শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

পাঞ্চালদেশে, দ্রুপদকন্যার স্বয়ংবর সভায়, বিজয়ী অর্জুন, বিজিতা দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন তাঁদের আশ্রয়, কুম্ভকারগৃহে। অনুসরণরত রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, তাঁর উদ্দেশ্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতা দ্রুপদের উদ্বেগ প্রশমন। অজ্ঞাতপরিচয় কোন যুবক দ্রৌপদীকে জয় করলেন? তাঁর পরিচয় কী? কচ্চিৎ সবর্ণপ্রবরো মনুষ্য উদ্রিক্তবর্ণোঽপ্যুত এব কচ্চিৎ কন্যার পিতার এমন দুশ্চিন্তাই হয়তো স্বাভাবিক। মেয়েকে কে নিয়ে গেল? সে কী কোন ক্ষত্রিয়প্রধান? কিংবা কোনও উদ্রিক্তবর্ণ অর্থাৎ জাতিশ্রেষ্ঠ কোনও ব্রাহ্মণ? সমপর্যায়ের কোনও বর ও ঘর পেয়েছে তো কন্যা?
পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীর সঙ্গীদের সংবাদ জেনে, পিতাকে জানালেন। ধৃষ্টদ্যুম্নঃ সোমকানাং প্রবর্হো বৃত্তং যথা যেন হৃতা চ কৃষ্ণা। সোমকবংশীয়দের প্রধান ধৃষ্টদ্যুম্ন, যথাযথ বৃত্তান্ত ও যিনি দ্রৌপদীকে হরণ করেছেন সে বিষয়ে পিতাকে জানালেন।

সেই সুদীর্ঘ লোহিতলোচন, কৃষ্ণমৃগচর্মধারী, দেবতুল্য রূপবান, বিশাল ধনুকে গুণারোপ করে লক্ষ্য বিদ্ধ করেছিলেন যিনি, ব্রাহ্মণপরিবৃত ও সমাদৃত হয়েছিলেন তিনি, দেব ও ঋষিগণ সমর্থিত অসুরদের সম্মুখীন ইন্দ্রসম একাকী প্রতিপক্ষীয়দের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেই বীর। কৃষ্ণার গ্রহণ যাঁরা মেনে নিতে পারেননি সেই ক্ষুব্ধ আক্রমণোদ্যত সমবেত রাজাদের মধ্য দিয়ে, সেই বীর যুবকের মৃগচর্ম ধারণ করে, হস্তিনীর মতো কৃষ্ণা তাঁরই অনুসরণ করেছিলেন। রাজাদের ভিড়ে, অপর এক বীর যুবক বিশাল ভগ্ন তরুশাখা নিয়ে সক্ষাৎ যমের মতো রাজাদের প্রতিহত করতে করতে সেই যুবকটিরই অনুগমন করলেন। রাজাদের উপস্থিতিতে দ্রৌপদীকে নিয়ে তাঁরা দুজনে নগরের বাইরে ভার্গব নামে কোনও এক কুম্ভকারের কর্মশালায় হাজির হলেন। সেখানে বসেছিলেন অগ্নিতুল্যা দীপ্তিময়ী এক নারী, মনে হয় তিনি এঁদের জননী। তাঁদের মতোই বীর, অগ্নিসম তেজস্বী, অপর তিন যুবাও সেখানে ছিলেন। সেই দুই বীর সেই মহিলাকে অভিবাদন করলেন। তাঁদের নির্দেশানুসারে দ্রৌপদীও তাঁর পাদুটি স্পর্শ করে অভিবাদন জানালেন। সেখানে অবস্থানরতা দ্রৌপদীর বিষয়ে মা-কে জানিয়ে, ভিক্ষা আহরণার্থে গেলেন তাঁরা।
ভিক্ষালব্ধ দ্রব্য রান্না করলেন সেই মহিলা। দ্রৌপদী সেই অন্ন প্রথমে,যথাক্রমে দেবতা ও ব্রাহ্মণদের উৎসর্গ করলেন। তারপরে সেই প্রৌঢ়া মহিলাকে ও তাঁর বীর পুত্রদের পরিবেশন করে শেষে নিজে সেই অন্ন গ্রহণ করলেন। সকলে ভূমিতলে কুশঘাসের ওপরে,মৃগচর্মের আস্তরণের শয্যায় ঘুমিয়ে পড়লেন। দ্রৌপদী হলেন তাঁদের পায়ের বালিশ। তাঁর শয্যার আশ্রয় যুবকদের চরণতল। মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠে সেই বীরগণের আলোচনার বিষয় ছিল, ক্ষত্রিয়োচিত যুদ্ধ, বৈশ্য ও শূদ্রোচিত আলাপ নয়। তাই ধৃষ্টদ্যুম্ন জানালেন,হে রাজন, এই অজ্ঞাতপরিচয় যুবকেরা নিশ্চয়ই ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ। আমাদের আশা পূর্ণ হতে চলেছে। শুনেছি, অগ্নিদাহ থেকে মুক্তি পেয়েছেন পাণ্ডবেরা। নিঃসংশয়ং ক্ষত্রিয়পুঙ্গবাস্তে যথা হি কথয়ন্তি রাজন্। সেই যুবকের বলপূর্বক ধনুকে গুণারোপ এবং লক্ষ্যভেদ, পরস্পরের কথোপকথন, ইত্যাদি এটাই প্রমাণ করে যে, এঁরাই পৃথা কুন্তীর পুত্র পঞ্চপাণ্ডব, তাঁরা গুপ্তভবে বিচরণ করছেন। ছন্না ধ্রুবং তে প্রচরন্তি পার্থাঃ। সন্তুষ্ট রাজা দ্রুপদ, পুরোহিতকে তাঁদের উদ্দেশে প্রেরণ করলেন। বললেন, জেনে আসুন, তাঁরা মহাত্মা পাণ্ডর পুত্র কিনা। বিদ্যাম যুষ্মানিতি ভাষমাণো মহাত্মানঃ পাণ্ডুসুতাঃ স্থ কচ্চিৎ। পুরোহিত রাজার আদেশ পালন করলেন।

