রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


বল্লাল ঢিবি-এর বিভিন্ন অংশ।

অতিমারির আবহে একদিকে জীবন-মৃত্যুর ভয় আর একদিকে যাপনহীন জীবনে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন মন চাইছিল কোথাও একটু ঘুরে আসি। কিন্তু কোথায় যাব! অন্য রাজ্যে তো যাওয়ার উপায় নেই, যদি লকডাউন হয়ে যায়, তাহলে ফিরতে সমস্যা হবে। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মনে হল মায়াপুর ঘুরে আসি। বর্তমানে আমি কলকাতার বাসিন্দা হলেও কৃষ্ণনগরই আমার জন্মস্থান। তাই মায়াপুর আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবুও বাংলার অক্সফোর্ড নবদ্বীপ ও তৎসংলগ্ন মায়াপুরের আকর্ষণ চির অম্লান।

সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারি মাস। যাত্রার দিনক্ষণ স্থির হল। বাবা বললেন, মায়াপুর যাওয়ার পথে বামুনপুকুরে একবার অবশ্যই গাড়ি থামাবি। কেন? কী আছে ওখানে? শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস—সেন বংশের (প্রত্নতাত্ত্বিক) নিদর্শন। শোনামাত্রই বড় আফসোস হল। সত্যিই তো ! কতবার গিয়েছি নবদ্বীপ, মায়াপুর অথচ বামুনপুকুরের এই ঐতিহাসিক স্থানটি তো একবারও দেখা হয়নি!

সকাল সাতটা পনেরো। নিউটাউন (কলকাতা) থেকে যাত্রা শুরু করলাম ফোর হুইলারে। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হলেন ধৃতিকণা বউদি ও তাঁর পরিবার। যদিও মায়াপুর ভ্রমণের পরিকল্পনা ধৃতিকণা বউদিরই ছিল। নিউটাউন, হলদিরাম পার করে যশোর রোড ধরে আমরা জাতীয় সড়কে (এন এইচ থার্টি ফোর) উঠলাম। চাকদায় জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থা। তবুও রাস্তার দু’ধারের সবুজ ধানখেত চোখ আর মনকে জুড়িয়ে দেয়। ডিম সেদ্ধ, কলা, মিষ্টি, কেক সহযোগে জলযোগ পর্বের সমাধা হল গাড়ির ভেতরেই। সকাল দশটা নাগাদ পৌঁছলাম কৃষ্ণনগর। তারপর জলঙ্গীর ব্রিজ পেরিয়ে মায়াপুরের পথ ধরলাম। কৃষ্ণনগর—যেখানে কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন। জন্মস্থানের মাটির গন্ধ প্রাণ ভরে নিতে নিতে বামুনপুকুর বাজারে যখন আমরা পৌঁছলাম, তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে। বাজারের মধ্যেই ভক্ত চাঁদ কাজির সমাধিস্থল। চাঁদ কাজি তৎকালীন যুগে ওই এলাকার একজন ছোট রাজা ও বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে বৈষ্ণব আন্দোলন ও শ্রীচৈতন্যদেবের ঘোরতর বিরোধী হলেও পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। চাঁদ কাজির সমাধির উপর প্রকাণ্ড চাঁপাগাছটি প্রায় পাঁচ শত বছরের পুরানো। কথিত আছে, শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং এই গাছটি রোপণ করেছিলেন। এই বিশালাকার চাঁপাগাছের নীচে বসে হিন্দুরা যেমন ধর্মালোচনা, পাঠ ইত্যাদি করেন, তেমনি মুসলমান ফকিরেরাও। হিন্দুরা এখানে ধুপ-ধুনো জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন, মুসলমান ধর্মাবলম্বীরাও চাদর চড়ান, প্রার্থনা করেন। আগত ভক্তরা সমাধিস্থল প্রদক্ষিণ করতে কখনওই ভোলেন না। হিন্দু-মুসলিমের এমন আশ্চর্য মিলনক্ষেত্র সত্যিই বিরল। যেকোনও ধর্মের সার কথাই তো প্রেম, মিলন ও পরধর্মসহিষ্ণুতা। সেই অর্থে চাঁদ কাজির সমাধিস্থল সত্যি যেন এক আদর্শ ধর্মস্থল। তাই তো এই সমাধিস্থল দর্শন না করলে মায়াপুর ভ্রমণ পূর্ণতা লাভ করে না।

