বৃহস্পতিবার ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ ও বীরেন্দ্র কিশোর।

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কাশী থেকে সারনাথ যাবার পথে এক মোটর দুর্ঘটনায় মহারাজ রাধাকিশোরের মৃত্যুর ঘটে। রাধাকিশোরের পর রাজ্যভার গ্রহণ করেন পুত্র বীরেন্দ্র কিশোর। বন্ধু বিয়োগে কবি কাতর হলেন। কিন্তু ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অটুট থাকল। বন্ধুপ্রতিম রাজা নেই, কিন্তু সিংহাসনে তাঁর পুত্র আছেন। রাজপরিবারের ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে কবির উৎকন্ঠা পূর্ববৎ। আগে ছিল বন্ধুকে পরামর্শ, এখন কবির ভূমিকা হল অনেকটা অভিভাবকের। বীরেন্দ্র কিশোরের ছোট ভাই ব্রজেন্দ্র কিশোরকে কবি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। নানা সময়ে মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোরকে কবি নানা বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন।

সিংহাসনে বসেই নতুন রাজা বীরেন্দ্র কিশোর সমূহ সংকটের মুখে। ঋণভার বেড়েছে। রাজ্যের আর্থিক সংকটের সমান্তরাল ভাবে বাড়ছে নানা চক্রান্ত। ব্যাকুল হয়ে উঠে কবির মন। নানা চক্রান্ত আর কপটচারিতা থেকে সিংহাসনকে রক্ষার জন্য কবি ব্রজেন্দ্র কিশোরকে মহারাজার পাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়াতে পরামর্শ দেন। দীর্ঘ তিন পুরুষের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে কবি জানান-দূরে থেকেও ত্রিপুরার মঙ্গল কামনায় তিনি বিরত থাকবেন না। রাজাকে ও রাজ্যকে যাতে কোনো প্রকার দুর্ব্বলতা আক্রমণ করতে না পারে, হঠাৎ যাতে কোনও বিপ্লব বেঁধে না যায় সে জন্য বিশেষ সতর্ক থাকার কথা বলেন কবি। ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ১০ চৈত্র বোলপুর থেকে কবি ব্রজেন্দ্র কিশোরকে লেখেন—”…এখন তোমার প্রতি আমার এই উপদেশ যে, ত্রিপুরার রাজ্যভার যাঁহার প্রতি ন্যস্ত হইয়াছে কায়মনোবাক্যে তাঁহার আনুকূল্যে তোমাকে দাঁড়াইতে হইবে-কারণ,তোমাদের রাজ্যের কল্যাণ তোমাদের সকলের কল্যাণ।
রাজ-সিংহাসনের চারিদিকে অনেক শত্রু আছে, এই সময়ে তোমাদের নূতন রাজাকে তাহাদের কপট বন্ধুতা হইতে সাবধানে রক্ষা করিবে। এক্ষণে তূমিই তাঁহার সকলের চেয়ে নিকটতম আত্মীয়-তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মঙ্গল সম্বন্ধ যেন কিছু মাত্র বিচ্ছিন্ন না হয়-তাহা হইলে বাইরের শত্রুরা সুযোগ পাইয়া বসিবে।তাহারা তোমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ আনিবার জন্য নানা প্রকারে চেষ্টা করিবে সন্দেহ নাই।…তোমাদের রাজাকে ও রাজ্যকে যাহাতে কোনও প্রকার দুর্ব্বলতা আক্রমণ করিতে না পারে-ক্রমে ক্রমে সুযোগ বুঝিয়া যাহাতে সমস্ত জঞ্জাল দূর করিতে পার সে জন্য তোমাকে অত্যন্ত সতর্ক ভাবে চেষ্টা করিতে হইবে। হঠাৎ যাহাতে কোন বিপ্লব বাধিয়া না উঠে, সে জন্যও বিশেষ সাবধান হওয়া আবশ্যক হইবে। আমার একান্ত মনের কামনা এই যে,রাজার সঙ্গে তুমি অভিন্ন হৃদয় হইয়া ত্রিপুরাকে উন্নতির পথে লইয়া যাও। তুমি যদি তোমার সমস্ত শক্তি তাঁহার আনুকূল্যে নিযুক্ত করিবার সুযোগ পাও তাহা হইলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ত্রিপুরা রাজ্যের মঙ্গল হইবে। তোমার পিতা ও পিতামহের নিকট অকৃত্রিম স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া আছি সেইজন্য তোমাদের রাজ্যের কল্যাণ সাধনে কোনোদিন আমি উদাসীন থাকিতে পারি না। দূরে থাকিয়াও আমি ত্রিপুরার মঙ্গল কামনায় বিরত থাকিব না।…”

