সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


পুরোনো কলকাতা (ছবি সংগৃহীত)

তেলিপাড়া লেন

এই জিনিসগুলোর নাম মার কাছেই শুনেছে বিনয়৷ যতবার বিনয় আর বসুন্ধরা ছিন্নমূল হয়ে এক আশ্রয় থেকে পরের আশ্রয়ে গেছে ততবার বসুন্ধরা গুছিয়ে এই জিনিসগুলো নিয়ে গেছে তার সঙ্গে। মামাবাড়ি কোটালীপাড়া থেকে বাখুন্ডায় আসার সময় জানতে চেয়েছিল এগুলো কী? মা জিনিসগুলো আঁকড়ে ধরে বলেছিলেন এগুলো তাঁর এয়োতির চিহ্ন। কিন্তু আজ এত বছর মা কারও কাছে একবারের জন্যেও বাবার দেশান্তরি হবার জন্য আক্ষেপ করেননি। খুব চেনা আত্মীয়স্বজন এ প্রসঙ্গ তুললে খানিক চুপ করে থেকে বলতেন সবার ভাগ্য তো আর সমান নয়। কত মেয়ের স্বামী তো দূর-দূরান্তে থাকেন৷ আমার না হয় তেমনি। অচেনা বা অল্প চেনা কেউ এসব নিয়ে কথা তুললে মা ম্লান হেসে উত্তর এড়িয়ে যেতেন। গ্রামের সাধারণ মেয়ে হয়েও মায়ের একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব ছিল—যাকে সহজে টপকানো যায় না৷

বাবা কেমন ছিলেন সেটা মার কাছে বাখুন্ডার খুড়ামশায়ের কাছে বা কিছুটা গুহবাড়ির কত্তাবাবুর কাছে শুনেছি৷ শুনেছি তিনি অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন৷ অত্যন্ত সৎ ছিলেন, নির্ভীক ছিলেন৷ কিন্তু এত বিবেক বুদ্ধিমান মানুষ কী করে ছ’মাসের শিশু আর তার স্ত্রীকে একেবারে একলা ছেড়ে দেশান্তরি হয়েছিলেন—সেটা চেষ্টা করেও বোঝা যায় না৷ হ্যাঁ মানছি, তিনি তাঁর পিতৃমাতৃহীন একমাত্র ভাইকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁর বিবাহিত স্ত্রী? তাঁর আত্মজ সন্তান?

তাদের কোন অপরাধে এত কঠিন সাজা দিলেন তিনি? ভালোবাসা না থাক—দায়দায়িত্ব কিছুই কি ছিল না? ছোট থেকে বড় হবার পথে বারবার বিনয় ভেবেছে এই প্রশ্নগুলো সে তার বাবা শ্যামসুন্দরকে করবে। কিন্তু আজ এই চিঠি পাবার পর আর সে স্পৃহা নেই। এতদিন ধরে তিনি ছিলেন না—তাঁর ভয়ংকর একটা অভাব ছিল৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—অনেক অনেক কথা বলার ছিল তাঁকে। আজ খবর পাওয়া গেছে যে তিনি আছেন। সশরীরে এখনও জীবিত আছেন। কিন্তু যেভাবে আছেন বলে জানা গেছে তাতে দেশান্তরে থাকার চেয়ে কষ্ট কিছুমাত্র কমেনি।

তোরঙ্গের জিনিসগুলোকে আঁকড়ে ধরে এভাবে মাকে কাঁদতে দেখে মনে হল মায়ের মনেও সেই যন্ত্রণা গুমরে মরছে৷ এ-কান্না শোকের নয়, আনন্দের নয়, এ-কান্না আক্ষেপের। এত বছর বাদে যদি তবে এইভাবে কেন?

ছুটির দরখাস্ত

পরদিন বিনয় একটু আগেভাগেই অফিসে গেল। অন্যদিনে সকাল ন’টায় স্ট্র্যান্ড রোডের গুদামের চাবি খোলে। আজ সে ক্লাইভ রো অফিসে পৌঁছে গেল সকাল সাড়ে আটটায়৷ পিটারসন সাহেব ঠিক সাড়ে ন’টায় অফিসে ঢোকেন৷ অফিসের কর্মচারীরা ন’টার মধ্যেই পৌঁছে যায়৷ আর তারাপদ পাল আসেন ঘড়ি ধরে পৌনে নটায়। সাহেব আসা পর্যন্ত বিনয় ক্লাইভ রো অফিসে অপেক্ষা করতে পারবে না। কাশী থেকে আসা চিঠিটা সে সঙ্গে করে এনেছে। সেটাই তারাপদবাবুর হাতে দিয়ে সে ছুটবে স্ট্র্যান্ড রোডের গুদাম খুলতে। সকাল সকাল গুদাম থেকে পাইকেরদের অর্ডারি চা পাঠাতে হবে। বাগান থেকে আসা নতুন চায়ের পেটিও ঢুকবে গুদামে৷ খাকি রঙের পোশাক পরা সাহেবের খাস পিয়ন সাতসকালে বিনয়কে অফিসে দেখে খুব অবাক হল। তবে সে জানে সাহেবের সঙ্গে বিনয়ের সম্পর্ক ভালো তাই এখন সে আর তাকে ঘাঁটায় না।