পাণ্ডবদের গুণকীর্ত্তন করে পুরোহিত বললেন, হে বরণীয় পুরষেরা, আমাদের বরদা ভূপতি পাঞ্চালরাজ, আপনাদের পরিচয় জানতে আগ্রহী হয়েছেন। লক্ষ্যভেদকারী এনাকে দেখে, আনন্দের অন্ত নেই তাঁর। জ্ঞাতি ও কুলের আনুপূর্বিক বিবরণ বলুন। শত্রুদের মস্তকে পা রেখে, আমার এবং অনুচরসহ পাঞ্চালরাজের মনে আনন্দ দান করুন। রাজা পাণ্ডু ছিলেন দ্রুপদরাজার হরিহর আত্মা বন্ধু। দ্রুপদরাজার আন্তরিক ইচ্ছা,তাঁর কন্যা কৌরবদের পুত্রবধূ হোক। হে অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষেরা, রাজা দ্রুপদের একান্ত মনোগত অভিলাষ ছিল—পুষ্ট ও সুগঠিতবাহু, অর্জুন যেন ধর্মানুসারে, আমার কন্যাটিকে লাভ করেন। অয়ং হি কামো দ্রুপদস্য রাজ্ঞো হৃদি স্থিতো নিত্যমনিন্দিতাঙ্গাঃ। যদর্জুনো বৈ পৃথুদীর্ঘবাহুর্ধর্ম্মেণ বিন্দেত সুতাং মমৈতাম্।। সেই কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে আমার পুণ্য ও যশলাভ উভয়ই হবে। পুরোহিত তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। পাণ্ডবমুখ্য যুধিষ্ঠির, নিকটস্থ ভীমকে আদেশ দিলেন, পুরোহিতকে পাদ্য ও অর্ঘ্য দানের করা হোক। দ্রুপদরাজার পুরোহিত মাননীয়। তাই তাঁকে অধিক সম্মান প্রদর্শন করা কর্তব্য।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৪: অরাজকতার ফল ও একটি দুঃস্বপ্ন

শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৪

ভীম নির্দেশানুসারে পুরোহিতের পূজা সম্পন্ন করলেন। পূজা গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ পুরোহিত সন্তুষ্ট হলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, পাঞ্চালরাজ স্বক্ষত্রিয়োচিত ধর্মানুসারে কন্যাদান মনস্থ করেছিলেন, স্বেচ্ছানুসারে নয়। যে কন্যাপণ তিনি নির্দিষ্ট করেছিলেন, এই বীর সেই শর্ত পূরণ করেছেন।সেখানে ব্রাহ্মণাদি বর্ণের উল্লেখ ছিল না, ছিল না কোন কুল, শীল, গোত্রের বিশেষ নির্দেশ। শুধু গুণসজ্জিত ধনুকের সাহায্যে লক্ষ্যভেদ ছিল কন্যাদানের একমাত্র শর্ত। ন তত্র বর্ণেষু কৃতা বিবক্ষা ন চাপি শীলে ন কুলে ন গোত্রে। কৃতেন সজ্যেন হি কার্ম্মুকেণ বিদ্ধেন লক্ষ্যেন হি সা বিসৃষ্টা।। যুধিষ্ঠিরের মতে, সমবেত রাজাদের মধ্যে, এই মহান অর্জুন, সেই শর্তানুযায়ী কৃষ্ণাকে জয় করেছেন। তাই সোমকবংশোদ্ভূত রাজা দ্রুপদের অনুশোচনা, পাণ্ডবদের অসন্তোষ সৃষ্টির কারণ পারে না। দ্রুপদরাজার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। হে ব্রাহ্মণ,এই রাজকন্যাও এই বিজয়ীর অবশ্যপ্রাপ্য বলেই আমার মনে হয়। কামশ্চ যোঽসৌ দ্রুপদস্য রাজ্ঞঃ স চাপি সম্পৎস্যতি পার্থিবস্য। সম্প্রাপ্যরূপাং হি নরেন্দ্রকন্যামিমামহং ব্রাহ্মণ!সাধু মন্যে।। যুধিষ্ঠির কারণ হিসেবে বললেন, হীনবল মানুষ সেই ধনুকে গুণারোপ করতে সক্ষম হন না। অমন লক্ষ্যভেদ, শস্ত্রজ্ঞানহীনের কাজ নয়। তাই কন্যার জন্যে অনুতাপ অন্তত, পাঞ্চালরাজের শোভা পায় না। পৃথিবীতে কোন মানুষ লক্ষ্য বিদ্ধ করে, উৎপাটিত করতে পারেন না। যুধিষ্ঠির যখন এই সব বলছেন, তখন কেউ সিদ্ধমন্নম্ অন্ন প্রস্তুত হয়েছে, এই মর্মে দ্রুপদরাজার বার্তা নিবেদন করল।
আরও পড়ুন:

বসুন্ধরা এবং…, ৩য় খণ্ড, পর্ব-৩৯: বিজয়া দশমী

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

শুভার্থীদের ভোজ প্রস্তুত। ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণদের কাছে তাঁর অনুরোধ, তদাপ্নুবধ্বং কৃতসর্ব্বকার্য্যাঃ কৃষ্ণাঞ্চ তত্রৈব চিরং ন কার্য্যম্।। আবশ্যিক কাজগুলি সম্পন্ন করে সেই সব ভোজ্য এবং সঙ্গে কৃষ্ণাকে গ্রহণ করুন।আর বিলম্ব সঠিক নয়। স্বর্ণকমলখোদিত যথোপযুক্ত অশ্বযুক্ত রাজোচিত বিচিত্র রথে আরোহণ করে পাঞ্চাল রাজভবনে আগমন করা কর্তব্য।
দূত,পাঞ্চালরাজের আহ্বানবার্তা জানালেন।

কুরুপ্রধান পাণ্ডবরা,পুরোহিতকে আগে প্রেরণ করলেন। তারপরে সেই রাজকীয় যানে আরোহণ করলেন তাঁরা।অন্য বাহনে দেবী কুন্তী ও দ্রৌপদী সহযাত্রী হলেন। পুরোহিত ধর্মরাজের বক্তব্য আগেই জানিয়েছিলেন। দ্রুপদরাজ, সে সব কথা শুনে, কুরুশ্রেষ্ঠদের অজ্ঞাত স্বরূপ উদ্ঘাটন করবার লক্ষ্যে অনেক দ্রব্যোপহার সাজিয়ে দিলেন। যেমন যথাক্রমে সাজান ছিল,ফল ও মালা। তারপরে একসঙ্গে রাখলেন বর্ম, চর্ম, আসন অর্থাৎ বাহন। এর পরে গবাদি পশু, রজ্জু, বীজ প্রভৃতি কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলিও রাখলেন। রাজা উপহার দিলেন,শিল্পে ব্যবহৃত যা কিছু যন্ত্রোউপকরণ, খেলাধুলার সামগ্রীও। ক্ষত্রিয়দের হাতিয়ার, বর্ম, চর্ম, শাণিত দীপ্তিময় খড়্গ,বিশাল অশ্ব, বিচিত্র রথ,ধনুক এবং উত্তম বাণসমূহ, কাঞ্চন আচ্ছাদিত শক্তি ও ঋষ্টি অস্ত্র ইত্যাদি উপহার, সম্মুখে রাখলেন। প্রাস, ভুষুণ্ডী, পরশু প্রভৃতি যুদ্ধোপকরণ, শয্যা, আসন, বিবিধ বস্ত্রসম্ভারও স্থান পেল সেখানে। মাতা কুন্তী, দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে রাজার অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। সেখানে মহিলারা সোৎসাহে তাঁদের সম্মান প্রদর্শন করলেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক

ব্রাহ্মণবেশধারী পাণ্ডবদের চলার গতিতে, সিংহতুল্য পদক্ষেপে শৌর্যের প্রকাশ, মহিষের তুল্য বিশাল নয়ন, মৃগচর্মের উত্তরীয়ের আবরণের মধ্যে দৃশ্যমান সুগঠিত কাঁধ। দীর্ঘ মহাসর্পতুল্য প্রলম্বিত বাহুবিশিষ্ট সেই পুরুষশ্রেষ্ঠদের দেখে, রাজা, অমাত্যবৃন্দ, পুত্ররা, রাজার শুভাকাঙ্খীরা এবং দাস, সকলেই, সব বিষয়েই ভীষণ আনন্দ অনুভব করলেন। সেই নরশ্রেষ্ঠ বীর পাণ্ডবরা নিজেদের মহামূল্যবান আসনগ্রহণবিষয়ে সংশয়হীনভাবে, এতটুকু আশ্চর্য না হয়ে, সেখানে প্রবেশ করলেন।

পরিশীলিত বেশধারী দাস, দাসী ও পাচকবৃন্দ সোনা ও রূপার পাত্রে বিবিধ রাজকীয় ভোজ্য পরিবেশন করল। পাণ্ডবরা, সেই সব ভোজ্য নিজেদের ইচ্ছানুসারে ভোজন করে সন্তুষ্ট হলেন। তাঁরা, অন্য সব কিছু ধনসামগ্রী বর্জন করে, যুদ্ধোপকরণযুক্ত গৃহে প্রবেশ করলেন। সে দৃশ্য লক্ষ্য করে,সপুত্র দ্রুপদরাজ, উপস্থিত সব প্রধান মন্ত্রীরা আনন্দিত মনে তাঁদের কাছে গেলেন এবং এই মর্মে অনুমান করলেন যে এনারা কুন্তীপুত্র এবং রাজপুত্র।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩২: কল্যাণ মাণিক্যের সনদে বাংলা গদ্য

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

দ্রৌপদীর পিতা দ্রুপদরাজ, কন্যার স্বয়ংবরসভায় শর্তসাপেক্ষ প্রতিযোগিতায়, বিজয়ী অজ্ঞাতপরিচয় পাত্রটির ব্যক্তিপরিচয় ও বংশবৃত্তান্ত বিষয়ে উদ্বেগ বোধ করেছেন। স্বয়ংবরসভায় সমবেত প্রতিযোগীদের বংশপরিচয় ও বর্ণোল্লেখ বিষয়ে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। কর্ণ হয়তো যোগ্যতার মাপকাঠি অতিক্রম করতে সক্ষম হতেন কিন্তু বাদ সাধলেন স্বয়ং দ্রুপদকন্যা। তিনি বললেন, নাহং বরয়ামি সূতম্। আমি সূতকে বরণ করব না। পাত্রীর ভাই শর্ত রেখেছিলেন,প্রতিযোগীকে হতে হবে উচ্চ বংশীয়, প্রিয়দর্শন,অনন্য শৌর্যশালী। দুরূহ লক্ষ্যভেদ করলেন একজন দীন দরিদ্র ব্রাহ্মণ, যাঁর বংশপরিচয় অজ্ঞাত। জাতপাতের বিচারে তথাকথিত উচ্চবর্ণের আধিপত্য হয়তো এমনটাই ছিল। ভরতবংশীয়দের সেই উচ্চবর্ণের আধিপত্যের অহমিকা আর নেই, আছে বর্ণনির্বিশেষে ক্ষমতার দম্ভ। ব্রাহ্মণের দীনতা সত্ত্বেও প্রকৃত sporting spirit কে রাজা দ্রুপদ স্বাগত জানিয়েছেন। রাজা কিন্তু ভাবি জামাতার বংশপরিচয় সম্বন্ধে সংশয়াতুর মনে, পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে, চরবৃত্তিতে নিযুক্ত করেছেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা আজও সুযোগ্যা কন্যার ভাবি স্বামীর বর্ণবিষয়ে ঔৎসুক্য প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে উচ্চ বর্ণের জামাতা প্রত্যাশিত প্রাধান্য পায় আজও।