বীরেন্দ্র কিশোর রাজা হবার পর কোন কোন দিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে কবি সেটা অনুমান করে আগেভাগেই রাজার ভাই ব্রজেন্দ্র কিশোরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করে রাজপরিবারে বিভেদের বীজ বপনের আশঙ্কা করেছিলেন কবি।শত্রুরা যে রাজ সিংহাসনের চারপাশেই রয়েছে কবি সেই ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। সম্ভাব্য বিপদের প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্হা গ্রহণের ব্যাপারে কবি পরামর্শ দিয়েছেন ব্রজেন্দ্র কিশোরকে।কবি আরও একটি চিঠিতে মহারাজকুমারকে লিখেছেন-“তোমরা দুই ভ্রাতায় অভেদাত্মা হইয়া ত্রিপুরা রাজ্যকে কল্যাণে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত কর এই আমি একান্ত মনে আশীর্বাদ করি।”
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৯: ঋণ নেবেন রাজা, কিন্তু এ জন্য কবির দুশ্চিন্তা কম নয়!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০১: খামখেয়ালির গিরীন্দ্রনাথ

কবি যদিও রাজ্য পরিচালনা সম্পর্কে ত্রিপুরার রাজাকে পরামর্শ দিয়েছেন-তবু রাজকার্যে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন এমন কথা উঠুক সেটা তিনি চাইতেন না। এ ব্যাপারে কবি ভীষণ সতর্ক ছিলেন। কবি ব্রজেন্দ্র কিশোরকে লিখছেন—”তোমার পত্র পড়িয়াই ইচ্ছা হইতেছিল একবার তোমার সঙ্গে দেখা করিয়া আসি। কিন্তু প্রথমত এখানে নানা কাজে আবদ্ধ আছি-দ্বিতীয়ত আমি এ সময়ে তোমার কাছে গেলেই লোকে কল্পনা করিবে তোমাদের রাজকার্য্যে আমি নিজেকে জড়িত করিতেছি এবং তাহাই লইয়া নানা কথার সৃষ্টি করিবে। এখনকার দিনে কাহারও মনে কোনো অমূলক সংশয় না জন্মানোই শ্রেয়।…”

ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে আমাদের কাছে যেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথ ধরা পড়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কৃষি বিষয়ক, সমবায় বিষয়ক কিংবা গ্রামোন্নয়ন সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা আজ নিশ্চিত এক দিক নির্দেশ। আমরা জানি জমিদার রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু রাজনীতিক রবীন্দ্রনাথ? এ পরিচয়টা যেন অজ্ঞাত ছিল। ত্রিপুরার রাজা ও রাজপুরুষ, বিশেষত মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোরের সঙ্গে পত্র যোগাযোগের সূত্র ধরেও উদ্ভাসিত হয়েছেন এই অন্য রবীন্দ্রনাথ। বড় ভাই বীরেন্দ্র কিশোর রাজা। ছোট ভাই ব্রজেন্দ্র কিশোরের মনে মান অভিমান থাকতেই পারে।আর রাজপারিষদবর্গের কেউ কেউ এই সুযোগটা কাজেও লাগাতে পারে! কবি রাজা ও রাজ্যের মঙ্গল চান, প্রজাদের মঙ্গল চান এটা ঘটনা। ব্রজেন্দ্র কিশোরের প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহ।তিনি আগরতলা আসতে চান, ব্রজেন্দ্র কিশোরকে দেখতে চান।কিন্তু তখন ব্রজেন্দ্র কিশোরের সঙ্গে দেখা করতে আগরতলা গেলে লোকেরা এমনটা ভাবতে পারে যে কবি তাঁর সঙ্গে কোনো মন্ত্রণা করতে গেছেন।নানা সন্দেহ হবে।

