শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


শিলচরে উনিশে মে এবং ভাষা শহিদদের নিয়ে মিছিল।

মাতৃভাষা অর্থাৎ মায়ের মুখের ভাষা। যে ভাষা আমৃত্যু আমাদের সঙ্গে থাকে। মাতৃভাষা মা কিংবা দেশ থেকে কোনও অংশে কম নয়। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার, বিদ্যাচর্চা করার অধিকার প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার। যখন সেই অধিকারের উপর কুচক্রীরা করাঘাত করার চেষ্টা করে তখনই হয় প্রতিবাদ। জোরাল প্রতিবাদ। তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের একুশ আমাদের উনিশ। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিবাদ হয়েছে। অসমের শিলচর, ঢাকা, এমনকী আফ্রিকার সচেতন মানুষরা নিজেদের মাতৃভাষাকে সম্মান জানিয়ে ভাষা মাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।

ভারতের বুকে যেমন রয়েছে বিবিধ ভাষার লোকজন, তেমনি সেই সব ভাষাকে উপনিবেশিকতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যও করতে হয়েছে অনেক লড়াই। স্বাধীনতার পর প্রাদেশিকতা এবং মাতৃভাষার জন্য লড়াই দেশের বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে। কর্নাটক সরকার কন্নড় ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করায় সংখ্যা লঘু মরাঠিরা তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। দেশভাগের পর এই প্রাদেশিকতার শিকার হয়েছে অসমও, যার ফল উনিশে মে।
আসলে অসমের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে এই আন্দোলনের বীজ লুকিয়ে আছে। বর্তমান অসমের ভৌগোলিক পরিসর ছিল অন্য রকম। আজকের অসমের বরাক উপত্যকার অনেকাংশ এক সময় অসমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ১৮৭৪ সালে বাংলাদেশের শ্রীহট জেলাকে অসমের অন্তর্ভুক্ত করে অসমকে একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ও এই সুরমা উপত্যকা অর্থাৎ বর্তমান বরাক উপত্যকা এবং পূর্ববঙ্গের আরও কিছু অংশ অসমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৯১২-এ বঙ্গভঙ্গ রত হলেও সুরমা উপত্যকা অসমের সঙ্গে জুড়ে যায়। রাজনৈতিক এই টানাপড়েনে সুরমা উপত্যকার মানুষের ভাগ্যও জুড়ে গেল।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতায় সুরমা উপত্যকার অঙ্গ আবার কাটা পড়ল। বর্তমান বরাক উপত্যকা থেকে গেল অসমে আর নিজের দেশের বাকি অংশ গেল বিদেশ হয়ে। স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচনের আগে অসমের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (তখন মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধান মন্ত্রী বলা হত) গোপীনাথ বড়দলৈ এক ছাত্র সম্মেলনে বলেছিলেন, “it is not the intention of the government to make Assam a bi-lingual state for the homogeneity of province, the Non-Assamese should adopt the Assamese languages…..Assam is for Assamese.”।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার পর্ব ২৫: অসমের বাঙালি ও দেশভাগ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

লোকপ্রিয় গোপীনাথ বড়দলৈ দেশভাগ হতে না হতে এমন মন্তব্য করায় এটা স্পষ্ট হয়েই গিয়েছিল যে বঙ্গভাষীকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। বরাক নদী বিধৌত কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি নিয়ে বর্তমান অসমের বরাক উপত্যকায় স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলা ভাষাই সব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ইংরেজদের আগে এ অঞ্চল ছিল ডিমাসা রাজাদের শাসনাধীন। আর রাজভাষা ছিল বাংলা। ডিমাসা রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র বর্মণ এবং কাছাড়ের শেষ রাজা গোবিন্দচন্দ্র বর্মণও বাংলা বিদ্যা চর্চা করতেন। ইংরেজ শাসনকালেও এ অঞ্চলের সরকারি ভাষা ছিল বাংলা। তাই অসমীয়া ভাষাকে বরাকবাসীর উপর জোর করে আরোপিত করার চেষ্টাও দীর্ঘদিনের।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