ব্রাহ্মণবেশী পাণ্ডবরা ও তাঁদের জননী, তাঁদের আকৃতিগত সৌন্দর্যে ও শৌর্যে ধৃষ্টদ্যুম্নকে মুগ্ধ করেছেন। পাণ্ডবদের যুদ্ধবিষয়ক আলাপচারিতায় তাঁরা তাঁদের ক্ষত্রিয়োচিত চারিত্রিক ঐতিহ্য প্রমাণ করেছেন। ক্ষত্রিয়োচিত অনন্য কৃতিত্ববলে প্রতিযোগিতার শর্ত পূরণ করেও বংশপরিচয়ের নিরিখে তাঁদের প্রতিভার মূল্যায়নের পরীক্ষা নিতে উদ্যোগী হয়েছেন রাজা দ্রুপদ। ধার্মিক যুধিষ্ঠির যে যুক্তির অবতারণা করেছেন, একটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সেই যুক্তি সর্বদাই গ্রাহ্য।যে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সফল প্রতিযোগীর, নিজেকে প্রমাণ করে, পুরস্কার জিতে নেওয়াতেই, কৃতিত্ব। তাই পুরস্কারদাতার বিজয়ীর অন্যান্য যোগ্যতা বিষয়ে আশঙ্কা অমূলক।

দ্রুপদরাজ গোয়েন্দার মতোই পাণ্ডবদের পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্যে যে অভিনব ব্যবস্থা নিয়েছেন সেটি বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। পাণ্ডবদের আকৃতি ছিল মনোমুগ্ধকর। পাণ্ডবরা দরিদ্র কিন্তু তাঁদের আসনগ্রহণের ভঙ্গী ছিল আভিজাত্যপূর্ণ, যেন এই আসন তাঁদের জন্যেই নির্দিষ্ট। অগণিত রাজাদের প্রয়াসকে তুচ্ছ করে সাফল্য এই আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল হয়তো বা দীর্ঘদিনের অভিজাত পরিমণ্ডলে অবস্থানের দরুণ মাথা উঁচু করে পথচলার অভ্যাস, সাবলীল আভিজাত্যের গরিমা তাঁদের আচরণে প্রকট হয়েছিল।

ছবি: প্রতীকী।

পাণ্ডবরা ব্রাহ্মণদের পৌরোহিত্য ও দেবারাধনার উপকরণ ফল,মালা ইত্যাদি পছন্দ করেননি। বৈশ্যের জীবিকা, কৃষিকার্যের উপযোগী গোরু,রজ্জু,বীজ এগুলিও তাঁদের মনে ধরেনি। তাঁরা বেছে নিয়েছেন যুদ্ধোপকরণ, যেগুলি শুধু ক্ষত্রিয়দের একান্তভাবে কাম্য। মানুষের ব্যবহারে প্রকাশিত, চারিত্রিক অভ্যাস,যা তাঁর বংশপরিচয়ের মাপকাঠি সেটি কী যোগ্যতার মানদণ্ড?না তাঁর নিজেকে প্রমাণ করে, লব্ধ সাফল্য তাঁর নিজের যোগ্যতার পরিচয়?

দ্রুপদরাজার আয়োজিত যোগ্যতা মান নির্ণয়ের পরীক্ষায়, পাণ্ডবদের আচরণে প্রকাশিত পরম্পরাগত ক্ষত্রিয়োচিত কৌলিন্যবোধই বিজয়ী হয়েছে। অর্জুনের কৃতিত্ব পাণ্ডবদের সামগ্রিক বংশপরিচয়ের উজ্জ্বল উদ্ধারের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিলেও আচরণগত গরিমা তাঁদের দ্রুপদরাজের সমমর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণত্বকে নিষ্প্রভ করে ক্ষত্রিয়ের আচরণের মাহাত্ম্য শৌর্যদীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

কোনটি ব্যক্তিপরিচয়? নিজস্ব কৃতিত্ব? না বংশমর্যাদার ঐতিহ্য? প্রশ্নটির উত্তর পাঠকরা জানেন। কারণ, তাঁরা যে আধুনিক স্বনির্ভর ভরতবংশীয়দের নবীন প্রজন্ম।
—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content