ব্রজেন্দ্র কিশোরের উপর কবির অগাধ আস্হা ছিল। ত্রিপুরাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে ব্রজেন্দ্র কিশোর যে গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম এবং অত্যন্ত উপযুক্ত কবি এ বিষয়ে স্হির নিশ্চিত ছিলেন। কবি ব্রজেন্দ্র কিশোরকে লেখেন—”ঈশ্বর তোমাদের রাজ্যের কল্যাণ করুন অনেক দিন হইতে এই কামনা আমার মনে জাগিয়া আছে-তোমার পিতা ও পিতামহের অহেতুক বন্ধুত্ব আমি কদাচ ভুলিব না-তাহার পরে যে দিন হইতে তোমাকে জানি তোমার প্রতি আমার স্নেহ ক্রমশই প্রগাঢ়তা লাভ করিয়াছে।তোমার সম্বন্ধে আমার হৃদয়ের মধ্যে এই আশ্বাস দৃঢ় আছে সুখে দুঃখে সকল অবস্থাতেই তোমার ধর্মই তোমাকে রক্ষা করিবেন-তোমার ভয় নাই, তোমার পরাজয় নাই-তোমাকে কখনই অসত্য ও অন্যায় পরাভূত করিতে পারিবে না-অতএব ক্ষতি লাভ সম্পদ বিপদ সকল অবস্থায় সকল ঘটনাতেই তোমার আত্মাকে তুমি অপরাজিত রাখিবে।”
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৬: সুন্দরবনের পাখি—কুরচি বক

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

উল্লিখিত পত্রাংশ থেকেই ব্রজেন্দ্র কিশোর সম্পর্কে কবির মনোভাব স্পষ্ট। ব্রজেন্দ্র কিশোর যাতে সর্বদা রাজার পাশে থেকে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যান সেজন্য কবি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছেন। রাজ সিংহাসনের চারপাশে শত্রুরা রয়েছে। তাদের সম্পর্কে কবি বারবার তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছেন। কবিকে তখন যেন আমরা অভিভাবকের ভূমিকায় দেখতে পাই। ১৩২০ বঙ্গাব্দে ব্রজেন্দ্র কিশোর ত্রিপুরার মন্ত্রী হচ্ছেন জেনে কবি উৎফুল্ল হন। কবির মতে এটা উত্তম প্রস্তাব। কবি ব্রজেন্দ্র কিশোরকে লেখেন—”তুমি মন্ত্রীপদ গ্রহণ করিবে ত্রিপুরার পক্ষে ইহা অপেক্ষা কল্যাণকর আর কিছুই হইতে পারে না। এ পর্যন্ত তোমাদের রাজ্য শাসন সম্বন্ধে যত প্রকার প্রস্তাব হইয়াছে এইটেই সকলের চেয়ে ভাল হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ মাত্র নাই। যাহাতে পূর্ণ শক্তিতে তুমি কাজ করিতে পার সেইরূপ অধিকার তোমাকে গ্রহণ করিতে হইবে। পদে পদে বাধা পাইয়া যাহাতে অকৃতকার্য না হও পূর্ব হইতেই তাহার ব্যবস্থা পাকা করিয়া লইবে। কর্ম্ম প্রণালী ও কর্ম্মচারীদের মধ্যে যে সমস্ত পুরাতন জঞ্জাল জমিয়া আছে তাহা দৃঢ়তার সহিত অথচ সময় বুঝিয়া সম্পূর্ণ ভাবে দূর করিয়া দিবে। তোমাদের রাজ্যশাসনটিকে তোমরা ধর্ম্মসাধন রূপে পালন করিও-কোথাও কোনো অন্যায় বা শৈথিল্য ঘটিতে দিয়ো না।…তোমাদের দেশের ভূগর্ভে অরণ্য কান্তারে অনেক সমৃদ্ধি প্রচ্ছন্ন আছে—লক্ষ্মী তোমাদের ওখানে ধরাশয়নে সুপ্ত হইয়া রহিয়াছেন, তাহাকে জাগরিত কর-দেশের সর্ব্বত্র শিক্ষা স্বাস্থ্য বিস্তারিত কর-প্রজাদের প্রতি তোমাদের যে কর্ত্তব্য বহুকাল অনুষ্ঠিত রহিয়াছে তুমি তাহা সর্ব্ব প্রযত্নে সাধন কর তাহাতে তোমার জীবন সার্থক হইবে।…”

