সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


মিথিলা থেকে অযোধ্যা — এই দীর্ঘ যাত্রাপথে হঠাৎ ঘনিয়ে এসেছিল বিপদের কালো মেঘ। জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম দাঁড়ালেন পথ জুড়ে। তাঁকে পরাস্ত করলেন রাম। পথের বিপদ কেটে গেল পথেই। নিশ্চিন্ত হলেন সবাই। বৃদ্ধ রাজা দশরথ রামের বিপদের কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। যেন দেহ-মনের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এবার রাম এসে তাঁর কাছে দাঁড়ালেন। বলিষ্ঠ বাহুযুগলে আত্মপ্রত্যয় ঠিকরে পড়ছে। সব শুনে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন দশরথ। উপলব্ধি করলেন, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র জগতে অপরাজেয়, অপ্রতিহত ক্ষাত্রশক্তি তাঁর। এবার তিনি নিশ্চিন্ত। আবার চলতে শুরু করল চতুরঙ্গিনী সেনা। যাত্রা করলেন রাজা, পুরোহিত, রাজকুমার আর নববিবাহিত রাজকুলবধূরা।

সুসজ্জিত অযোধ্যা আজ তাঁদের জন্য অধীর অপেক্ষায়। সেজে উঠেছে অযোধ্যার প্রবেশপথের তোরণ যত। জলসিক্ত রাজপথে পড়ে নেই কণামাত্র ধূলো। সেসব পথে আজ শুধুই ফুলের আস্তরণ, ফুলের সজ্জা। দিকে দিকে বেজে উঠছে নানা বাদ্য, তাদের মধুর ধ্বনিতে ভরে উঠছে দশদিক। রাজার আগমনের অপেক্ষায় মঙ্গলশঙ্খবাদকের দল। উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা নগরীর প্রবেশদ্বারে। রাজপথে অপেক্ষায় অস্থির পুরবাসীজন। আসবেন চার রাজকুমার, সঙ্গে তাঁদের বধূরা। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটে না আর।
অবশেষে এলেন তাঁরা। প্রবেশ করলেন অযোধ্যায়। মহাসমারোহে, সমাদরে, সুরম্য, সুসজ্জিত রাজপথ পার হয়ে এলেন রাজভবনে। তিন রাজমহিষী কৌশল্যা, সুমিত্রা, কৈকেয়ী এবং অন্যান্য রাজস্ত্রীরা সাদরে বরণ করে নিলেন পুত্র ও পুত্রবধূদের। অযোধ্যার রাজভবনে প্রবেশ করলেন জনকনন্দিনী সীতা, ঊর্মিলা, কুশধ্বজকন্যা মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি। এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল অযোধ্যায়।

গুরুজনদের আশীর্বাদে, স্নেহে চার কোশলকুমারের গার্হস্থ্য যাপন আরম্ভ হল। নববিবাহিত রাজপুত্র ও বধূরা পারস্পরিক প্রীতিবন্ধনে নিজেদের জীবন কাটাতে লাগলেন। বিশেষত সীতা এবং রাম যেন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠলেন। দুজনের হৃদয় জানতো দুজনের প্রাণাধিক ভালবাসা আর নির্ভরতার সংবাদটুকু — ‘হৃদয়ং হ্যেব জানাতি প্রীতিযোগং পরস্পরম্।’ রাম-সীতার বিবাহযোগ যেন বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর মিলন। জগতে তার তুলনা পাওয়া ভার।

অযোধ্যায় এ বড় মধুর সময়, পরিপূর্ণ সংসারে পূর্ণ আনন্দের সময়। অযোধ্যার সিংহাসনে রাজা দশরথ, বার্ধক্য ছুঁয়ে ফেলেছে তাঁকে। কিন্তু উপযুক্ত হয়ে উঠছে পুত্ররা তাঁর। বিশেষত জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম রাজোচিত গুণে, তেজস্বিতায় রাজ্যভার গ্রহণের জন্য ক্রমেই সমর্থ হয়ে উঠছেন। হৃষ্ট মনে রাজ্য শাসন, পালন করেন ইক্ষ্বাকুকুলভূষণ রাজা দশরথ। ভবিষ্যতের ছবি নিশ্চিন্ত করে তাঁর মনকে।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৫: বাহুকরূপী নলের রথ ঋতুপর্ণরাজাকে নিয়ে তীব্র বেগে বিদর্ভের পথে চলল

ত্বকের পরিচর্যায়: হঠাৎ শিশুর জ্বর আর মুখে-হাতে দানাদানা? কোন রোগের উপসর্গ? জানুন বিশেষজ্ঞের মতামত

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৬: রাম-পরশুরাম দ্বৈরথ অযোধ্যার পথে

শিশুকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন? কোন কোন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন? কী কী ওষুধ সঙ্গে রাখবেন? রইল পরামর্শ

রাজমহিষী কেকয়রাজকন্যা কৈকেয়ীর পুত্র ভরতকে একদিন ডাকলেন রাজা দশরথ। রাজপুত্রদের বিবাহকালেই অযোধ্যায় এসেছিলেন কেকয়রাজপুত্র বীরশ্রেষ্ঠ যুধাজিৎ। এবার তাঁর ফিরে যাওয়ার পালা। কেকয় দেশের রাজা, কৈকেয়ীর পিতা দেখতে চেয়েছেন ভরতকে। সে বার্তা দিতেই দশরথ ডেকে পাঠিয়েছেন ভরতকে। সুমিত্রানন্দন শত্রুঘ্ন ভরতের বড় প্রিয়। ছায়ার মত ভরতের সঙ্গে থাকেন তিনি। ভালোবাসায় একাত্ম দুই ভাই যেন একই শরীরের অবিচ্ছেদ্য দুই অঙ্গ। দশরথ তাঁকেও নিয়ে যেতে বললেন কেকয়দেশে। কৈকেয়ী এ সংবাদে ভারি খুশি হলেন। পিতৃগৃহে সাড়ম্বরে ভরতকে পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করলেন তিনি।