১৯৪৭সালে যখন দেশ একদিকে স্বাধীনতার মুকুট ধারণ করেছে, আর অন্যদিকে দেশমাতা অঙ্গছেদের যন্ত্রণা-সহ করছিল সেই সময় অসমের প্রথম বিধানসভা অধিবেশনে চলছে ষড়যন্ত্র। তৎকালীন রাজ্যপাল আকবর হায়দারি বলেন, “The Bangalee has no longer the power even he had the will to impose any thing on the people of these hills and valleys which constitute Assam. The basis of such feeling against him as exists in fear but there is now no cause of fear.”

সাংসদ নীলমণি ফুকনের ভাষা আরও স্পষ্ট, “All the languages of different communities and their culture will be adopted in Assamese culture . State cannot nourish another language in the province.” (Assam Assembly proceedings 1948, p- 585)।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

খুব ছোটবেলায় ব্যাকরণের বইয়ে আমরা পড়েছিলাম মনের ভাব কথিত বা লিখিত উপায়ে প্রকাশ করার মাধ্যমকে ভাষা বলি। কিন্তু ভাষার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা এত সহজ নয়। কারণ ভাষা আমাদের অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ব্যাকরণের বাইরে ভাষাকে আমরা ভাষা মাতৃকা বলি। কোনও ভাষার বিকাশ মানে এই জাতির সংস্কৃতির সাধরণ বিকাশ। ভাষা আমাদের পরিচায়ক। তাই ভাষার উপরই আধিপত্যবাদ করার চেষ্টা করা হল। দেশভাগের ফলে যারা অসমে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন কিংবা যারা বহুকাল আগের থেকেই অসমের বাঙালি বাসিন্দা তাদের ‘বাঙাল খেদা’র নামে কী অকথ্য অত্যাচার করতে হয়েছে তার সাক্ষী ইতিহাস। ইতিহাসের এ সত্যতা এড়ানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। বাংলা স্কুলের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকল। সমগ্র অসমের অবস্থা তখন খুব একটা ভালো ছিল না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

১৯৫৪ সালে বিধানসভায় একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের সরকারি হিসেবে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। ফলে অনসমিয়াভাষীদের মধ্যে অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশকে রাজ্যকে সুন্দর করে গড়ে নেওয়ার মূল্যবান সময়টা চলে গেল প্রাদেশিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে। ১৯৬০ সালে তৎকালীন অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা অসম বিধানসভায় বলেছিলেন, অসমে একাধিক ভাষাভাষীর লোক বসবাস করায় অসমীয়া ভাষাকে তখনই সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা যাবে, যখন অসমীয়ারাও অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করবে। মুখ্যমন্ত্রী এও বলেন, সরকার মনে করে বিষয়টি সংখ্যালঘুর দিক দিয়ে নয়, গ্রহণযোগ্যতার দিক দিয়ে বিচার করতে হবে।

মুখ্যমন্ত্রী গন্তান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে এই কথা বললেও উগ্র জাতীয়তাবাদী কুচক্রীরা এই কথার বিপরীত অর্থ বের করে নিল। তারা অসমীয়াদের উপর বল প্রয়োগ করতে লাগল অসমীয়া ভাষাকে মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু মেনে নিতে হবে বললেই কি আর মেনে নেওয়া যায়? ন্যায্য পাওনার উপর যদি প্রশ্ন চিহ্ন বসে, তখনই সহ্যের বাঁধ ভেঙে হয় তীব্র প্রতিবাদ। কোনও জাতির মাতৃভাষার উপর হস্তক্ষেপ করা মানে সেই জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। তার সাহিত্য সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করে দেবার চেষ্টা করা। তাই সেই চেষ্টাকে বিনষ্ট করতে এগিয়ে আসে জাগ্রত জনতা, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকেরা। আর তারপর একদিন সমস্ত “কাঁটার মুকুট মাথায় নিয়ে” ভাষা মা হাসি মুখে সন্তানদের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ায়।—চলবে।
ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content