সমাধিস্থল থেকে বেরিয়ে উত্তর-পশ্চিমের কংক্রিটের পথ ধরে কিছুটা হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম বল্লাল ঢিবি। সেন বংশের ইতিহাসের সাক্ষ্যবহনকারী প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ ফুট উঁচু ঢিবিতে ধীরে ধীরে উঠলাম। আমাদের খুদে ভ্রমণসঙ্গী টিনটিন দৌড়ে, লাফিয়ে উপরে উঠে গেল। চারশো ফুট প্রশস্ত, সবুজ ঘাসে মোড়া এবং কাঁটাতার দ্বারা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত স্থানটির নিউটাউন থেকে দূরত্ব প্রায় ১১৭ কিলোমিটার। হাজার বছরের প্রাচীন শহরের প্রাচীনত্বের ভিত হিসেবে পণ্ডিতেরা যে স্মারকটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন, তা এই বল্লাল ঢিবি। রাজকীয় বৈভব আর ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ সে যুগের নবদ্বীপ ছিল বাংলার অন্যতম শক্তিশালী রাজা বল্লাল সেনের রাজধানী। পরবর্তীতে এই শহর তুর্কি উচ্চারণে হয়ে ওঠে নওদিয়াহ। নওদিয়াহ থেকেই নাকি জেলার নাম হয় নদীয়া।

ঘুরে ঘুরে দেখছি। ভগ্নাবশেষের আনাচেকানাচে উঁকি দিচ্ছে ইতিহাস। তার মাঝেই চলছে ফটোসেশন। অর্কমিতা একজন দক্ষ ফটোগ্রাফার। অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে সে ক্যামেরাবন্দি করছে ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্নকে। আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে মধ্যযুগকে মুঠোফোনে বন্দি করে নিচ্ছি আমরা সকলেই। ইমারতের ভূগর্ভস্থ অংশে নেমে যাওয়ার কোনও সিঁড়ি নেই। অথচ উৎখননের ফলে এই অংশটি অনাবৃত। কী আছে ওখানে? দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না কেউই। তাই একে অপরের সাহায্য নিয়ে একটু কষ্ট করে নীচে নামলাম। পোড়ামাটি-চুন-সুরকি-ইটের দেওয়ালে জমে আছে কত তথ্য, কত না-বলা কাহিনি। মাটির নীচের এই অংশটিও বেশ প্রশস্ত। ঘুরে ঘুরে যখন দেখছি আর ইতিহাসকে অনুভব করার চেষ্টা করছি, তারই মাঝে দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছে টিনটিন। সে প্রবল উৎসাহে এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে তার খেলার জায়গা বানিয়ে নিয়েছে। ভগ্নশেষ অংশের পঁচিশ- ত্রিশ ফুট উঁচু প্রাচীরের উপর দৌড়ে উঠে যাচ্ছে, আবার আমাদের বকুনি খেয়ে নেমে আসছে নীচে। ও তো জানে না ওর এই আনন্দদায়ক খেলার স্থানটির নীচে ঘুমিয়ে আছে মধ্যযুগের ইতিহাস ! কজনই বা জানে!

বল্লাল ঢিবি চিরকালই রহস্যাবৃত। আসলে কী এই বল্লাল ঢিবি? সত্যিই কি সেনরাজাদের প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ? নাকি বৌদ্ধস্তূপ? নিশ্চিত উত্তর আজও সকলের অজানা। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লিখিত তথ্য থেকে জানতে পারি—খননকার্যের সময় পঙ্খের মূর্তি, পোড়ামাটির মানুষ, জীবজন্তুর মূর্তি, তামা ও লোহার জিনিসপত্র, পেরেক ও নানান প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গিয়েছিল। বিস্তৃত প্রাঙ্গণের মধ্যে অবস্থিত বৃহদায়তন ইটের ইমারতের চারদিকে উঁচু প্রাচীর। এই ভগ্নাবশেষের যে অংশটি বিশেষ নজর কাড়ে, তা হল সিংহের মুখ সমন্বিত পয়প্রণালী। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়—ইমারতের নীচের অংশটি নির্মাণের অনেক পরে উপরের অংশটি নির্মাণ করা হয়। অষ্টম-নবম শতকে ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরাতন স্থাপত্য কীর্তির উপর নির্মিত এই সৌধের উপরিভাগ আনুমানিক দ্বাদশ শতক। তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে মেরামত, পরিবর্তন এবং সংযোজনের নিদর্শনও পাওয়া গেছে। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, ধ্বংসস্তূপটি ছিল তৎকালীন যুগের ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর বিজাপুরের একটি অংশ। বিজাপুর ছিল সেন আমলের এক অত্যাধুনিক শহর ও সেনবংশের রাজধানী। এই শহরটি স্থাপন করেছিলেন বল্লাল সেনের পিতা বিজয় সেন।

