বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


সংজ্ঞা দেবী।

সরস্বতীর লীলাকমল নিয়ে যে মেয়েরা পৃথিবীতে আসেন, তাঁদের সকলের হয়তো ছাপার হরফে বই থাকে না। কাজেই অন্দরমহলের লুকানো খাতায় যদি শক্তিশালী হরফ খুঁজে পাওয়া যায়, তাকে আমরা ‘Spontaneous overflow of powerful feelings’ বলতেই পারি। এমনই এক মহিলার কথা বলি আজ। সংজ্ঞাদেবী, সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীর ছেলের বৌ।

১৩১০ সালের আষাঢ় মাসে ঠাকুরবাড়িতে বেজে উঠল বহু প্রতীক্ষিত সানাই। সত্যেন্দ্রনাথ এবং জ্ঞানদানন্দিনীর আদরের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলের বিয়ে। সুরেন্দ্র সম্পর্কে গভীর আসক্তি ছিল জ্ঞানদানন্দিনীর। ছেলেকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না, তাই ছেলেকে দূরে বিলেতে যেতেও দেননি। ছেলের বিয়ে নিয়েও জ্ঞানদানন্দিনীর অনেক পরিকল্পনা ছিল। খুব সুন্দরী পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে হোক—এই ইচ্ছে ছিল জ্ঞানদানন্দিনীর। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ বিয়ে সম্পর্কে বেশ উদাসীন ছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনী যখনই কোনও সুন্দরী মেয়ের সন্ধান পেতেন, নিজের কাছে এনে রাখতেন। কিন্তু সুরেনের তরফ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে অনেক খেলনা দিয়ে সেই মেয়েকে বিদায় জানাতেন।
কুচবিহার রাজবাড়ির মহারানি সুনীতির মেয়ে সুকৃতির সঙ্গেও সুরেনের বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অসবর্ণ বিবাহ পছন্দ ছিল না। কাজেই সুকৃতির বিয়ে হল স্বর্ণকুমারী দেবীর ছেলে জ্যোৎস্নানাথের সঙ্গে। অবশ্য বাড়ির সকলের অমতে এই বিয়ে হয়েছিল। সুরেন্দ্রনাথের বিয়ে অবশ্য হয়েছিল। প্রিয়নাথ শাস্ত্রীর মেয়ে সংজ্ঞাকে সকলের পছন্দ হয়। জ্ঞানদানন্দিনীর কথায় সুরেন্দ্রনাথ বিয়ে করেন। তাই প্রথমে সুরেন্দ্রনাথ বউয়ের মুখ দেখেননি। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে বড় সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হল সংজ্ঞা আর সুরেনের। দু’জনের বয়সের ফারাক ছিল প্রায় উনিশ বছরের। কিন্তু বেশ সহজ সুন্দর দাম্পত্য ছিল তাঁদের। সংজ্ঞাদেবী স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, ‘মনে আছে হয়তো বয়স কম বলেই ওঁকে ভীষণ ভয় পেতাম। কিন্তু কী আশ্চর্য —কত মমতার সঙ্গে কৌশলে দূর থেকে ভালোবেসে ছ’ মাসের মধ্যে আমার মনের সব ভয় দূর করে দিলেন। এমন-কি পরে ওঁর উপর কর্তৃত্ব করতেও খুব একটা দ্বিধা করতাম না।’
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩১: হেমন্তবালা দেবী— রবি ঠাকুরের পত্রমিতা

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

অল্পবয়সী সংজ্ঞাকে লেখাপড়া শেখাতে লরেটো থেকে বিদেশি শিক্ষয়িত্রী। সুরেন্দ্রনাথ নিজেও পড়াতেন সংজ্ঞাকে। সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজি বই খুলে একটুও না থেমে গল্প বলে যেতেন বাংলায়। একবার শিলাইদহে জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি ইংরেজি ভাষায় একটি গল্প পড়েছিলেন। সংজ্ঞাকে সেই গল্পের হুবহু বাংলা অনুবাদ করে লিখে পাঠিয়েছিলেন। পরে এই গল্পই পরে বই আকারে প্রকাশিত হয় ‘একটি বসন্ত প্রাতের প্রস্ফুটিত সকুরা পুষ্প’ নামে। বইটি উৎসর্গ করেছিলেন সংজ্ঞা দেবীকেই। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল—‘যার মনোরঞ্জনার্থে বই লেখা হল, তাকেই দিলাম।’

সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে সিস্টার নিবেদিতার বাড়ি গিয়েছিলেন সংজ্ঞা। সেখানে নিবেদিতার করা আদর যত্নের কথা মনে রয়ে গিয়েছিল সংজ্ঞার। কাকুজো ওকাকুরাকেও মনে ছিল। সুরেন্দ্রনাথের বিলেত যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনী ছেলেকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না বলে তাঁকে চোখের আড়াল করেননি। সেই অভিমানে সুরেন্দ্রনাথ ঠিক করেছিলেন বিয়ে করবেন না। তাই তিনি অবশেষে যখন বিয়েতে মত দিয়েছিলেন, তখনও বউ দেখতে রাজি হননি। বউভাতের দিন পার্সি থিয়েটার দেখার পর সংজ্ঞাকে সুরেন্দ্রনাথ প্রথম ডেকে কথা বলেছিলেন, ‘থিয়েটার কেমন লাগল?’ এই প্রথম নান্দনিক কথাটির পর তাঁরা দিব্যি জীবন নাট্যে অভিনয় করে গেলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