উপরোক্ত পত্রাংশে রাজ্য পরিচালনা সম্পর্কে কবির মনোভাবের আঁচ পাওয়া যায় কিছুটা। কবি মন্ত্রীর ভূমিকা কিরূপ চাইতেন? পূর্ণ শক্তিতে যাতে মন্ত্রী কাজ করতে পারেন কবি সেটাই চাইতেন। কবি যে সর্বদাই ত্রিপুরার মঙ্গল চাইতেন, এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে কবি যে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল ছিলেন এটাও ধরা পড়েছে উপরোক্ত পত্রাংশে। তিনি যখন লিখেছিলেন “তোমাদের দেশের ভূগর্ভে অরণ্য কান্তারে অনেক সমৃদ্ধি প্রচ্ছন্ন আছে”—তখন এই পার্বত্য রাজ্যে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের তেমন তৎপরতা শুরু হয়নি। কিন্তু দূরদর্শী কবি এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অনেক আগেই। আজ দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরার রাজস্বের অন্যতম উৎস এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ। ত্রিপুরার মাটির নিচে রয়েছে গ্যাসের বিপুল ভান্ডার। এই গ্যাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মন্ত্রীকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে কবির পরামর্শ কিন্তু সেদিন অন্যরকম ব্যাখ্যা হয়েছিল। রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ সেদিন বলেছিলেন এতে রাজার অধিকার খর্ব হবে। কবি যে সর্বদাই এই পার্বত্য রাজ্যের মঙ্গল চিন্তা করতেন তা ধরা পড়েছে রাজা কিংবা রাজপুরুষদের কাছে লেখা তাঁর সমস্ত চিঠিপত্রে। রাজপারিষদবর্গের কেউ কেউ কবিকে স্বার্থান্বেষী বলে মনে করেছেন, কেউ হয়তো ভেবেছেন মহারাজকে তিনি প্রভাবিত করছেন। কবিকে নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে। কেউ বা ভেবেছেন কবি নাক গলাচ্ছেন রাজকার্যে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে সব জেনে শুনেও ত্রিপুরার মঙ্গল চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৬: সুন্দরবনের পাখি—কুরচি বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোর অবশ্য বেশিদিন মন্ত্রীত্ব করেননি। একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে তাকে যে অনুরোধ করা হয়েছিল দৃঢ়চেতা মহারাজকুমার সেই অনুরোধ রক্ষা করতে পারেননি। বরং তিনি মন্ত্রীপদ থেকে অব্যাহতি নেয়া শ্রেয় মনে করেন। নীতিগত কারণে তিনি রাজার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। সেজন্য মন্ত্রীপদ ত্যাগ করেন তিনি।কবি এরপর ব্রজেন্দ্র কিশোরকে লেখেন—”আমি শিলাইদহে নদীতে কিছুদিন হইতে আছি। তোমাদের ত্রিপুরার রাষ্ট্রনৈতিক অবস্হা কিরূপ কিছু জানতাম না।এমন সময় একজন আত্মীয় আসিয়া উপস্থিত। তিনি বলিলেন তোমরা মন্ত্রীদের জন্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খুঁজিতেছ এবং ইতিমধ্যে অনেক ডেপুটি উমেদারী করিতেছেন। সংবাদটি কি সত্য? তুমি কি কর্ম পরিত্যাগ করিয়াছ? ইহাতে নিশ্চয়ই তুমি মনের শান্তি পাইবে। কিন্তু আমি একান্ত আশা করি এই ব্যাপারে তোমার সাংসারিক গুরুতর ক্ষতি কিছু ঘটিবে না। গভর্নমেন্টের সহিত তোমার কিরূপ কথাবার্তা এবং মহারাজার সহিত তোমার কিরূপ বন্দোবস্ত হইল তাহা জানিবার জন্য আমি উদ্বিগ্ন হইয়া রহিলাম।…”

এটা ঘটনা যে পূর্বতন রাজা রাধাকিশোরের সঙ্গে কবির যেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তেমনটা কিন্তু বীরেন্দ্র কিশোরের সময়ে দেখা যায়নি।অবশ্য এক্ষেত্রে বয়সের ফারাকটাও বিষয়।রাধাকিশোর ছিলেন কবির সমবয়স্ক। স্বাভাবিকভাবেই সখ্যতা ছিল বেশি।কিন্তু রাধাকিশোরের অপর পুত্র ব্রজেন্দ্র কিশোরের সঙ্গে কবির যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল,সেরকম মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোরের সঙ্গে কেন দেখা গেল না তা নিয়ে পরবর্তীকালের গবেষকগণ প্রশ্ন তুলেছেন। আসলে সম্পর্কের রসায়ন সর্বদা এক খাতে প্রবাহিত হয় না। সর্বোপরি বীরেন্দ্র কিশোরের রাজত্বকালে কবি হয়তো নানা কাজে অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি রাজ্যাভিষেকের সময় উপস্থিত থাকার জন্য স্বয়ং বীরেন্দ্র কিশোর কবিকে আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও কবি আগরতলায় সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

