শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) অ-প্রজনন ঋতুতে কোঁচ বক। (ডান দিকে) বাসায় ছানাসহ কোঁচ বক। ছবি: সংগৃহীত।

“বকের পাখায় আলোক লুকায় ছাড়িয়া পুবের মাঠ;
দূরে দূরে গ্রামে জ্বলে ওঠে দীপ আঁধারেতে থাকে হাট।
নিশা নামে দূরে শ্রেণীহারা এক ক্লান্ত বকের পাখে;
মদির বাতাস ছাড়ে প্রশ্বাস পার্শ্বে পাকুড়-শাখে।”


স্কুলে পড়েছিলাম যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা ‘হাট’ কবিতা। সেই কবিতায় গ্রাম্য হাটে রাত্রি নেমে আসার সময়ের অসাধারণ যে কল্পচিত্র কবি তৈরি করেছিলেন তা কিন্তু আমার মতো গ্রাম্য মানুষের কাছে একেবারেই পরিচিত বাস্তব চিত্র। প্রতিদিন পশ্চিম দিক থেকে বকের সারি আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে যখন উড়ে যেত তখন খামার বা মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশপানে সে দৃশ্য দেখা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমন দৃশ্য আজও দেখি যেদিন ওই বলাকা শ্রেণীকে দেখতে মন চায়। এই বক হল কোঁচ বক। ইংরেজিতে ‘Pond heron’। বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Ardeola grayii’। অনেকে অবশ্য এই বককে ধান পাখি বা কানা বক বলে। ক্ষেতে ধান কাটার পর সামান্য জল জমে থাকা বা কাদাযুক্ত জমিতে এবং আমন ধান চাষের জন্য লাঙল করার সময় জমিতে এই বকদের ঘুরতে দেখা যায়।
আসলে লাঙ্গল করা, ধান রোয়া বা ধান কাটার সময় জমিতে ছোট মাছ, শামুক, ব্যাঙ, ব্যাঙাচি, পোকামাকড় ইত্যাদি খাওয়ার জন্য এককভাবে বা দলবদ্ধভাবে এদের দেখা যায়। তাই ধান পাখি নাম। আবার এই বকের গায়ের রঙ এতই অদ্ভুত যে পরিবেশের সাথে চমৎকার ভাবে নিজেকে মিশিয়ে নিতে পারে। ফলে দূরে থেকে সহজে এরা নজরে পড়ে না। এই কারণে এদের খুব কাছাকাছি পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া যায়। আর টের পেলে দুটো ধবধবে সাদা ডানা মেলে একটা ঝপ ঝপ আওয়াজ তুলে ছান্দিক গতিতে ডানা সঞ্চালন করে উড়ে যায়। খুব কাছাকাছি এগিয়ে এলেও যেহেতু এরা টের পায় না এবং শেষ মুহূর্তে উড়ে যায় তাই এদের অনেকে কানা বক বলে। আসলে শিকারের জন্য এদের মনঃসংযোগ অসাধারণ। এজন্যই ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনায় মনঃসংযোগী হওয়ার জন্য বকের উপমা দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭২: সুন্দরবনের পাখি—গোলিয়াথ ‘মহাকায়’ বক

মুভি রিভিউ: জীবন-কাহিনি ‘ময়দান’ ছবি বক্স অফিসে ব্যর্থ, কেন?

সত্যি বলতে কি কোঁচ বক যে দু’রকম দেখতে হয় তা ছোটবেলায় বুঝতাম না। ভাবতাম কোঁচ বক দু’রকম রয়েছে। ভাবতাম যেগুলো খুব সুন্দর দেখতে সেগুলো স্ত্রী বক আর যেগুলো ততটা সুন্দর নয় সেগুলো পুরুষ বক। সুন্দর দেখতে মানে মাথা তামাটে-হলদে রঙের আর ঘাড় ও পিঠের রং মেরুন-বাদামি। ঘাড় থেকে তামাটে-হলদে রঙের পালক ঝালরের মতো ছড়িয়ে থাকে।

