শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


গুগলি (পর্ব-১)

মৃদুল সাহা লেফট আর্ম স্পিনার, রাইট হ্যান্ড মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। এঁদের ক্রিকেটীয় পরিভাষায় অ্যাম্বিডেক্সট্রাস ক্রিকেটারস বলা হয়। বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটে এই সংখ্যা কম। অস্ট্রেলিয়ার মাইকেল জন ক্লার্ক ২০১৫ সালে নিজের অধিনায়কত্বে দেশকে বিশ্বকাপ উপহার দেবার পর অবসর নিয়েছেন। সেই দেশেরই ২০২১ সালে টি-২০ বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক অ্যারুন জেমস ফিঞ্চ, আর আমাদের খুব পরিচিত ভিনু মানকড়। এরা তিনজনেই অধিনায়ক ছিলেন। তিনজনেই মূলত ব্যাটসম্যান। দলের প্রয়োজনে বোলিং করতেন। আমাদের গল্পের মৃদুলের সঙ্গে এঁদের মিল এক জায়গায়, মৃদুলও এই কাহিনির সময়কালে রাজস্থান ক্রিকেট ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। কিন্তু অমিল হল মৃদুল মূলত বোলার দলের প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার ব্যাটসম্যান হিসেবে দলকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
এই গল্পের সময়টা একটু পিছিয়ে। মানে এই রহস্য সমাধানের সূত্র ধরেই আজকের ডিসিডিডি ভৈরব চক্রবর্তীর সঙ্গে ধৃতিমানের আলাপ। গড়িয়া রথতলার শ্রেয়া বাসু তখনও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বাবা কনস্টেবল ত্রিদিব বসু কলকাতা পুলিশের কর্মী। এরও বেশ কয়েক বছর পর শ্রেয়া যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে হাতে কলকাতার একটি মাঝারি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি থেকে চাকরির চিঠি পেয়েছে, তখনই তাদের সংসারে সেই ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৬৫: বাথটাব/১৭

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮২: মা সারদার ভক্ত যোগেন মায়ের কথা

খিদিরপুরে ভোটের সময় ডিউটিরত অবস্থায় বুকে গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ত্রিদিব বাবুর। না ওঁকে লক্ষ্য করে কেউ গুলি ছোঁড়েনি। আমাদের দুর্ভাগ্য মূলত আইনশৃঙ্খলার রাশ আলগা হয়ে যাবার কারণেই যথেষ্ঠ পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র সমাজের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে, সেসব এমন হাতে গিয়ে পৌঁছেছে যারা ঠিক করে গুলিটা চালাতেও পারে না। ভোটের দিন খিদিরপুরে এমনই একজন আনাড়ি একপক্ষ থেকে অপরপক্ষের উদ্দেশ্যে গুলি চালিয়েছিল। গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবল ত্রিদিব বসু হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে দেয়। মুখ্যমন্ত্রীর বদান্যতায় শ্রেয়া কলকাতা পুলিশে চাকরি পায়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৮: রামানুজ ভরত ও লক্ষ্মণ, আনুগত্যের প্রকাশে দু’জনেই অনন্য

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী

ধৃতিমান মানে আমাদের বাবু তখন তার প্রথম ছবিটা রিলিজ করাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তখনও চলচ্চিত্রের ব্যকরণ মেনে প্রকৃত অর্থে বানানো সিনেমার একটা দর্শক ছিল। সিরিয়াল ঘেঁষা পারিবারিক ছবি নিছক কমার্শিয়াল ছবির তকমা পেতো। ভালো বাংলা ছবি বানানোর জন্য তরুণ মজুমদার তপন সিনহা তখনও ক্যামেরার পিছনে দাঁড়াচ্ছেন। সিনেমা কাঊন্টারে হাউসফুল হতো ইউটিউবে নয়। জানা-শোনাদের ধরে করে ধৃতিমান এখানে সেখানে তাঁর প্রথমছবি ‘ভুবনপুরের মাঝি’-র প্রাইভেট শো করছে। সেখানেই কারও একজনের গেস্ট হয়ে ক্রাইমব্রাঞ্চের দুঁদে অফিসার সিনেমাপাগল ভৈরব চক্রবর্তী সিনেমাটা দেখলেন।

