রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে সেদিন আমরা এক অন্য রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পেয়েছিলাম। সেই রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজার জন্য মন্ত্রী ঠিক করে দেন,রাজ্যের বাজেট নির্ধারণ করেন,আবার রাজনীতিকের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হন। আর ত্রিপুরায় এই অন্য রবীন্দ্রনাথের আলোচনা প্রসঙ্গে যে নামটি বারবার আসবে তা হচ্ছে ব্রজেন্দ্র কিশোর দেববর্মণ, যিনি লালুকর্তা হিসেবেই সমধিক পরিচিত। মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের পুত্র হলেন তিনি। ব্রজেন্দ্র কিশোরকে কবি একদিন বলেছিলেন—’তোমার বাবা আমাকে কবিত্ব থেকে রাজনীতিতে টেনে নিয়েছিলেন…’।
ত্রিপুরার রাজপরিবারের সুখ-দুঃখের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন কবি। মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২-৯৬খ্রিঃ) থেকে তাঁর প্রপৌত্র মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য (১৯২৩-৪৭) চারজন রাজার সঙ্গেই কবির নিবিড় যোগাযোগ ছিল। এক রাজবংশের চারজন রাজার সঙ্গে কবির এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা নিঃসন্দেহে এক আশ্চর্য ঘটনা। প্রথম যোগাযোগের সময় বীরচন্দ্র প্রৌঢ়, কবি তরুণ বয়স্ক। আর শেষবেলায় বীরবিক্রম যখন যুবক রাজা তখন কবি প্রৌঢ়। বীরচন্দ্র পুত্র মহারাজ রাধাকিশোরের(১৮৯৬-১৯০৯খ্রিঃ) সঙ্গে কবির সখ্যতা ছিল বেশি। হয়তো সমবয়স্ক বলে দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কখনও কবি তাঁকে রাজ্য শাসনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন, কখনও রাজপরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব কিংবা নানা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। আবার কখনও রাজ্যের বাজেট প্রণয়ন সম্পর্কে নোট পাঠিয়েছেন রাজার কাছে।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৪: রাজকার্যে বাংলা ব্যবহারে রাজাদেশ
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ
মহারাজা রাধাকিশোরের ইংরেজ প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ স্যান্ডেস সাহেব অবৈধ ভাবে রাজকোষের অর্থ দোহন করছেন, রবীন্দ্রনাথ এমন অভিযোগ করেও সতর্ক করেছেন রাজাকে। শুধু তাই নয়, রাজকুমারদের শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারেও উদ্যোগ নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ত্রিপুরার রাজ সরকারের মন্ত্রীপদে লোক ঠিক করে দিয়েছেন কবি। আবার ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে কোচবিহারের রাজার পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছেন তিনি। একসময় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গুঞ্জনও উঠেছে প্রাসাদ পরিমন্ডলে। ব্যথিত কবি পত্র দিয়েছেন রাজাকে। রাজা এইসব কথা উড়িয়ে দিয়েছেন নিছক গুজব বলে। রাধাকিশোর পরবর্তী রাজাদের সময়ে রবীন্দ্রনাথ যেন কিছুটা অভিভাবকের ভূমিকায়। রাধাকিশোরের পর রাজা হলেন বীরেন্দ্র কিশোর (১৯০৯-২৩ খ্রিঃ)। রাজপরিবারের চিরাচরিত ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে যাতে ত্রিপুরার বিপদ ঘনিয়ে না আসে সেজন্য কবি সতর্ক করে দেন বীরেন্দ্র কিশোরের ছোট ভাই ব্রজেন্দ্র কিশোরকে। তাঁকে রাজার পাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়াতে পরামর্শ দেন তিনি।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ
মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোরকে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন—”তোমার বাবা আমাকে কবিত্ব থেকে রাজনীতিতে টেনে নিয়েছিলেন, তাই তোমাদের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করতে পারিনে।” তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভগ্ন হৃদয়’ কাব্য গ্ৰন্হের জন্য প্রথম অভিনন্দন পেয়েছিলেন মহারাজা বীরচন্দ্রের কাছ থেকে। আর প্রৌঢ় বয়সে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজপরিবার থেকে পেয়েছেন ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি। ত্রিপুরার সিংহাসনে তখন বীরচন্দ্রের প্রপৌত্র বীরবিক্রম। এই ভাবে চারজন রাজার সঙ্গে কবির সম্পর্ক ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্র সাহিত্যেও উজ্জ্বল হয়ে আছে ত্রিপুরা। ত্রিপুরার ইতিহাস অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘রাজর্ষি’, ‘বিসর্জন’, ‘মুকুট’। রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে তাঁর গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকে চরিত্র চিত্রণ-সহ পটভূমি বাছতে কেন ত্রিপুরার দিকে দৃষ্টি দিলেন সেটা এক প্রশ্ন। ধারণা করা যায় ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের কারণেই ত্রিপুরা কবিকে আকৃষ্ট করেছিল। আর সেই যোগাযোগটা গড়ে উঠেছিল বীরচন্দ্রের সময়ে।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোরকে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন—”তোমার বাবা আমাকে কবিত্ব থেকে রাজনীতিতে টেনে নিয়েছিলেন, তাই তোমাদের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করতে পারিনে।” তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভগ্ন হৃদয়’ কাব্য গ্ৰন্হের জন্য প্রথম অভিনন্দন পেয়েছিলেন মহারাজা বীরচন্দ্রের কাছ থেকে। আর প্রৌঢ় বয়সে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজপরিবার থেকে পেয়েছেন ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি। ত্রিপুরার সিংহাসনে তখন বীরচন্দ্রের প্রপৌত্র বীরবিক্রম। এই ভাবে চারজন রাজার সঙ্গে কবির সম্পর্ক ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্র সাহিত্যেও উজ্জ্বল হয়ে আছে ত্রিপুরা। ত্রিপুরার ইতিহাস অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘রাজর্ষি’, ‘বিসর্জন’, ‘মুকুট’। রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে তাঁর গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকে চরিত্র চিত্রণ-সহ পটভূমি বাছতে কেন ত্রিপুরার দিকে দৃষ্টি দিলেন সেটা এক প্রশ্ন। ধারণা করা যায় ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের কারণেই ত্রিপুরা কবিকে আকৃষ্ট করেছিল। আর সেই যোগাযোগটা গড়ে উঠেছিল বীরচন্দ্রের সময়ে।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
আসলে বীরচন্দ্রের পিতা মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য (১৮২৯-৪৯ খ্রিঃ) এক সময় গুরুতর রাজনৈতিক সংকটে পড়ে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিলেন। সেই সময়ে রাজপুরুষ ও কলকাতা সমাজে দ্বারকানাথ ঠাকুরের খুব প্রভাব ছিল। কৃষ্ণকিশোর সেই রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার পান মূলত দ্বারকানাথের সক্রিয় সহযোগিতায়। এ ভাবেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সম্পর্কের একটি ভিত্তি রচিত হয়েছিল অনেক আগেই।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।