শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

সভ্যতার রথচক্র ঘুরছে পৃথিবীর গভীরতম অসুখের কালে। সভ্যতার গড়ে ওঠার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রক্তাক্ত বিপন্নতা, ক্লেদ আর হিংসার সমান্তরাল এক পরিসর। জীবের অস্তিত্বের, অভিযোজনের অনুকূলে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যে স্বাভাবিক পরিণতিতে ঘটে যোগ্যতমের উদ্বর্তন তা-ও হিংসার পরিণাম। সভ্যতার ভিত্তিগাত্রের প্রতিটি উপাদানে সংঘাত, সংগ্রাম আর হিংসার স্পর্শ। সভ্যতা যখন বিবৃদ্ধ হয়, পুঞ্জীভূত জ্ঞান, শক্তি আর অহংবোধে পুষ্ট হয়, তখন তার রাজপথের আলোকমালা, উন্মাদনার বহ্নিতরঙ্গের অন্তরালে বহমান থাকে হিংসার ধারাস্রোত। তখন তা জিঘাংসা আর প্রতিহিংসার আদিম রূপ নিয়ে সভ্যতার অনিবার্য পরিণাম হয়ে উদগ্র হয়।
যখন সভ্যতার উন্মেষ ঘটেনি, তখন জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আদিম হিংসার উষ্ণ শ্বাস, আহার্যের অন্বেষণ করতে গিয়ে শিকারি শত্রুর দারুণ আঘাতে নিমেষে ঢলে পড়ত মরণের কোলে। হিংসার শিকার হয়ে। এই হিংসা ন্যায় অথবা অন্যায়, ধর্ম অথবা অধর্ম কীনা তার উত্তর মানুষের জীবনেতিহাসে, জীবধর্মের আদর্শে, সভ্যতার শর্ত ও দর্শনে, বোধে ও বিপন্নতায়।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৬: আমার দুঃখদিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— সুখদর্শন ও হুড়ো

ওই যে বিপুল অক্ষৌহিনী সৈন্যভার, ছলনার কপট মায়াজাল, সত্যরক্ষায় তত্পর যোদ্ধৃবর্গ, ধর্মসংকট আর সদাজাগ্রত মহাকা। সকলেই আজ এই ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে তাদের সকল শক্তি, সত্য ও হীনতা, জিঘাংসা ও প্রতিহিংসা নিয়ে সমাগত, প্রবৃত্ত হতে চলেছে এক মহাসংগ্রামে। তুমি কি মনে করো এই সংগ্রাম ও তার পরিণাম অভূতপূর্ব? তুমি কি মনে করো যে কর্মে সময় আজ তোমাকে প্রবৃত্ত করেছে তা নিতান্তই অপরিণামদর্শী এক অবিমৃষ্যকারিতার পরিণাম?
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৬: আহা শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী কারে রেখে কারে ফেলি

জীবের উদ্বর্তন যে হিংসার পথে, জগতে তার প্রতিষ্ঠা যে হিংসার পথে, সেই হিংসা, রিপুর দুর্নিবার আকর্ষণ, কপট কদাচার জীবের শোণিতপ্রবাহের অন্তরালে বিপুল বেগে ধাবমান। সভ্যতার আবরণ সেই ফল্গুধারাকে অদৃশ্য ও অগম্য রাখে মাত্র, এই সংগ্রামের মহাভূমি জীবত্ব থেকে মনুষ্যত্বে উত্তরণের মহামঞ্চ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭০: জন্মান্তরের সুরসাধক আরডি বর্মন

জীবনব্যাপী অনন্ত মহাসংগ্রাম। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, বাহ্য ও অন্তরিন্দ্রিয়ের চির অবিরত দ্বন্দ্বে পরিকীর্ণ এই নশ্বর দেহে স্বার্থ, অহমের বন্ধন আর পিঞ্জরাবদ্ধ অন্তরাত্মার হাহাকার… হিংসার আবিল ক্লেদ, সভ্যতার পঙ্কিল আবর্তের ঊর্ধ্বে এক অসীম সম্ভাবনা, মুক্তি, বৃহতের মহাসম্মিলনের জয়গান সুরে সুরে তালে তালে বাজতে থাকে ওই ভেরিঘোষের মতোই।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

নিজেকে জানতে হবে। দ্যূতক্রীড়ার সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়ে না? কে সেদিন ধর্মরাজকে বিনষ্টির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল? ইন্দ্রিয়ের অমোঘ আকর্ষণই তো একটি জাতিকে সভা থেকে যুদ্ধের প্রাঙ্গণে সমাগত করেছে ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য? যে ক্রোধের অনির্বাণ অগ্নিশিখা হৃদয়ে জ্বলছে, তা বিবেচনা, ধর্ম, সত্য, ন্যায় ও বুদ্ধিবিবর্জিত হলে আশু বিনষ্টির দিকেই দ্রুত ধাবিত করবে। ক্রোধ পরিণত হবে মোহে, সেই মোহনামক ভ্রম ক্রমশ স্মৃতিবিভ্রম ঘটিয়ে উন্মার্গগামী করবে, বুদ্ধি ধ্বস্ত হবে। আর এর একটাই পরিণাম, মৃত্যু। নিজেকে না জানলে এই কুরুক্ষেত্রের সংগ্রামে, ওই জীবনের সংগ্রামে ধ্বংসের দিকেই ধাবিত হবে। যদি মোহাবিষ্ট হয়ে এই মহাসংগ্রামকে উপেক্ষা করো, তাহলেও সেই নিশ্চিত পরাভব, গ্লানি, তমঃ আর ধ্বংসকে অতিক্রম করতে পারবে না। তমেব বিদিত্বা অতিমৃত্যুমেতি, নান্যঃ পন্থাঃ বিদ্যতে অয়নায়।
* গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে (A Special Write Up on Shrimad Bhagwat Gita): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content