ভুবনপুরের মাঝির মতো লিরিক্যাল একটা নাম হওয়া সত্বেও ছবিটা একটা থ্রিলার। আলাপ করে বলেছিলেন—
—সিনেমা করছেন করুন গোয়েন্দাগিরি করলে তো আমাদের চাকরি খেতেন মশাই।
—গোয়েন্দাগিরি করতে চেয়েছিলাম সুযোগ পাইনি তাই আর করা হয়নি।
—সুযোগ পেলে করবেন।
মাথাটা হেলিয়ে ধৃতিমান বলেছিল—
—এককথায়! নাটক সিনেমার মতো সত্যানুসন্ধানটাও আমার প্যাশন!
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭০: অনিশ্চিত ফলের পিছনে না ছুটে নিশ্চিত ফল-প্রদায়ক কাজের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৮: শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন দ্বারকানাথ

ঘনঘন যোগাযোগ হলে আলাপ ঘনিষ্ট হয়ে ওঠে। ধৃতিমানের সঙ্গেও ভৈরব চক্রবর্তীর আলাপটা সেভাবেই জমে উঠেছিল। মাঝেমধ্যে চলতি কেস নিয়ে ধৃতিমানের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনা করতেন মিস্টার চক্রবর্তী। ধৃতিমান অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলতো, একেবারে অন্যভাবে ভাবতে পারতো ধৃতিমান।

জাতীয় ক্রিকেট নিয়ে আমরা মাতামাতি করি কিন্তু কলকাতার ক্লাবস্তরের ক্রিকেট নিয়ে আপামর জনসাধারণের সেরকম খুব একটা উৎসাহ নেই। সেটা আছে ফুটবলে। একেবারে হালে এসে আইপিএল হয়েছে টি২০ হয়েছে। অনেক নতুন নতুন তরুণ খেলোয়াড়দের নাম নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান উঠছে। সে সময়টা তেমন না হলেও মৃদুল সাহাকে নিয়ে মাতামাতি ছিল। বাঁ হাতের মোচড়ে স্পিন বলের সঙ্গে সঙ্গে সাংঘাতিক গুগলি করতে পারত মৃদুল। কলকাতা মাঠের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রাজস্থান ক্লাবের হয়ে অনেক নামজাদা ক্রিকেট দলকে একা ধরাশায়ী করেছে মৃদুল সাহা। পারিবারিক সোনার ব্যবসা। যথেষ্ট টাকাকড়ি রয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া

তবে তখন তো আর ক্রিকেটারদের নিলাম হতো না। তাই চোখ ধাঁধানো না হলেও চোখে পড়ার মতো জীবনযাপন করত মৃদুল। দামি গাড়ি নিয়ে কলকাতার অভিজাত ক্লাবে ঘুরতে দেখা যেত তাকে। আর লোকমুখে শোনা যায় অবিবাহিত রোমিও স্বভাবের ক্রিকেটার মৃদুল সাহার গাড়ির পাশের নারী বদলে বদলে যান। বাংলার ক্রিকেট দলের হয়ে খেলার সুযোগের কথা উঠেছে । এমন একটা সময়ে মাঠে নামার ঠিক আগের মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তরুণ সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার মৃদুল সাহা। সেদিন রাজ্যস্তরের কয়েকজন সিলেক্টর খেলা দেখতে এসেছেন। মাঠে উপস্থিত ফিজিওরা ছুটে এলেন। কিন্তু সকলকে অবাক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন মৃদুল।

মোবাইল তখন সবে এসেছে। ধৃতিমানের কাছে মোবাইল ফোন ছিল না। উল্টোডাঙার আরিফ রোডে তার ভাড়াবাড়ির একতলায় রাজ এসটিডি থেকে খবর পেল একজন ফোন করেছিলেন জরুরি দরকার। তাঁর অফিসের ফোন নম্বর দিয়েছেন। —চলবে।

গুগলি: পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content