খুঁজে পাওয়া ভার। এ যেন ঘনঘোর মেঘমালায় ঢেকেছে দিনের আলো। আবার তার সৌন্দর্য দু’ চোখ ভরে পান করেও যেন তৃপ্তি হয় না। সেই অরণ্যপথে ভয়ে, আনন্দে পথ চলেছেন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ। চলতে চলতে তাঁরা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, মহাতেজস্বী তপস্বীদের আশ্রম সব। সেখানে কত যে তরুলতা, কত না দীর্ঘ, উন্নত আরণ্যক বৃক্ষরাজি। ফুলে, ফলে, সরোবরে পরিপূর্ণ আশ্রমস্থল সকল প্রাণীর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ভূমি। নির্ভয়ে চরে বেড়াচ্ছে হরিণের দল। বাঘ, সিংহের গর্জনেও বিচলিত হচ্ছে না তারা। দিব্য অপ্সরারা মনের আনন্দে ঘিরে রয়েছেন এই সব নির্মল, পবিত্র তপোভূমি। শ্রীমণ্ডিত বিশালাকৃতি যজ্ঞশালা সেখানে। যজ্ঞের প্রয়োজনীয় যত পাত্র, সব রাখা আছে সাজিয়ে গুছিয়ে। সেখানে যজ্ঞের জন্য এনে রাখা হয়েছে কুশ। ঋষিদের বল্কল বসন শোভা পাচ্ছে আশ্রমের উন্মুক্ত পরিসরে। নিত্য হোমের আয়োজন আশ্রমে আশ্রমে। যজ্ঞধূমের রেখা নিত্য আঁকা হয় তার আকাশ জুড়ে। মন্দ্র গম্ভীর স্বরে উচ্চারিত বেদধ্বনি ছড়িয়ে যায় অরণ্যভূমে। দীর্ঘকাল ধরে দণ্ডকারণ্যের এই সব তপোবনভূমিতে বাস করেন ফলমূলভোজী, জিতেন্দ্রিয়, ব্রহ্মতেজা বৃদ্ধ ব্রহ্মর্ষিগণ।
রামের ধীশক্তি প্রখর। গভীর বনের মধ্যে পথ চলতে চলতে দূর থেকেই বুঝতে পারলেন এই আশ্রমমণ্ডলের অস্তিত্ব। পাখপাখালির আনন্দিত কলকাকলি, পবিত্র বেদধ্বনি অনুসরণ করে তাঁরা পৌঁছে গেলেন সেই ব্রহ্মভবন তুল্য তপোবনের নির্ভয় আশ্রয়ে। সেখানে প্রবেশের আগে নামিয়ে নিলেন ধনুক, খুলে নিলেন শরাসনের জ্যা। নম্র, বিনীত ভঙ্গিতে প্রবেশ করতেই পেলেন সেখানে ঋষিদের সাদর অভ্যর্থনা। এই ঘোর ভয়াল অরণ্যে এমন সুকুমার রূপ! তরুণ তাপসবেশী রাম, লক্ষ্মণকে দেখে ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিদের বিস্ময়ের ঘোর যেন আর কাটে না। বৈদেহীকে দেখে আরও আশ্চর্য হয়ে যান তাঁরা।

অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন সদ্য আগত অতিথিদের দিকে। তারপর তাঁদের পরিচয় বুঝতে পেরে সিদ্ধপুরুষ মুনিরা পাতায় ছাওয়া কুটীরে বিশ্রামের জন্য নিয়ে যান তাঁদের। বনের ফুল, ফলমূলে যথাবিধি অতিথিসৎকার করে তপোব্রতী মুনিরা রামকে বললেন, “রাম, তুমি লোকজগতের রক্ষক। আমাদের আশ্রয়দাতা সখা। রাজারূপে তুমি আমাদের মান্য, দেবতাজ্ঞানে আমাদের পূজনীয়। তুমি নগরেই বাস কর কিংবা বনে, তোমাকেই আমরা দণ্ডধর রাজা বলে জানি। এই অরণ্যে বসবাসকারী আমরা অহিংস পথের পথিক, জিতেন্দ্রিয়, জিতক্রোধ তপস্বী। কোনও প্রাণীর অনিষ্ট আমরা করি না। আমাদের রক্ষা করা তোমার কর্তব্য, রাম।” মুনিদের আতিথেয়তায় আনন্দেই সময় কাটল তাঁদের। তার পরদিন সূর্যোদয়ের পরে আবার শুরু হল ভীষণ, দুর্গম অরণ্যপথে যাত্রা। এ অরণ্য চিত্রকূটের স্নিগ্ধসুন্দর রম্য বনভূমি নয়। এখানে পদে পদে অপেক্ষা করছে বিপদ, ভয়।