প্রত্যুত্তরে কবি রাজাকে লেখেন—”কিছুকাল হইতে জলপথে যাপন করিতেছি এই জন্য মহারাজের সাদর নিমন্ত্রণ পত্র পাইতে বিলম্ব হইয়াছে।আমাকে সম্প্রতি যে বিষয়কর্ম্মে ব্যাপৃত হইতে হইয়াছে তাহাতে মহারাজের অভিষেক উৎসবে আমার পক্ষে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব হইবে। আমি মহারাজের পিতৃবন্ধু এবং একান্ত মনে আমি ত্রিপুরা রাজ্যের মঙ্গল কামনা করিয়া থাকি।” রাধাকিশোরের রাজত্বকালে ত্রিপুরায় কবিকে যে এক রাজনীতিকের ভূমিকাতে দেখা গিয়েছে বীরেন্দ্র কিশোরের রাজত্বকালে তেমনটা কিন্তু দেখা যায়নি। এ থেকে এমনটা ধারণা করা যায় যে, ত্রিপুরার রাজকার্যে বাইরের কারও পরামর্শ বীরেন্দ্র কিশোর হয়তো পছন্দ করতেন না। রবীন্দ্রনাথ হয়তো এটা বুঝতে পেরেই নিজেকে ত্রিপুরা রাজদরবারের ঘটনা প্রবাহ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ত্রিপুরার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কবি সর্বদাই ত্রিপুরার মঙ্গল কামনা করেছেন। মহারাজ ব্রজেন্দ্র কিশোরকে পত্র মারফত নানা পরামর্শ দিয়েছেন। বোলপুর বিদ্যালয়ের বার্ষিক সাহায্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন রাজা ও মহারাজকুমারকে। কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে, ব্রজেন্দ্র কিশোরের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাই রাজার সঙ্গে কবির সম্পর্ক নিবিড় হবার পথে অন্তরায় ছিল। ১৩২০ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার লাভ উপলক্ষ্যে আগরতলাতেও এক অভিনন্দন সভার আয়োজন হয়েছিল।

বীরেন্দ্র কিশোরের রাজত্বকালেও কবি আগরতলা সফরে এসেছেন। এটি ছিল কবির ৬ষ্ঠ বারের আগরতলা সফর। ১৩২৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে রাজদরবারের আমন্ত্রণে সফরে আসা কবি সেবার কুঞ্জবন বাংলায় অবস্থান করেছিলেন। এই কুঞ্জবন বাংলায় অবস্থানের স্মৃতি প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে কবি বলেছিলেন—“পৃথিবীতে প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র অনেক দেখিয়াছি কিন্তু ওই ত্রিপুরার কুঞ্জবনের শৈলশ্বেত ভবন আমার স্মৃতি হইতে মলিন হইতে পারিতেছে না।” কবি সেবার আগরতলা উমাকান্ত একাডেমী বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের পক্ষে প্রধান শিক্ষক শীতল চক্রবর্তী কবিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।৬ষ্ঠবারের আগরতলা সফরকালে সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদি নানা বিষয়ে কবির সঙ্গে মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোরের আলোচনা হয়েছিল। এর কিছুদিন পর শান্তিনিকেতনে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য মহারাজা পাঁচ হাজার টাকা দান করেছিলেন। উল্লেখ করা যায় যে, বীরেন্দ্র কিশোরও একজন সংস্কৃতিমনস্ক রাজা ছিলেন। তিনি একজন উঁচুমানের চিত্রশিল্পী ছিলেন। সেতারবাদন সহ সঙ্গীতে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল।রবীন্দ্রনাথ মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোরকে শান্তিনিকেতন পরিদর্শনের জন্যও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৩ই মাঘ কবি রাজাকে লিখেছিলেন—“…অবকাশমত কোনো এক সময়ে মহারাজ আশ্রম দর্শন করিতে আসিবেন মনে এই আশা রহিল।”

মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোরের ব্যবস্থায় ত্রিপুরা থেকে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষকও নিয়ে গিয়েছিলেন কবি। এই মণিপুরী নৃত্য শিক্ষকের নাম বুদ্ধিমন্ত সিংহ। তিনি একজন কারুশিল্পীও ছিলেন। বুদ্ধিমন্তের পরিচালনায় শান্তিনিকেতনে চারু ও কারুকলা শিক্ষায়ও অগ্রগতি ঘটে। মেয়েদের নৃত্য ও মণিপুরী শিল্পকর্ম শেখানোর জন্য কবি বুদ্ধিমন্তের স্ত্রীকেও শান্তিনিকেতনে চেয়েছিলেন। এই জন্য তিনি ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৯ মাঘ মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোরকে লিখেছিলেন—”…আমাদের মেয়েরাও নাচ ও মণিপুরী শিল্পকার্য্য শিখিতে উৎসুক প্রকাশ করিতেছে। মহারাজা যদি বুদ্ধিমন্তের স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবার আদেশ দেন তবে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে।…”—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content