ঠিক পৌনে ন’টায় চ্যাপটা টিফিন কৌটো ভরা কালো রঙের পেটমোটা ব্যাগটা ডান বগলে চেপে বাঁ হাতে ছাতা ঠুকতে ঠুকতে তারাপদবাবু পৌঁছলেন। অফিসের বারান্দায় উদগ্রীব বিনয়কে দেখে তারাপদবাবু অবাক—
—কী ব্যাপার? বিনয় তুমি? এখানে? এই সময়ে? কোনও বিপদ-আপদ হয়নি তো?
—আজ্ঞে না, সেরকম কিছু নয়, তবে আপনার সঙ্গে খুব জরুরি দরকার৷
—দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে রেজিস্টার খাতায় সইটা করে নিই—তবে তুমিই-বা দাঁড়াবে কেন? তুমি তো আর বাইরের লোক নও! এসো এসো, ভেতরে এসো, একটু চা জল খাও!

বিনয়ও সঙ্গে সঙ্গে গেল। অফিসের রেজিস্টার খাতায় তারাপদবাবু সই করে নিজের চেয়ারে বসামাত্রই—বিনয় গড়গড় করে ঝড়ের বেগে শুনিয়ে দিল কাশীর থেকে আসা চিঠি এবং চিঠির বক্তব্য।

মোদ্দাকথা, তারাপদবাবুকে এই চিঠি সাহেবকে দেখিয়ে চিঠির বক্তব্য ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলতে হবে—এটা বলতে হবে যে আজ প্রায় ১৮/১৯ বছর পরে বাবার জীবিত সংবাদ পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে কাশীতে রয়েছেন৷ কথা শেষ করে বিনয় জানাল তার হাতে আর একমুহূর্ত সময় নেই ঠিক ন’টায় তাকে গুদামের দরজা খুলতে হবে। না হলে ঠিকে মুটেরা অন্য গুদামে চলে যাবে।

কথা শেষ করেই বিনয় উলটোদিকে দৌড়াতে যাচ্ছিল—তারাপদ তাকে থামায়।
—মন দিয়ে একটা মিনিট কথাটা শোনো৷ ব্যাপারটা হল তোমার ছুটি লাগবে—ছুটির দরখাস্ত জমা করার আগে সাহেবের সঙ্গে কথা বলে রাখতে হবে এই তো? আর এক-দুদিনের ছুটি তো নয় লম্বা ছুটি৷ দিন ১৫ কিংবা এক মাস।
—আজ্ঞে হ্যাঁ৷
—কিন্তু এক্ষুনি তোমাকে ছাড়া হয়তো সাহেবের একটু অসুবিধেই হবে। আমি অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্টে আছি বলেই বলচি, কাল ডেলিভারির অগ্রিম জমা পড়েচে। পাটনা ভুবনেশ্বর এসব জায়গায় এখুনি মাল যাবে। আসাম শিলিগুড়ি দার্জিলিঙের বাগান থেকে অকশনের কিছু নতুন মাল গুদামে উটবে। তাই কাজটা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করা দরকার। কোনওরকমে এক হপ্তার মালটা ডেলিভারি করে দিতে পারলে…তবে তুমি চিন্তা কোরো না আমি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দেখি।

তারাপদবাবু চিন্তা না করতে বললেও একরাশ চিন্তা নিয়ে বিনয় গুদামে ফিরল৷ প্রথম চোটেই আর্জেন্ট কাজগুলো সেরে ফেলল৷ তারপর চেয়ারে বসে দু-দণ্ড শান্তভাবে ভাবল—আর বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার মাথায় সমাধান এসে গেল।

কিন্তু এই সমাধান করতে গেলে প্রথমেই মুটেদের সরদারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে গুদামের দারোয়ানদের সঙ্গেও।

কোনও ভণিতা না করে বিনয় সরাসরি সত্যি কথাটা বলল মুটেদের সরদারকে। কী ভাগ্যি আরও জনা তিনেক মুটেও এসেছিল। মুটেদের সরদার এবং মুটেরা এককথায় বিনয়কান্তিকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। এত বছরের জীবনে এই প্রথম কেউ তাদের সঙ্গে মানুষের মর্যাদা দিয়ে কথা বলেছে। গোডাউনের দু’জন দারোয়ানও ‘বিনোয়বাবু’র কথায় রাজি।

দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ গোডাউনের সেদিনকার কাজ মিটিয়ে বিনয় ফিরল ক্লাইভ রো অফিসে৷ তারাপদবাবু জানালেন, ছুটিতে সাহেবের কোনও আপত্তি নেই তবে সমস্যা এই সময়টায়৷ পিটারসন সাহেব তারাপদবাবুকে বলেছেন গোডাউন থেকে ফিরলে তিনি যেন বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন৷