সংজ্ঞা ভালো অভিনয় করতেন। সাহিত্য শিল্প সবকিছুতেই পারদর্শিতা ছিল আর ছিল জাগতিক পৃথিবী সম্পর্কে এক আশ্চর্য নিরাসক্তি কাজ করত। জ্ঞানদানন্দিনীর ভালো লাগত না। সংজ্ঞার সাজগোজেও মন নেই, ঘর গেরস্থালির কাজে মন নেই ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়ে বৌদের মতো। আসলে মনে মনে সংজ্ঞা ছিলেন আধ্যাত্মিক। সংসার তাঁকে কোনোদিন টানেনি। তবে সংসার ধর্ম পালন করেছেন তিনি। সুশ্রী, বিদ্বান, নির্মল চরিত্রের স্বামী,ছয়টি সন্তান,বিরাট পরিবার, অর্থ, বৈভব সব ছিল। কিন্তু কোনো এক বোধ কাজ করত সংজ্ঞার । অন্তরে এক শূন্যতাবোধ তাঁকে অস্থির করে রাখত। তিনি লিখেছিলেন, ‘সেবিকার কৈফিয়ত’। তাঁর ধর্মজীবনের কথা সেখানে লেখা। কেমন করে ডায়মন্ডহারবারে হাওয়া বদল করতে গিয়ে জলের ঢেউ দেখে দিব্য অনুভূতি হল সংজ্ঞার সেকথাও জানা যায় তাঁর স্মৃতিকথা থেকে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

সংজ্ঞা দেবী মধ্যবয়সে এসে উপলব্ধি করলেন তাঁর জীবনের লক্ষ্য ভগবৎ লাভ। অথচ সংজ্ঞার মনে তখনও ব্রাহ্ম সংস্কার প্রবল। তবু হিন্দু গুরুর কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর মন ভরে গেল পূর্ণতায়। পড়লেন ‘সাধন অমর’ বইটি। মন ব্যাকুল হল ভগবত প্রেমে। ততদিনে তিনি বুঝে গিয়েছেন সংসারের বাঁধন তাঁর জন্য নয়। সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সংজ্ঞা সংসারের সব বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়েন। হরিদ্বারে আনন্দময়ী মায়ের কৃপায় সন্ন্যাস পেলেন। ঠাকুরবাড়ির বউটি স্বরূপানন্দ পর্বত নামে বেরিয়ে পড়লেন পথে। কাশীতেই দেখা হল অসীমানন্দ সরস্বতীর সঙ্গে। তাঁর কাছে সংজ্ঞা পেয়েছিলেন শেষ শান্তি, শেষ দীক্ষা।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

সংজ্ঞার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কল্যাণী দত্তের। নিম্বার্ক আশ্রমে এক গোয়ালঘরের পাশে সাধুমা বসে নির্বাক মুখে। কল্যাণী দত্ত তখনই তাঁর ভক্ত হয়ে গেলেন। কল্যাণী দত্তের অনুরোধেই সাধুমা তাঁর পূর্বাশ্রমের কথা আর আত্মকথার খাতা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। সংজ্ঞা শুধু নিজেদের সন্তানদের মা হয়ে থাকতে চাননি। সকলের মা হতে চেয়েছিলেন। সেই অনুভূতি ধরা আছে তাঁর কবিতায়। গল্পের মতো হলেও সংজ্ঞার জীবন সত্যি—
‘নারীর দেহে এ ভবেতে হে
লভিয়া জনম আজিকে আমি।
মাতৃত্ব যে কি তাহা তো জেনেছি,
এ দেহ সার্থক হয়েছে স্বামী।
রেখো না মোরে ক্ষুদ্র মা করে
ধরণীতে করো গো পরিচিত,
সবারি যে মা হব গো হেথা
সে রূপে হয় পূর্ণ বিকশিত।
কল্যাণকামী মঙ্গলকামী
মাতৃরূপিণী আমায় হেরি
ধরার অন্যা পুত্র ও কন্যা
চারিপাশে মোর দাঁড়াক ঘেরি।’


আধ্যাত্মবাদ সাহিত্যের একটি ধরণ। সংজ্ঞাদেবীর লেখা সেই আধ্যাত্মিক ছাঁচের। তাঁর জীবনচর্যা এবং লেখা কিন্তু তাঁর নিজের মতো করে বিপ্লব। ঠাকুরবাড়ির অপৌত্তলিক আবহ থেকে দূরে গিয়ে নিজের নতুন এক অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্ব নির্মাণ সেই সময় সহজ কথা ছিল না। সংজ্ঞাদেবী ঠিক পেরেছিলেন। তাঁকে প্রণাম জানাই।

ঋণ
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
স্মৃতিকথায় জোড়াসাঁকো, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (সম্পা)
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content