মাতুলালয়ে যাত্রাকালে ভরত এলেন পিতার কাছে বিদায় নিতে। পুত্রকে দূরদেশে পাঠাতে পিতার মনে উঁকি দেয় স্বাভাবিক উদ্বিগ্নতা। স্নেহভরে দশরথ নানাবিধ উপদেশ দেন তাঁকে — “মাতুলালয়ে মাতামহ, মাতুল ও অন্যান্য গুরুজনদের দেবতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করবে। বিনীত, সুশীল ও নিরহঙ্কারী হবে। বরিষ্ঠ বেদজ্ঞানী, শাস্ত্রকুশল ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে বেদ, ধর্মশাস্ত্র, সুবিস্তৃত নীতিশাস্ত্র ও ধনুর্বেদ শিক্ষা করবে। প্রতিদিন অশ্ব ও রথে আরোহণ করবে, ব্যায়াম করবে। সঙ্গীতশাস্ত্রের চর্চাও নিয়মিত করবে। ভরত, তুমি এভাবে নানা শিল্পবিদ্যা ও কলাবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠবে। অকারণ সময় নষ্ট করবে না, সেটি তোমার পক্ষে হিতকর হবে না। আর, তোমার কুশল সংবাদ জানিয়ে তুমি দূত পাঠাবে। সে বার্তাটি না পেলে মন বড় উতলা হবে আমার।” পুত্র মাতুলালয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু তার শাস্ত্র ও শস্ত্রচর্চায় যেন ঘাটতি না পড়ে — এবিষয়ে সদা সতর্ক পিতা দশরথ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৩: রবীন্দ্রনাথের মাস্টারমশায়

মন নিয়ে খোলা মনে: মানসিক অবসাদ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩: এক ফ্লপ মাস্টার জেনারেল-র ‘মর্যাদা’ [২২/১২/১৯৫০]

ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে চললে বাড়িতেই ডেঙ্গির চিকিৎসা করা সম্ভব

বিদায় নিচ্ছেন ভরত ও শত্রুঘ্ন। সঙ্গে তাঁদের বিরাট চতুরঙ্গ বাহিনী। তাঁদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে চললেন রাম, লক্ষ্মণ, অন্যান্য প্রিয়জন আর পুরবাসীরা। মন ভার আজ তাঁদের সকলের। আবার সকলের দেখা হবে দীর্ঘকাল পরে।

বহু পথ অতিক্রম করে ভরত এলেন মাতুলালয়ে, কেকয় দেশে। এ এক নতুন দেশ। মাতামহ কেকয়রাজ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন আনন্দে। ক্রমে মাতামহের গৃহে নানা বিদ্যার চর্চায় দিন কাটতে থাকল ভরতের। দিনে দিনে তিনি ধর্মজ্ঞানে, বেদ-বেদাঙ্গ-গণিতশাস্ত্রে, নীতিবিদ্যায়, কুশল; গন্ধর্বশাস্ত্রে, চিত্রকলায় নিপুণ হয়ে উঠলেন। শিখে নিলেন কতরকম অস্ত্র চালনার গূঢ় কৌশল। আগ্রহী শিষ্যের মন নিয়ে আয়ত্ত করতে থাকলেন অজস্র বিদ্যা। তার মধ্যে বাদ চিল না পর্বত লঙ্ঘন, সন্তরণ কিংবা গ্রহ-নক্ষত্রের গতি বিচারের বিদ্যাও। এ বিদ্যালাভে সঙ্গে থাকেন উপযুক্ত ভ্রাতা শত্রুঘ্ন।

ওদিকে, অযোধ্যায় লক্ষ্মণকে পাশে নিয়ে পিতার রাজকার্যে সহায়তা করতে থাকেন রাম। পুরবাসিদের মঙ্গল চিন্তাও তাঁর দৈনন্দিন যাপনের অংশ হয়ে ওঠে। স্বভাবে, আচরণে রাম শুধু পিতা দশরথের নয়, প্রজাদেরও নির্ভরতার স্থান হয়ে ওঠেন।

আদিকাণ্ডের যবনিকা পড়ে। আদিকবির ধ্যানমগ্নতার অন্তরালে লেখা হতে থাকে অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের গোপন আলেখ্য। তার মাঝে রয়ে যায় রাম-সীতার যৌথ কালযাপনের নিষ্কণ্টক মুহূর্তগুলি। আদিকবির নীরবতা আবৃত করে রেখেছে সেসব মধুর দিন, মধুমাসের ইতিবৃত্ত। সে নীরবতার আড়ালেই রাজপ্রাসাদে ধীরে ঘনিয়ে ওঠে ঈর্ষ্যা, সন্দেহ, দুঃখের কালো মেঘ। সাংসারিক সে ঘূর্ণাবর্তের আবহে আবার যবনিকা সরবে দীর্ঘ বারো বছর পরে, অযোধ্যা কাণ্ডে এসে। এবার অপেক্ষা তার… — চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content