পিটারসন সাহেবের সামনে বিনয় যা যা বলল সে কথা শুনে চমকে উঠলেন তারাপদবাবু—এবং স্বয়ং পিটারসনও অবাক। মাত্র কয়েক মাস কাজ করা একজন কর্মী কোম্পানির কথা এভাবেও ভাবতে পারে।

বিনয় বলেছিল,
—দেখুন সাহেব৷ আমার বাবা প্রায় ১৯ বছর দেশান্তরি ছিলেন। আর এই চিঠিটা কাশী থেকে ফরিদপুরের বাখুন্ডা হয়ে ঘুরপথে কলকাতায় আমাদের হাতে এসে পড়েছে৷ ভাগ্যক্রমে গুহবাড়ির বড়ছেলে বাখুন্ডায় গিয়েছিলেন তাই হাতে হাতে চিঠিটা পেয়েছি। ডাকে এলে এ চিঠি তো এখনও হাতে পেতামই না। এতগুলো বছর বাদে যখন বাবার সংবাদ পেয়েছি তখন চার-পাঁচটা দিন দেরি হয়ে গেলে কোনও অসুবিধে হবে না৷ রেলের টিকিট পেতে হয়তো এক দুদিন বিলম্ব হতে পারে—টিকিটের কথায় মনে পড়ল—আপনার কেউ জানাশোনা আছে নাকি তারাপদবাবু?
—আরে বিলক্ষণ আচে। তুমি রেলের টিকিট নিয়ে কখনও চিন্তা কোরো না৷ আমার সম্বন্ধীর খুড়তুতো ভাইটি, রেলের টিকিট ঘরেই কাজ করে। কোন ট্রেন আর কোন ক্লাস সেটা বললেই তোমার হাওড়া বেনারসের রেলটিকিট হয়ে যাবে।
বিনয় যেন নিশ্চিন্ত হল৷
—তাহলে আমি দিনদুয়েক দেখে নিয়ে তবে রেলের টিকিট কাটতে দেব।
তারাপদবাবুর ধন্ধ কাটছে না—তাই বলে উঠলেন,
—আরে বাপু কমপক্ষে দিন ছয়েকের কাজ। মাত্র দু’দিনে কাজ কতটুকু এগোবে?

আত্মবিশ্বাসী বিনয়কান্তিকে দেখে পিটারসন অবাক। তারাপদবাবু চশমা কপালে তুলে ভাবেন মাত্র ক’মাস চাকরিতে ঢুকে এই সমস্যার সমাধান ছোকরা করবে কীভাবে?

অবাক পিটারসন সাহেব আর হতবাক তারাপদবাবুকে বিনয়কান্তি বুঝিয়ে দিল,
—দুদিনে ৮ ঘণ্টা করে কাজের সময় ১৬ ঘণ্টা বটে—কিন্তু দিন দুটো জুড়ে ঘণ্টা হিসেবে ২৪ দুকুনে ৪৮ ঘণ্টা৷ তিন দিনে ৭২, চার দিনে ৯৬ ঘণ্টা। যেটা ৮ ঘণ্টা দিনের হিসেবে ১২ দিনের কাজ। সাহেব আমি দারোয়ানদের সঙ্গে কথা বলেছি—তাদের তো শিফটের ডিউটি। তারা রাজি। মুটে সরদারের সঙ্গে কথা বলেছি। সঙ্গে জনাকয়েক মুটেও ছিল। তারাও সকলে রাজি।

তারাপদবাবুদের এতদিনকার চাকরি জীবনে এমন কথা কখনও শোনেননি। তিনি পিটারসন সাহেবের দিকে তাকালেন। পিটারসন গালে হাত রেখে চশমার কাচ আর দুই ভুরুর মধ্যে দিয়ে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে।

তারাপদবাবু এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
—কীসে রাজি? বিনয় তুমি ঠিক কী করতে চাও একটু বুজিয়ে বলো তো। বাংলা ভাষা আমিই বুঝতে পারছি না তো সাহেব কী করে বুজবে? —চলবে

এগোনোর পথ পাথুরে বন্ধুর। ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি

পরের পর্ব আগামী রবিবার
‘মা, টাকাপয়সা হল আঁজলা ভরা জল—হাতে জমিয়ে রাখা যাবে না—আঙুলের ফাঁকফোকর দিয়ে হাতের চেটোর খাঁজ গলে সেই এক আঁজলা জল একটু একটু শেষ হয়ে যাবে—একটুখানি বাঁচবে। তাই অপেক্ষা কোরো না তেষ্টা পেলে চুমুক দাও—ক্লান্ত হলে মুখেচোখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দাও—যতটা পারো নিজের কাজে নিজের প্রয়োজনে লাগাও। বাকি যতটুকু সম্ভব সঞ্চয় করো।’
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content