কোঁচ বক। ছবি: সংগৃহীত।

এদের কয়েকটা সাদা রঙের লম্বাটে পালক টিকিট মতো মাথার পেছনদিকে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। ঠোঁটের রঙ হলুদ, কিন্তু ঠোঁটের গোড়ার দিকের রঙ হালকা নীল, আর আগার রং কালো। পা আর পায়ের পাতার রঙ হয় সবুজ। কুচকুচে কালো চোখের বাইরে পরপর হলুদ, কালো ও সবুজ রঙের বৃত্ত কোঁচ বকের চোখকে করে তোলে মোহময়। এমন সুন্দর রূপসৌন্দর্য বলেই ভাবতাম এ বক স্ত্রী না হয়ে যায় না। কিন্তু পরে জানলাম প্রজনন ঋতুতে স্ত্রী ও পুরুষ বক উভয়ের এমন সুন্দর রূপ হয়। আর যখন প্রজনন ঋতু নয় তখন তাদের চেহারা হয় অন্যরকম।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৩: চোর-ডাকাতও যদি দান-ধ্যান করে, তবে লোকে ‘তাকে’-ও ভগবানের মতোই শ্রদ্ধা করে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত

এদের মাথার রং হয় কালচে-বাদামি আর ঘাড়ে ও কাঁধে কালচে বা বাদামি রঙের পালক এমনভাবে বিন্যস্ত থাকে যে দেখে মনে হয় যেন ডোরাকাটা। গলা ও পেটের নিচেও এমন ডোরা দেখা যায়। চোখের উপরে ও নিচে অনুরূপ ডোরা দেখা যায়। পিঠ ও ডানার ওপরের রঙ হয় হালকা বাদামি। দেহের বাকি অংশের রঙ হয় সাদা। নিচের ঠোঁটের রঙ হয় হলুদ আর উপরের ঠোঁটের রং হয় কালচে। অবশ্য ঠোঁটের আগার রঙ অপেক্ষাকৃত গাঢ় কালচে হয়। পা ও পায়ের পাতার রং হয় বিবর্ণ হলদেটে-সবুজ রঙের। কোঁচ বকের এই চেহারা অবশ্য অন্য রূপের মতো মনোমুগ্ধকর নয়। তবে উভয় রূপের বক যখন ডানা মিলে আকাশে উড়ে যায় তখন ডানার রং কিন্তু দেখায় শ্বেতশুভ্র। নীল আকাশের বুকে সে দৃশ্য একবার দেখলে চোখ ফেরানো দায়।

প্রজনন ঋতুতে কোঁচ বক। ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরবন অঞ্চলে কোঁচ বক যথেষ্ট পরিমাণে যেমন দেখা যায় তেমনই সারা ভারতের প্রায় সর্বত্র সবচেয়ে বেশি এই প্রজাতির বককেই দেখা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারেও এদের ভারতের মতো যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। কম পরিমাণে হলেও এদের ইরান, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, থাইল্যান্ড, সেসেলেস ও ইয়েমেনে দেখা যায়। ভিয়েতনামে এই বকের সংখ্যা খুব কমে গিয়েছে এবং কুয়েত থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৩: প্রফুল্লময়ী— একটি বইয়ের লেখক এবং একটি জীবন ভরা ডিপ্রেশন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

কোঁচ বক লম্বায় প্রায় হয় ৪৬ সেন্টিমিটার। দুটো ডানা মেললে বিস্তার হয় প্রায় ২১.৫ সেন্টিমিটার। ওজন হয় গড়ে ২১৫ গ্রাম। পুকুর, খাল, বিল, মাঠ, এমনকি আবর্জনার স্তুপেও কোঁচ বককে বিচরণ করতে দেখা যায়। সাধারণত এরা একা বা দু’ চারটি বকের ছোট দলে ঘুরতে দেখা যায়। বেশিরভাগ সময় অগভীর জলে এক জায়গায় স্থির হয়ে একটু কুঁজোভাবে ও মাথাটাকে ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বর্শার মতো তীক্ষ্ণ চঞ্চু দিয়ে ছোঁ মেরে শিকার ধরে নেয়। অবশ্য খুব ধীর পদক্ষেপে হেঁটে শিকার করতেও দেখা যায়। গ্রামে পুকুর সেচা হলে বা গ্রীষ্মে পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে পুকুরে কোঁচ বকদের মাছ খাওয়ার মহোৎসব বহুবার দেখেছি। যখন এরা উড়ে যায় তখন এদের দেখতে খুব সুন্দর লাগে। ধবধবে সাদা ডানা, দুদিকে মেলে ধরে আর পা দুটো টানটান হয়ে পেছনদিকে বেরিয়ে থাকে। এই সময় ওদের ঘাড় কিছুটা গোটানো থাকে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৪: শেয়াল রাজা পেল সাজা?

