বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


বিজু নৃত্য। ছবি: সংগৃহীত।

কৃষি ভিত্তিক ভারতের প্রায় সমস্ত উৎসব মূলত কৃষি অর্থাৎ ফসল উৎপাদনকে ঘিরে আবর্তিত হয়। উত্তর পূর্বাঞ্চলের উৎসব অনুষ্ঠানও এই ধারার ব্যতিক্রম নয়। ত্রিপুরার অন্যতম উৎসব গরিয়া, গাজন, বিজু —যাই হোক না কেন, শষ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল একদিন। সুখ ও সমৃদ্ধির কামনা, নতুন ফসলের জন্য প্রার্থনা যেন সমস্ত উৎসবেরই মূল সুর।

চৈত্র-বৈশাখের সন্ধিক্ষণে ত্রিপুরার জনজাতিদের প্রধান লোক উৎসব গরিয়া অনুষ্ঠিত হয়। গরিয়া হলেন সুখ ও সমৃদ্ধির দেবতা। জনজাতিদের বিশ্বাস গরিয়া দেবতা তুষ্ট হলে সম্পদ, সন্তান ও শান্তি সুনিশ্চিত হবে। গোলা ভরা ফসল হবে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন আবাহন হয় গরিয়ার। এক সপ্তাহ পর উৎসবের সমাপ্তি ঘটে বৈশাখে। এই সাতদিন পাহাড়ের পাড়ায় পাড়ায় চলে নৃত্যগীত। দল বেধে যুবক যুবতীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য গীতের মাধ্যমে দেবতাকে তুষ্ট করে। জমাতিয়া, ত্রিপুরী, রিয়াং, নোয়াতিয়া—ত্রিপুরার বিভিন্ন জনজাতি সম্প্রদায় এই উৎসবে সামিল হয়ে থাকে।
ত্রিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্য ‘ওচাই’র নির্দেশে গরিয়া পুজো সম্পন্ন হয়। একটি বংশদণ্ডকে গরিয়া দেবতার প্রতীক হিসেবে পুজো করা হয়। কাঁচামূলী বাঁশের শীর্ষে ঝুলানো হয় ফুলের মালা, কাঁচুলি। দেবতার মাথার আকৃতি তৈরি করা হয় বাঁশের মাথায় উদাল গাছের টুকরা বেঁধে। বাঁশের কঞ্চি বাঁশের গায়ে বেধে দেবতার বাহু তৈরি করা হয়। কঞ্চির গায়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয় দড়ি বা পাট। জমাতিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসবটি উদযাপনের অন্যতম অঙ্গ হল গরিয়া দেবতাকে নিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ।

পুজোর উপকরণের মধ্যে রয়েছে ফুল, মালা, তুলা, সূতা, ধান, চাল, মাটির পাত্র, ডিম, কবুতর, মোরগ, হাঁস, মদ ইত্যাদি। চিরাচরিত প্রথা অনুসারে গরিয়া দেবতাকে তুষ্ট করতে হাঁস, মোরগ বলি দেওয়া হয় এবং তার রক্ত দেবতার সামনে ছিটিয়ে দেয়া হয়। পুজো চলাকালীন সময়ে কেউই গরিয়া দেবতার ছায়া অতিক্রম করতে পারবে না। দেবতা রুষ্ট হবেন তা হলে। এক সময় ত্রিপুরার ফসল উৎপাদন ছিল মুখ্যত জুম (Shifting Cultivation) নির্ভর। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শুরু হয় জুমের প্রস্তুতি। জঙ্গলের জরাজীর্ণ লতাগুল্ম পোড়ানোর পর বৃষ্টির প্রতীক্ষা।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৬: ত্রিপুরার উন্নয়নে বীরচন্দ্র বহুমুখী কর্মসূচি রূপায়ণ করেছিলেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

জনজাতিদের কাছে এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জুম পোড়ানো, বীজ বপন সারতে হবে সময় মতো। চাই পর্যাপ্ত বর্ষণও। তা হলেই জুমে জুমে হবে সুজন্মা, ফসলে ফসলে ছেয়ে যাবে পাহাড়। সে-জন্যই ফসলের প্রাচুর্যের জন্য চাই কৃষি দেবতার তুষ্টি সাধন। এ ভাবেই এসেছে গরিয়া পুজো। গরিয়াতে আরাধ্য দেবতা হলেন গরিয়া ও কালিয়া। এই দুই দেবতাকে গণেশ ও কার্তিক রূপে ভাবা হয়ে থাকে। গণেশ হলেন সিদ্ধিদাতা অর্থাৎ সমৃদ্ধির দেবতা। কার্তিক হলেন অশুভ শক্তি সংহারক। গরিয়া পুজোর কামনা হল অশুভ শক্তির বিনাশ, সুখ ও সমৃদ্ধির আশা।

সাম্প্রতিককালে গরিয়া পুজো ত্রিপুরার এক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে শহরাঞ্চলের অজনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষও গরিয়া পুজো ও উৎসবে সামিল হচ্ছেন। পাহাড়ি এলাকার পাশাপাশি শহরেও বারোয়ারী গরিয়া পুজোর প্রচলন হয়েছে। উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেন শহরবাসীরা। সব সম্প্রদায়ের মানুষ অংশ নেন উৎসবে। পুজো উপলক্ষে সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন হয়ে থাকে। গরিয়া পুজোকে কেন্দ্র করে গরিয়া নৃত্যেরও প্রচলন হয়েছে। গান ও নাচের তালে তালে প্রতিফলিত হয় জুম উৎপাদনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া। মেয়েদের থাকে চিরাচরিত পোশাক রিসা ও পাছড়া। ত্রিপুরার জনজাতি নৃত্যের মধ্যে গরিয়া নৃত্য আজ এক বিশেষ স্থান নিয়ে আছে।

