শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


গণিতবিদ নিখিলরঞ্জন সেন। সংগৃহীত।

একই আকাশে অসংখ্য সূর্য থাকতে পারে না ঠিকই, কিন্তু প্রফুল্ল রায় ও জগদীশ বসুর সময়কালে প্রেসিডেন্সি কলেজে এমন একাধিক জ্ঞান সূর্যের আবির্ভাব ঘটেছিল। এই তরুণ তুর্কিরা হলেন মেঘনাথ সাহা, সত্যেন বসু, জ্ঞান ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, পুলিনবিহারী সরকার ও নিখিলরঞ্জন সেন।
প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ নিখিলরঞ্জন সেন জন্মগ্রহণ করেন অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলায়, ১৮৯৪ সাল। পিতা কালিমোহন সেন ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের একজন স্বনামধন্য অ্যাডভোকেট। বিদ্যালয় ঢাকা কলেজিয়েট ইংলিশ হাই স্কুল। এই স্কুলেই তিনি ক্লাসমেট হিসেবে পেলেন পরবর্তীকালের বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে, সেখানে পুরানো বন্ধু মেঘনাদ ছাড়াও আরও এক নতুন বন্ধুকে পেলেন, নাম তাঁর সত্যেন্দ্রনাথ বোস। ওই কলেজে গণিতের অধ্যাপক রাজমোহন সেন ছিলেন নিখিলরঞ্জনের সম্পর্কে কাকা। কাকার হাত ধরেই তাঁর গণিতের প্রতি ভালোবাসা গড়ে ওঠে।
আরও পড়ুন:

স্পার্ম ব্যাংক বনাম অনাথাশ্রম

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৬: সুখের লাগিয়া

ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে নিখিলরঞ্জন চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে, বিষয় ছিল মিশ্রগণিত, যা পরবর্তীকালে ‘ফলিত গণিত’ নামেই সমধিক পরিচিত হয়। এই বিষয়টিতে তিনি অনার্স নিলেন। এখানেও বন্ধু হিসাবে পেলেন মেঘনাদ ও সত্যেন বোসকে। ১৯১৩ সালে তিনজনই গণিতে অনার্স পরীক্ষা দিলেন। প্রথম হলেন সত্যেন বোস। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হলেন যথাক্রমে মেঘনাদ সাহা ও নিখিল সেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একবছর পর, ১৯১৬ সালে এমএসসি পরীক্ষায় বসলেন তিনি, এ বার প্রথমস্থান অর্জন করলেন। ১৯১৭ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে রাজা বাজার সায়েন্স কলেজে ফলিত গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন তিনি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪০: মা সারদার নিজবাটি

গবেষক হিসেবে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। উদস্থিতিবিদ্যা ও নিউটনীয় বিভব নিয়ে তাঁর গবেষণাগুলি দেশ ও বিদেশের বিখ্যাত সব গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯২১ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয় ডিএসসি। উচ্চতর গবেষণার জন্য তিনি গেলেন জার্মান-ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের বিখ্যাত গবেষণাগারগুলিতে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ভন লাউ-এর কাছে গবেষণা করেন এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট হয়েছিলেন তিনি। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ও ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের ন্যা য় বিজ্ঞান প্রতিভার সঙ্গে তাঁর নিত্য যোগ ছিল। কলকাতায় ফিরে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে তিনি ফলিত গনিতের ‘রাসবিহারী ঘোষ অধ্যাপক’ পদে আসীন হলেন। এরপর অধ্যাপনায় আত্মনিয়োগ করেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা

নিখিলরঞ্জনের সময়ে সায়েন্স কলেজে কোয়ান্টামতত্ত্ব, উদস্থিতিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা চলত। সেই যুগে তিনি আপন প্রচেষ্টায় তৈরি করেন কম্পিউটার গবেষণাগার ও উদস্থিতিবিদ্যার ল্যা বও। তিনি জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও কলকাতার ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির আজীবন সদস্য ও সভাপতি ছিলেন। বাল্যবন্ধু সত্যেন বোস প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ এর তিনি একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোডিনামিক্স ল্যাব ‘নিখিলরঞ্জন সেন ল্যা ব’ নামেই সমধিক পরিচিত।

আজীবন কর্মী, সৎ, রসিক ও আনন্দোচ্ছল মানুষটি ১৯৬৬ সালের ১৩ জানুয়ারি ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে, পরলোক গমন করেন। এই বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে যেন আমরা কোনওদিনও ভুলে না যাই।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content