ছোটবেলায় দেখেছি পুকুর পাড়ে খাঁচা পেতে পাড়ার কিছু লোকজনকে বক ধরতে। আবার ঝড়ের সময় বাসা ভেঙে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া বকের ছানাও দেখেছি। বকের ছানা হোক কিংবা পরিণত বক ভয় পেলে তীক্ষ্ণ চঞ্চু সোজা চোখের দিকে তাক করে ঠোক্কর দিতে চায়। মাছ এদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। তাছাড়া চিংড়ি, ব্যাঙ, ব্যাঙাচি, কেঁচো, ফড়িং, সাপের বাচ্চা, কচ্ছপের ছোট বাচ্চা ইত্যাদি খায়। জলাশয়ের ধারে কিংবা জলাশয় থেকে দূরবর্তী জায়গাতেও বড় গাছে এরা রাত্রি বাস করে। ফলে সন্ধের সময় জলাশয় থেকে দল বেঁধে এদের আশ্রয়স্থলের দিকে উড়ে আসতে দেখা যায়। বড় গাছে পানকৌড়ি, শামুখখোল, কুরচি বক, গো বক ইত্যাদি অন্যান্য পাখির সাথে একসাথে অনেক কোঁচ বক আশ্রয় নেয়। কোঁচ বকের ডাক সাধারণত শোনা যায় না, তবে গ্রীষ্মকালে জলাশয়ের পাশে সন্দিগ্ধচিত্তে বা নিজেদের আবাসস্থলে কখনও কখনও এদের গলা ফুলিয়ে ‘ওয়ক ওয়ক’ বা হাঁ করে জিভ নেড়ে ও গলা কাঁপিয়ে ‘ককক ককক ককো কক কক’ করে ডাকতে শোনা যায়। ভয় পেয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ও একরকম কর্কশ শব্দ করে।

উড়ন্ত কোঁচ বক। ছবি: সংগৃহীত।

কোঁচ বকের প্রজননের সময় হল জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস। এই সময় স্ত্রী ও পুরুষ বক মিলে কাঠকুটো, পালক ইত্যাদি দিয়ে অগোছালো একটা বাসা বানায়। বাসার সঙ্গে পাতিকাকের বাসার বেশ মিল দেখা যায়। একই গাছে আরও অনেক পাখির বাসা থাকতে পারে। বাসা বাঁধা হলে স্ত্রী কোঁচ বক সবুজাভ-নীল রঙের ৩ থেকে ৫টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ কোঁচ বক পালা করে ডিমে তা দেয়। সাধারণত ২৪ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরিয়ে আসে। সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের গায়ের রং হয় বাদামি, আর তাদের পিঠের ওপর ফিকে হলুদ ও বাদামি রঙের তিন-চারটে বড় বড় ডোরা দাগ থাকে। আর বাচ্চাদের ডানাতেও কালচে বাদামি রঙের মোটা মোটা দাগ থাকে।

কোঁচ বক আর যাই হোক সুন্দরবনে এত বেশি পরিমাণে দেখা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে এদের কোনও বিপন্নতা আসবে বলে মনে হয় না। প্রকৃতিতে এদের তেমন কোনও খাদকও নেই। তবে সুন্দরবনে জলাভূমি ও বৃক্ষের পরিমাণ ক্রমশ কমছে এবং রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ছে—কোঁচ বকের জন্য এটাই চিন্তার। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content