গাজন। ছবি: সংগৃহীত।

গাজন উৎসবেও ফুটে উঠে বর্ষশেষে নতুনের আবাহনের সুর। প্রকৃতি নির্ভর জীবনে অতি প্রাকৃত নানা বিশ্বাস মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত আছে। এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে নানা ধর্ম ভিত্তিক লোকপার্বণ। বাংলার অন্যতম লৌকিক উৎসব হচ্ছে গাজন। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। উৎসবের কেন্দ্রীয় দেবতা হলেন শিব। ত্রিপুরা এবং বরাক উপত্যকার বাঙালিদেরও অন্যতম উৎসব গাজন। গাজনের মূল বিষয় হচ্ছে সূর্য ও পৃথিবীর মিলন যাতে পৃথিবী শস্য উৎপাদন করতে পারে। শৈব ধর্ম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শিব সর্বোচ্চ দেবতার আসন লাভ করেন এবং সূর্যোৎসবে শিব ও গৌরী সূর্য ও পৃথিবীর প্রতীক দেবদেবী রূপে পরিণত হন। নৃত্যের মাধ্যমে এই উৎসব উদযাপিত হয়। নৃত্যে ত্রিশূল ও ডমরু হাতে থাকেন শিব, সঙ্গে থাকেন গৌরী। উৎসব উদযাপনের জন্য মাসব্যাপী কৃচ্ছসাধন করতে হয় ভক্তদের। গাজনের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য করে অর্থ ও চাল সংগ্রহ করে উৎসবের জন্য।
https://www.youtube.com/shorts/WdhiqaB6F40
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৮: যুগান্তরেও রামচন্দ্র, পুরুষোত্তমরূপে প্রসিদ্ধ কেন?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা

গাজন উৎসবের বহিরঙ্গের সঙ্গে যেন জনজাতিদের গরিয়ারও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। চৈত্রের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় চড়ক মেলা। মেলার দিনে গাজনের দল যেমন নৃত্য করে, তেমনই গাজনের সন্ন্যাসীরা মাস ব্যাপী কৃচ্ছ সাধনের পর পিঠে বড়শি গেঁথে চড়ক গাছে ঝুলে নানা রকম শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে। তার আগে অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পুজো। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে চড়ক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দূর দূরান্তের দোকানীরা মেলায় হাজির হন। গাজন ও চড়ক মেলা হলো বর্ষশেষে গ্রাম ত্রিপুরার বড় পার্বণ। পুরনো যা কিছু জরাজীর্ণ তাকে ধুয়ে মুছে নতুনের আবাহন যেমন বর্ষশেষের নানা উৎসবের তাৎপর্য তেমনই বলা যায় গরিয়া এবং গাজনও এই ধারার ব্যতিক্রম নয়। গরিয়া এবং গাজনের মূল সুরও কিন্তু অভিন্ন। দুটি উৎসবেই নতুন বছরে নতুন ফসলের প্রার্থনা। সুখ ও সমৃদ্ধির কামনা।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬১: মধ্যদিনের রক্তনয়ন

ত্রিপুরার চাকমা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয়—সামাজিক উৎসব হচ্ছে বিজু। তিনদিন ব্যাপী এই উৎসব শুরু হয় বাংলা বছরের শেষ দিনের আগের দিন। প্রথম দিনটিকে বলা হয় ফুল বিজু। এ দিনটিতে ঘরের আসবাব, কাপড়চোপড়, বাসনপত্র ইত্যাদি পরিষ্কার করা হয়। উৎসবের উদ্দেশ্যে খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। সন্ধ্যায় বুদ্ধ মন্দিরে প্রার্থনা করা হয়। মন্দির, ঘরবাড়ি আলোকমালায় সাজানো হয়। পরদিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনে হল মূল বিজু। সকালে নদীতে স্নানের মাধ্যমে এই পবিত্র দিনটির সূচনা হয়। যুবক যুবতীরা চিরাচরিত নতুন পোশাক পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে এবং প্রতি বাড়িতে সুস্বাদু খাদ্য সামগ্রী গ্রহণ করবে। ঐতিহ্যমন্ডিত খেলাধূলায় কিশোর তরুণ সম্প্রদায় অংশ নেবে।

গড়িয়া নৃত্য। ছবি: সংগৃহীত।

সন্ধেবেলায় রয়েছে বিজু নৃত্যের আসর। প্রবীণরা সারা দিন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকবেন। শেষ দিনটিকে বলা হয় ‘গজ্জে পজ্জে বিজু’। এই দিনটিও নানা রকম ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অতিবাহিত হবে। বিজু উৎসবকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে বিজু নৃত্য। চাকমা সম্প্রদায়ের এই নৃত্যটি বর্তমানে ত্রিপুরার অন্যতম উপজাতি নৃত্য। ছেলে মেয়েরা ঐতিহ্যমন্ডিত পোশাকে এই নৃত্যে অংশ নেয়। ঢোল, বাঁশি, বাঁশ নির্মিত বাদ্যযন্ত্র ঢুডুক, হেংগারাঙ এই নৃত্যে ব্যবহৃত হয়। বিজু নৃত্যে অসমের বিহু নৃত্যের একটা প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এই ভাবেই কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই যেন আবর্তিত হচ্ছে নানা লোকপার্বণ। নানা অঞ্চলে নানা নামে, নানা রঙ্গে। কিন্তু সব উৎসবের মূল সুর অভিন্ন।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content