অমৃতবাজার পত্রিকা(বাঙলা সংস্করণ) ছবিঃসংগৃহীত
।। রোজনামচা।।
বিনয়ের কাছেই শুনেছে এই স্টেটসম্যান কাগজটার মালিকানা নাকি ইংরেজদের হাতে। রবার্ট নাইট নামের এক ইংরেজ সাংবাদিক কলকাতায় এই কাগজের গোড়াপত্তন করেন। ইংরেজ হলেও রবার্ট সাহেব নাকি ইংরেজ সরকারের কড়া সমালোচক ছিলেন। অমৃতবাজার ইংরেজি পত্রিকা হলেও খাঁটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান। যশোরের মাগুরাতে থাকতেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হরিনারায়ন ঘোষ। তাঁর স্ত্রীর নাম অমৃতময়ী। এই পরিবার মাগুরায় একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন অমৃতময়ীর নামে যার নাম ছিল ‘অমৃতবাজার’। হরিনারায়ন বাবুর ছেলে শিশির ঘোষ এবং মতিলাল ঘোষ প্রথমে বাংলা হরফেই শুরু করেছিলেন, — ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’। পরে এটির ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ শুরু হল। হালে শিশির ঘোষের বয়সের কারণে তাঁর সুপুত্র তুষার কান্তি ঘোষ এই পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছেন। বসুন্ধরার বয়েসী আর-পাঁচজন মায়েদের এসব জানার কথা নয়, কিন্তু বসুন্ধরাকে এসব জানতে হয় — কারণ তিনি বিনয়কান্তি দত্তের মা।
ঠাকুরঘরে বসে ভাবছিল বসুন্ধরা ঈশ্বর মানুষের পরীক্ষা নেন। সততার পরীক্ষা নিষ্ঠার পরীক্ষা। সফল হতে সে কতখানি মরিয়া। সাফল্য পেতে কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে পারে তাও পরখ করে নেন ঈশ্বর। তিনি যখন তুষ্ট হন, নিশ্চিত হন তারপরেই ভাগ্যের বন্ধ-দরজা খুলে দেন। একের-পর-এক।
একদিন অফিস থেকে ফিরে বিনয় ব্যাগ রেখে বলল—
— কড়া করে আদা দিয়ে দু-কাপ চা বানাও তো মা!! মোড়ের দোকানে সিঙাড়া ভাজছে দেখে এসেছি।
রেকাবে গরম সিঙাড়া, কাপে ধোঁওয়া ওঠা চা — কাঁসার জামবাটিতে মুড়ি রেখে বসুন্ধরা জিজ্ঞেস করল—
— খুশির খবরটা কী?
বিনয় মুখে খানিকটা শুকনো মুড়ি নিয়েছে। হাতে নিয়েছে একখানি সিঙ্গাড়া। মুড়ি বিনয়ের খুব প্রিয় খাদ্য। বিনয় বলে মুড়ির মতো শুদ্ধ গণতান্ত্রিক খাবার আর একটাও নেই। ভিখিরিও মুড়ি খায়। বড়লোকও খায়। সুস্থ বা অসুস্থ যে কোনও সময় খাওয়া যায়। চাষা মুটে মজুর। একধামা মুড়ি নিয়ে বসে, নারকোল বা বাতাসা জুটলো কি জুটলো না!! নামী-দামি লোকজন সখ করে ঝালমুড়ি খায়। বাঙালি উকিল-ব্যারিস্টার-ডাক্তার-অধ্যাপক কি লেখক — জীবনে মুড়ি খাননি এমন হতেই পারে না। সমাজের সর্বস্তরে তাই মুড়ির অবাধ গতি।
—কি রে খুশির খবরটা কী বল?
—খবরটা খুশির, নাকি খুশির নয় সেটা…সেটা তো সময় বলে দেবে। মোদ্দা ব্যাপারটা হল আমার আর মাইনে বাড়বে না।
—সে কী কথা? কেন ?
চায়ের কাপে একটা আলতো চুমুক দিয়ে বিনয়কান্তি জানায় — সেদিন থেকে পিটারসন সাহেব বিনয়কান্তিকে – কোম্পানির দু’ আনা মালিকানা দিয়ে অংশীদার করে নিয়েছেন। শতকরা হিসেবে যা হল সাড়ে বারো শতাংশ। এ বার কোম্পানি লাভ হলে হিসেব মতো দু-আনা লাভ তার। তেমন ক্ষতি হলে লোকসান তো তারই।
বসুন্ধরার মাথা খুব দ্রুত চলত। বুঝতে সুবিধে হবে বলেই বিনয় আনার হিসেবে বলেছিল। কিন্তু বসুন্ধরা লাভ-ক্ষতির ভাগ-বাঁটোয়ারায় না গিয়ে — একেবারে আসল কথাটা বলে দিলেন।
—বিনু!! তার মানে তুই তো কোম্পানির মালিক হলি রে!!