এমনই এক ভয়স্থানে এসে পৌঁছলেন রাম, লক্ষ্মণ, সীতা। সেখানে অজস্র বন্যপ্রাণের অনায়াস বিচরণ। রয়েছে হরিণের দল, হিংস্র বাঘ, ভাল্লুক, বিশালকায় হাতী। উড়ে বেড়াচ্ছে দাঁড়কাক, শকুনের দল। সিংহের ঘোর গর্জনে মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে বনভূমি। হাঁস, কারণ্ডব, আরও বিচিত্র পাখিদের কলরব প্রতিধ্বনি তুলছে সামনের এক ভীষণ জলাশয়ের জলে। কত অজানা জলচর প্রাণীর বাস সেই জলাশয়ে! তাদের আলোড়নে জল হয়ে উঠেছে আবিল। আর রয়েছে বনভূমি জুড়ে একটানা ঝিল্লীরব। কিছুটা সন্ত্রস্ত পায়ে তিনজন সেই বনের পথ ধরে চলতে শুরু করলেন। কোন বিপদ অপেক্ষা করে আছে তাঁদের জন্য?
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৯: ঋষির আশীর্বাদে যাত্রা এবার গভীর অরণ্যপথে

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৮: দেবতাদের আশীর্বাদে আর অর্ব্বাবসুর প্রার্থনায় যবক্রীত বেদজ্ঞান লাভ করলেন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩: আর্ষ মহাকাব্যদ্বয়ের আদি প্রচারমাধ্যম

সেই ভয়াল অরণ্যের মধ্যে হঠাৎ রাম দেখতে পেলেন এক ভয়ংকর দৃশ্য। তাঁর সামনে পাহাড়ের মতো বিশাল দেহধারী এক রাক্ষস। সে যেন এই ভয়াল অরণ্যের সমস্ত বীভৎসতার, ভয়ের, অন্ধকারের জীবন্ত মূর্তিখানি। তার দু’ চোখের কোটরে অন্ধকার জমাট হয়ে আছে। বিস্ফারিত মুখ তার সর্বগ্রাসী খিদে নিয়ে অপেক্ষায় অস্থির। পরনে তার রক্তাক্ত বাঘছাল। একটা দীর্ঘ লোহার শূলে অনেকগুলি বাঘ, সিংহ ও একটা প্রকাণ্ড হাতির মাথা বিদ্ধ করে সে চিৎকার করছে। তার এই ভয়াল মূর্তি সব পশু পাখিদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে।

এবার রাম, লক্ষ্মণ আর সীতাকে দেখতে পেয়ে যেন কালান্তক যমের মতো সে ছুটল তাঁদের দিকে। কোনওরকম চিন্তাভাবনার সুযোগ না দিয়েই সীতাকে তুলে নিল নিজের কোলে। তারপর রাম, লক্ষ্মণের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বন কাঁপিয়ে বলতে লাগলেন, “ওরে! জটাচীরধারী দুই ক্ষীণজীবী! সশস্ত্র অবস্থায় একজন স্ত্রীলোককে সঙ্গে নিয়ে দণ্ডকারণ্যে এসেছ পাপাচরণ করতে? তোমরা দুজন তপস্বী হয়ে একজন নারীর সঙ্গে বাস করতে এসেছ এখানে? কে হে তোমরা, এভাবে মুনিবৃত্তিকে দূষিত করছ?” রাম নিজেদের পরিচয় জানালেন। ক্ষত্রিয় হয়েও বিশেষ কারণবশত বর্তমানে তাঁরা বনবাস জীবন যাপন করছেন, তাও জানালেন।

বিরাধ শুনলেন সেকথা। তার মনের ভাব গোপন রেখে নিজের পরিচয় দিলেন তিনিও। ইনিই দাশরথি রাঘব! তাঁর কাছেই যে রয়েছে তার মৃত্যুর গোপন ভোমরাটি। বিরাধের অপেক্ষা যে তাঁর জন্যই। আদিকবি পরে উদ্ঘাটন করেছেন সে সত্য। বলল সে, “আমি কাল নামক রাক্ষসের পুত্র। আমার মায়ের নাম শতহ্রদা। রাক্ষসজগতে আমার পরিচয় বিরাধ নামে। তপস্যাবলে ব্রহ্মার আশীর্বাদে কোনো শস্ত্র বধ করতে পারে না আমাকে। কোনও অস্ত্র ভেদও করতে পারে না। তোমরা এই নারীর আশা ত্যাগ করে ফিরে যাও। আমি মারব না তোমাদের। এই পরমাসুন্দরী নারী হবে আমার ভার্যা। আর যদি যুদ্ধ কর তাহলে তোমাদের মতো দুই পাপাচারীর রক্ত পান করব আমি। মুনিমাংস নিত্যদিনের আহার আমার।”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩: ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছিল পঞ্চমের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা

বিরাধ রাক্ষসের কথা শুনে সীতা বাতাসের ধাক্কায় কলাগাছের মতো কাঁপতে লাগলেন ভয়ে। রাম বুঝলেন সমূহ বিপদ। কৈকেয়ীর প্রতি জমাটবদ্ধ ক্ষোভ বহুদিন পরে বেরিয়ে এল লক্ষ্মণের কাছে। শুকনো মুখে রাম বললেন, “লক্ষ্মণ, নৃপতি জনকের কন্যা, আমার ভার্যা, দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ, শুদ্ধচারিণী সীতার অবস্থা দেখ! দূরদর্শিনী মা কৈকেয়ীর মনোবাসনা আজ পূর্ণ হল। নিজের পুত্রের জন্য রাজ্য চেয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি, আমাকে বনে পাঠিয়ে সর্বনাশ করতে চেয়েছেন। বৈদেহী আজ পরপুরুষের হাতে। এ যে পিতার মৃত্যুর থেকে, রাজ্যনাশের থেকেও অনেক বেশি যন্ত্রণার। বৈদেহীর এই লাঞ্ছনা, এই নিগ্রহের থেকে বড় কোনও দুঃখ আমার নেই।”

রামের কথা শুনে ক্ষাত্রতেজে জ্বলে উঠলেন লক্ষ্মণ। “আর্য, আপনি অনাথের মত শোক করছেন। আমার ভরতের উপর সঞ্চিত ক্রোধ আজ বিরাধের উপর বজ্রের মত হানব আমি। আপনি শুধু অনুমতি দিন।”

শুরু হল তীব্র শরবর্ষণ। কিন্তু শর বিরাধকে বিদ্ধ করেও খসে পড়ে দেহ থেকে। সে যে অস্ত্রে, শস্ত্রে অজেয়। কোন আয়ুধেই পরাস্ত করা গেল না বিরাধকে। অবশেষে রাম বিরাধের হৃদয়ে তীক্ষ্ণ এক স্বর্ণপুঙ্খ তীর নিক্ষেপ করলেন। এবার শরবিদ্ধ হয়ে সীতাকে দূরে নিক্ষেপ করল বিরাধ। তার ইন্দ্রিয়গুলি যেন অবসন্ন হয়ে আসছে। উঠে আসছে রক্তবমি। কাতরস্বরে করজোড়ে এবার বিরাধ রামকে বলল তার প্রকৃত পরিচয়। বলল সীতাকে নিগ্রহ করে তাঁদের উত্তেজিত করে তোলার কারণ।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা

হেলদি ডায়েট: দাঁতকে অবহেলা নয়, শিশুর দাঁতের যত্ন নিন গোড়া থেকেই, সতর্ক হন এই সব খাবারে

বিরাধ ছিল তুম্বুরু নামক গন্ধর্ব। অপরূপ রূপ ছিল তার। স্বর্গের অপ্সরা রম্ভার প্রতি আসক্ত হয়েছিল সে। সেই আসক্তিবশত কুবেরের সেবাকার্যের সময় অনুপস্থিত ছিল। ক্রুদ্ধ প্রভু কুবেরের অভিশাপে অভিশপ্ত রাক্ষসজীবন ঘনিয়ে এল তার জীবনে। অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় পাওয়া গেল বহু অনুনয়ে— দাশরথি রামের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ। দিব্যলোকের দিব্যকান্তি গন্ধর্ব তারপর রূপান্তরিত হল কুৎসিতদর্শন নরখাদক রাক্ষসে। আচারে ব্যবহারে তার বীভৎসতা, ভয়ালদর্শন সে, কিন্তু স্মৃতিতে রয়ে গেল সেই দিব্যজীবনে ফিরে যাওয়ার উপায়টুকুর উপলব্ধি। তাই রামের পরিচয় জানতে পেরে জেগে উঠল তার শাপমুক্তির প্রবল বাসনা। এই অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ পেতে মরিয়া হয়ে সে বেছে নিল সীতানিগ্রহের পথ। সে জানত, রামকে উত্তেজিত করে যুদ্ধে বাধ্য করেই আসবে তার মুক্তি।
মৃত্যুকালে রামকে সে দিয়ে যায় এই ভয়াল অরণ্যে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের পথ নির্দেশ। দেখিয়ে দেয়, ধর্মাত্মা শরভঙ্গ মুনির তপোবনের পথ। জানিয়ে যায়, এ পথেই নিহিত রয়েছে রামের মঙ্গল।

বিরাধ শাপমুক্ত হয়ে দিব্যরূপ ধারণ করে ফিরে যায় স্বর্গলোকে। রামের হাতে এ হল তার নবজন্ম। পড়ে থাকে নিহত রাক্ষসের নিষ্প্রাণ বিশাল দেহ। সে দেহ মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেখানে নিক্ষেপ করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে যায় বিরাধ। রামকে জানিয়ে যায়, রাক্ষসদের দেহ সৎকারের এই নাকি সনাতন রীতি। এক কুৎসিত তামসিক জীবনের অন্ত ঘটে, নশ্বর পৃথিবীর ঊর্ধে নতুন করে সু্রে তালে জীবন বাঁধে এক গন্ধর্ব।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content