শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) পঞ্চরতি লতা ফল ও বীজ। (মাঝখানে) পঞ্চরতি লতার ফুল সিঙ্গরা গাছের শাখা। (ডান দিকে) পঞ্চরতি লতা। ছবি: সংগৃহীত।

 

দুধি লতা (Finlaysonia obovata)

নদী ও খালের ধারে ঝোপে ঝাড়ে কিংবা কোনও বড় গাছের গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে দেখেছি বহুবর্ষজীবী ও চিরহরিৎ লতানে উদ্ভিদ দুধিলতাকে। এ কিন্তু প্রকৃত ম্যানগ্রোভ নয়। এ হল ম্যানগ্রোভ-সহযোগী উদ্ভিদ। এর পাতা বা শাখা ভাঙলে সাদা দুধের মতো আঠা অর্থাৎ তরুক্ষীর নিঃসৃত হয় বলে মনে হয় এর নাম দুধিলতা। লতানে হলেও এর কান্ড বেশ শক্ত।

বাকলের রং বেগুনি তবে কাগজের মতো পাতলা বাকল। ডিম্বাকার পাতাগুলো দেখলে মনে হবে যেন দই খাওয়ার কাঠের চামচ। পাতাগুলো বেশ মোটা ও রসালো। গাছ থেকে নিচের দিকে ঝুলন্ত শাখায় পাতাগুলোও নিচের দিকে মাথা করে ঝুলে থাকে। দুধিলতার ফুল জন্মায় পাতার কক্ষ থেকে। ফুলের পাঁচটা পাপড়ি থাকে, আর সাদা রঙের পাপড়িগুলোর মাঝে থাকে বেগুনি রঙের ছিটে। ফলে ফুলগুলো দেখতে খুব সুন্দর হয়। আর ফুলের পাপড়ির গায়ে থাকে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রোম।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

দুধি লতা ফল হয় ডিম্বাকার আর দু’’প্রান্ত খুব চাপা। ফলের গায়ে যেন লম্বালম্বি অনেক উঁচু নিচু ডোরা দাগ থাকে। ফল পাকলে ফেটে যায়। ফলের মধ্যে অনেক বীজ থাকে। দুটো ফল একটা বৃন্ত থেকে জন্মায়, ফলে পরিণত ফল দুটিকে দেখতে শিং-এর মতো দেখায়। সুন্দরবনের নদী, খাঁড়ি, খাল ইত্যাদির দু’পাশে ও জঙ্গলের মেঝেতে দুধি লতা প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। কখনও কখনও এই লতা ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবনের মানুষ এই লতানে গাছটিকে কোনও লৌকিক চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করত কিনা আজ আর জানা যায় না। তবে এর গুনাগুন বিচার করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেছে কফ, কাশি, হাঁপানি, ঠান্ডা লাগা বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রুখতে পারে দুধিলতা। এই লতার পাতা বা বাকলের নির্যাস রোগীকে খাওয়ালে উপকার হয়। তাই মনে হয়, হয়তো এক সময় এইসব রোগের নিরাময়ে প্রাচীন সুন্দরবনের মানুষ এই লতাটিকে ব্যবহার করত।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৭: ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও?

 

পঞ্চরতি লতা (Pentatropis capensis)

সুন্দরবন অঞ্চলে পঞ্চরতি লতা নামটা আমার কাছে তেমন পরিচিত নয়। গাছটা ছোট থেকে দেখেছি ঝোপে ঝাড়ে কিন্তু নাম কখনও শুনিনি। সাধারণ লোকে লতা গাছই বলত। পরে জেনেছি এর নাম পঞ্চরতি। সম্ভবত বাংলাদেশ অঞ্চলে এই নামটি বেশি প্রচলিত। তবে ভারতীয় সুন্দরবন অংশে হয়তো অন্য কোনও নাম থাকতে পারে যা আমার জানা নেই। সে যাই হোক, লতানে এই গাছটি বহুবর্ষজীবী চিরহরিৎ উদ্ভিদ। এই লতানে গাছের এক থেকে সাড়ে তিন সেন্টিমিটার লম্বা পাতাগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত। পাতাগুলো অত্যন্ত রসালো ও মোটা। বৃন্তের দিকে পাতার ফলক অনেকটা চওড়া আর আগার দিকে ক্রমশ সরু হয়ে সূচালো হয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

পাতার বৃন্ত চার থেকে সাত মিলিমিটার লম্বা এবং বাঁকা। পাতার কিনারা ধরে হালকা লাল রংয়ের দাগ বা ছিটে মাঝে মাঝে দেখা যায়। পাতার কক্ষ থেকে পাঁচ-ছ’টি ফুল থোকা হয়ে ফোটে। ফুলগুলির বৃন্ত বেশ লম্বা – ১.২ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। ফুলের রং বেগুনি। পাপড়ি গুলো গোড়ার দিকে জুড়ে থাকলেও আগার দিকে মুক্ত। ফুলের পাপড়ি ও বৃন্তের সংযোগস্থল অনেকটা মোটা হয়। জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ফুল ফোটে। তিন থেকে চার সেন্টিমিটার লম্বা ফলগুলো সরু ও লম্বাটে হয়। ফলের আগার দিকটা হয় সূচালো। পেকে গেলে ফল ফেটে যায়। ফলের মধ্যে বাতাসে ভেসে যাওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন অনেকগুলি বীজ থাকে। পঞ্চরতি লতার লবণ সহন ক্ষমতা বেশি নয়, তাই যে অঞ্চলে জোয়ার ভাটা কম খেলে সেখানেই এদের বসবাস।

(বাঁদিকে) দুধি লতার ফল। (মাঝখানে) দুধি লতা। (ডান দিকে) দুধি লতার ফুল। ছবি: সংগৃহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

প্রাচীনকাল থেকে ভারতে এই উদ্ভিদটি চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। আয়ুর্বেদ, ইউনানী ও সিদ্ধা চিকিৎসা পদ্ধতিতে পঞ্চরতি লতার ব্যবহার রয়েছে। এই গাছের পাতার রস নাকের মধ্যে ফোঁটা আকারে ফেলা হয় সর্দি, মাথার যন্ত্রণা, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি দূর করতে। সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ প্রাচীনকালে এই গাছের পাতা জলে সামান্য ফুটিয়ে পাতার নির্যাস সেই জলে মিশিয়ে নাকে ফেলার ফোঁটা ওষুধ তৈরি করত। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ত্বকের রোগ নিরাময়ে পঞ্চরতি লতা পাতার নির্যাস খুব ভালো কাজ দেয়। কোথাও কোথাও এই গাছের মূল লৌকিক চিকিৎসার অঙ্গ হিসেবে জ্বর, হাইড্রোসিল ও বাতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত। তবে এখন সে সব অতীত। —চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content