দুটি পর্যায়ে ঢিবির খননকার্য হয়েছিল। প্রথম খনন ১৯৮২-৮৩ সালে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৮৮-৮৯ সালে। শক্তিশালী ও সুপণ্ডিত রাজা বল্লাল সেন রচিত ‘অদ্ভুদসাগর’ অনুসারে অনুমান করা হয় যে, বল্লাল ঢিবির প্রাচীনত্ব আটশো বছরেরও বেশি। ঢিবির পাশেই রয়েছে একটি গোরস্থান। এটি সেন বংশের আমলে নির্মিত বলে মনে করা হয়। পোড়ামাটি, চুন-সুড়কি ও ইটের তৈরি ইমারতের প্রাচীরে লুকিয়ে আছে কত শত ইতিহাস। ‘ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ’ এই উৎখননের কাজ শুরু করলেও মাঝপথে কেন বন্ধ হয়ে গেল, তা আজও এক প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে! উৎখননকার্যের সুপারিনটেনডেন্ট আর্কিটেক্ট অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমান ছিল—উত্তর দিকে মাটির নীচে কমবেশি এক কিলোমিটার খুঁড়লেই মিলতে পারে মধ্যযুগের ইতিহাসের চাপা পড়ে থাকা কাহিনি। এমনই নিদর্শন তিনি পেয়েছিলেন গবেষণা করে—বল্লাল ঢিবিতে আসার আগে একটু-আধটু পড়াশোনা করে এই তথ্যটা জানতে পেরেছিলাম। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী ধৃতিকণা বউদি ইতিহাসের কৃতী ছাত্রী। তাই ঐতিহাসিক স্থান তাঁর বরাবরই খুব পছন্দের। আমাদের ঘরের কাছেই এমন একটা অজানা ঐতিহাসিক স্থানকে দেখে তিনি ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন। ভাগ্যিস বাবা বলে দিয়েছিলেন, তা না হলে তো এবারেও ইস্কন মন্দির দেখেই বাড়ি ফিরে আসতাম। ঐতিহাসিক সুধীররঞ্জন দাসের রচনায় বল্লাল ঢিবিকে বৌদ্ধ বিহার বলা হয়েছে। অর্ধ আবিষ্কৃত এই বল্লাল ঢিবির ভ্রমণ কাহিনি বলতে গেলে ইতিহাস পরিবেশনই হয়ে যায়।

প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় আমরা অতিবাহিত করেছিলাম বল্লাল ঢিবিতে। শীতের সোনানি নরম রোদ গায়ে মেখে ঢিবির ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাগল, কুকুর। ঢিবির ওপর বসে তাস খেলতে খেলতে নরম রোদে পিঠ সেঁকে নিচ্ছে তরুণের দল। আমাদেরই চোখের সামনে আমাদের এই অনাদর অবহেলার অন্তরালে আজও প্রকাশের অপেক্ষায় সেন বংশের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়। আশপাশের বিস্তৃত সরকারি জমির অনেকাংশই জবরদখল হয়ে গেছে। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনের মালিকানা ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের। দর্শনার্থীদের জন্য নিঃশুল্কে উন্মুক্ত বল্লাল ঢিবি। ছবি তুলতে তুলতে মন যেন হারিয়ে গিয়েছিল সেই অজানা অতীতে। আজ ঠিকভাবে উৎখনন হলে মধ্যযুগের ইতিহাসের গতিপথটাই হয়তো বদলে যেত। দেখতে দেখতে বেলা হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। এবার গন্তব্য মায়াপুর ইস্কন। গ্রাম্য পথ ধরে ফিরে আসতে গিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালাম—অনাবিষ্কৃত ইতিহাস যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

কীভাবে যাবেন
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে কৃষ্ণনগরে নেমে মায়াপুরগামী বাসে চলে আসতে পারেন। এছাড়াও হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে নবদ্বীপধামে নেমে টোটোতে গঙ্গার ঘাট, তারপর নৌকায় মায়াপুর আসতে পারেন। মায়াপুর থেকে অটোতে বা টোটোতে বামনপুকুর পরিদর্শন করতে পারেন।

কোথায় থাকবেন
মায়াপুর ইস্কন মন্দিরের ভিতরে থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও মন্দিরের বাইরে রয়েছে অসংখ্য হোটেল। ইচ্ছে করলে নবদ্বীপেও থাকতে পারেন। সেখানেও রয়েছে অসংখ্য হোটেল এবং গেস্ট হাউস। গুগলে সার্চ করে অগ্রিম বুকিং করে যেতে পারেন।

ছবি : লেখক
* বাইরে-দূরে: বল্লাল ঢিবি (Travel – Ballal Dhipi) : সোমা চক্রবর্তী (Soma Chakrabarti), শিক্ষিকা, নিমতা জীবনতোষ ঘোষ মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক)।

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content