—দু’ আনা ভাগ নিয়ে কি আর মালিক হওয়া যায় মা? বাকি চোদ্দ আনা যাঁর সেই পিটারসন সাহেবই মালিক!!
—এত বড় একটা খবর!! তুই এখানে বসে চা-সিঙাড়া খাচ্ছিস বিনু?
—কেন আমায় কি ব্যান্ডপার্টিকে খবর দিতে হবে মা??
—ইয়ার্কি করিসনি বিনু! ঠাকুরের জন্যে ভালো গোড়ের মালা-মিষ্টি নিয়ে আয়। আমি পুজো দেব।
এরপর থেকে বিনয়কান্তির একের পর এক সব সাফল্যের আনন্দ কৃতজ্ঞতা সবকিছু এভাবেই ঈশ্বরের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন বসুন্ধরা। আজীবন।
দেখতে দেখতে পালবাবুদের মাহিয়ারি যাবার সময় এগিয়ে এলো। কেদার পাল জানালেন, পরিচিত বিশ্বাসী মিস্ত্রি এসে ওপরের ঘরদোর-দরজা জানলা সব রঙ করে দেবে। তারপর আসবে পালিশ মিস্ত্রি।
মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিনয় জানালো – তাদের কোনও তাড়া নেই । মা বলেছে— বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধের কাজ নীচের ঘরেতেই হবে। তারপর আলাদা করে পুজো করে তারা ওপরের ঘরে যাবে।
স্বর্ণময়ীদের বাড়িতে সেদিন বসুন্ধরা বিনয়ের প্রস্তুতির জন্য একটা বছর সময় চেয়েছিল। সেই সময় শেষ হওয়ার অনেক আগেই বিনয় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল। বিনয়ের বাবার বাৎসরিক কাজে এই প্রথম তাদের পরিবারে একটা যগ্যি হল।
যে জীবন মানেনি বাধা…
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৬: বসুন্ধরা এবং…
কেউ ঠান্ডায় জব্দ, কেউ গরমে, কোন ব্যথায় কোন ধরনের সেঁক কাজে লাগে?
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩২: দেশে প্রথম গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বেড়ে ওঠা সেরা প্রাপ্তি ‘জয়ন্তী রুই’ মাছ
বিকেলে সব কাজ মেটার পর এতদিনে এই প্রথম বসুন্ধরা যেন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। বিনয় বুঝতে পারল আজ বাবার আত্মাকে যেন তারা বরাবরের মতো বিদায় জানাল। আগের দিন পুজো-আচ্চার কাজ হয়েছে, ঘরভর্তি ফুল-বেলপাতা কলাপাতা মিষ্টির বাক্স ফলের চ্যাঙ্গাড়ি। বিনয়ের সেদিন অফিস না বেরোলেই নয়। খুব জরুরি কয়েকটা কাজ আছে। কিন্তু মায়ের উপরে সবটা ছেড়ে যেতে মন খুঁতখুঁত করছে। অফিস বের হবার ঠিক আগে কড়া নাড়ার শব্দে বিনয় অবাক।
দরজা খুলে আরো অবাক হতে হল বিনয়কে। বাড়ির কাজের লোককে সঙ্গে নিয়ে স্বর্ণময়ী এসেছে বরানগর থেকে। আনন্দমোহনবাবুর কোর্টের তাড়া ছিল তাই তিনি ওদের নামিয়ে দিয়েই চলে গিয়েছেন। বিকেলে ফেরার পথে মায়ের সঙ্গে দেখা করে স্বর্ণময়ীদের নিয়ে বাড়ি ফিরবেন ।
স্বর্ণময়ীর দায়িত্ববোধ দেখে বিনয় হতবাক। সেইসঙ্গে মায়ের উপরে সব ফেলে রেখে যাওয়ার অস্বস্তিও দূর হয়ে গেল।
শুভদিন দেখে ছোট একটা পুজো করে বসুন্ধরা ও বিনয় ওপরের ঘরে উঠে গেল। নিচের বসার আর শোবার ঘর রান্নাঘর রঙ করে উপযুক্ত ভাড়াটের অপেক্ষায় চাবি বন্ধ করা হল। কাজের চাপ বাড়তে থাকায় বিনয়ের পক্ষে আর ওপরের ঘর গুছিয়ে ওঠা সম্ভব হল না। রঙ মিলিয়ে দরজা জানালার পর্দা বিছানার চাদর বালিশের ওয়াড় টেবিলের ঢাকা বসুন্ধরাকে নিয়ে সবটা একা হাতে সামলালো স্বর্ণময়ী। বসুন্ধরার বাড়িতে বিনয় ভিন্ন দ্বিতীয় প্রাণী নেই। আর স্বর্ণময়ী তার দাদু ঠাকুমার শিক্ষায় গড়ে ওঠা এক মুক্তমনের পরিবারের মেয়ে। তাই বিয়ের আগে নিজের শ্বশুরবাড়ি গুছিয়ে নেওয়ার গড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় স্বর্ণময়ীর সামনে কেউ বাধা হয়েও দাঁড়ায়নি, সমালোচনাও করেনি। পরিবেশ পরিস্থিতি অনেক কিছু বদলে দেয়। না হলে সে যুগে এরকম ঘটনা বড় একটা স্বাভাবিক নয়।
নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/২
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৮: দশরথের অভিলাষ-রামের রাজ্যাভিষেক সংকল্প
ছোটদের যত্নে: সাপে কামড়ানো রোগীকে বাঁচাতে কী করবেন, আর কী করবেন না, জেনে নিন ডাক্তারবাবুর মতামত
পর্দার আড়ালে, পর্ব-১৬: পরিচালকের কথা শুনে মেকআপ ছেড়ে সুচিত্রা বললেন, যে কাউ ‘দেবাশিস’ করলে আমি কাজ করব না
এরই মাঝে বিনয় লক্ষ্য করছে তাদের ভাড়া-করা বাড়িটা বদলে যাচ্ছে বালিশ বিছানা চাদর ঘরের পর্দা সোফার কভার খাবার টেবিলের টেবিল ক্লথ অনেক রঙিন করে দিচ্ছে তাদের বাড়িটাকে। ওপরে এক ঘরে বিনয় থাকে অন্য ঘরে বসুন্ধরা। বসার ঘরটায় প্রায় যাওয়াই হয় না তার।
বসুন্ধরাকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে স্বর্ণময়ীদের বাড়িতে যে মাসি কাজ করেন তারই দূরসম্পর্কের বোনকে ঘরদোর পরিষ্কার রান্নাবান্না এসব কাজে রাখা হয়েছে। বিনয় এখন আর এ সব খুঁটিনাটি বিষয়ে মাথা ঘামাতে পারে না। অফিস থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। শোবার ঘরে একটা টেবিল চেয়ার থাকত তাতে ডাঁই করা থাকত অফিসের ফাইল, ব্যবসার খুঁটিনাটি আইনী বইপত্র। একদিন দেখল শোবার ঘরে চেয়ার টেবিল আছে। তাতে আগের দিনের খবরের কাগজ, সুদৃশ্য কাচের জলের জাগ, কাচের গেলাস আর শরৎবাবুর বেশ কয়েকটা বই গোছানো আছে। অফিসের ফাইল একটাও নেই। সেটা রোববার। এখন রোববারটায় বিনয় আর সকালে ওঠে না। সেদিন ব্যায়াম করে না। নির্ভেজাল ছুটি উপভোগ করে। অফিসের জরুরি কোনও কাজ থাকলে সেটা নিয়ে দুপুরে খাবার পর বসে। ফাইলগুলো মা রাখল কোথায় সেটা বিনয় ভেবে পাচ্ছে না। শরৎচন্দ্র বিনয়কান্তির প্রিয় লেখক, এটা বসুন্ধরা জানে। কিন্তু মা বইগুলো পেল কোথায়? দেবদাস, চরিত্রহীন, দত্তা, গৃহদাহ,পথের দাবী — ১৯১৭ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে লেখা সবকটা বই আছে। শ্রীকান্ত’র যে তিনটে খণ্ড বেরিয়েছে — সেগুলোও রয়েছে। ভারতবর্ষ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পেত শ্রীকান্ত’র ভ্রমণ কাহিনী। পরে বিচিত্রা পত্রিকায় পরবর্তী অংশ বের হ’ত। সেগুলো নিয়েই আগামীদিনে চতুর্থ খন্ডও প্রকাশ পাবার কথা। বইগুলো হাতে নিয়ে এসবই ভাবছিল বিনয় এসব বই কেনার কথা কখনও…মা এগুলো কাকে দিয়ে আনালো। কেনই বা আনালো। বিনয় শরৎচন্দ্র পড়বে কখন? হাঁক দিয়ে মাকে ডাকল বিনয়।
—মা!!
বিনয় অবাক হয়ে দেখল মায়ের বদলে, সাতসকালে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলো স্বর্ণময়ী। —চলবে
বাঁশির পবিত্র সুরে জীবনের বন্ধ দরজাও খুলে যায়।
পরের পর্ব আগামী রবিবার
লাল পাড় গরদের শাড়ি পরেছে স্বর্ণময়ী। হয়তো তার মার শাড়ি। মাথার খোলাচুল তখনও ভিজে। ডান কাঁধে এলানো চুলে একটা গিঁট দেওয়া। বাঁ কাঁধ থেকে আঁচল ঘুরে এসে ডান কাঁধে ফেলা চুলকে খানিক ঢেকে দিয়েছে। কপালে তেল-সিদূঁরের ছোট্ট লাল তিলক। ডানহাতে শালপাতার চ্যাঙ্গাড়ি। তার থেকে জবাফুল উঁকি দিচ্ছে।
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।