সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


 

উইকেন্ড এসকর্ট (অন্তিম পর্ব)

এই ফোনটা নেওয়া হয়েছিল সংযুক্তা দেব এই নামে। তার মানে মিতুল দে নামটা ভুয়ো। বাড়ি হালতু পোস্ট অফিসের কাছে। সংযুক্তার বাবা হলেন সেই মানুষটি, নিরঞ্জন দেব। যিনি গোলপার্কের কাছে গড়িয়াহাট রোডের ওপর গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। এতটা জানবার পর বাবুর ভীষণ ইচ্ছে হল সংযুক্তাকে দেখবার। দেখা করার জন্য হালতু যাবার দরকার পড়েনি। হোয়াটসঅ্যাপে ছবি দেখেই ডাঃ কর গুপ্ত জানিয়েছিলেন, “এইচএমবিএস” এই হলোগ্রাফিক স্টিকার স্টেথোস্কোপের ব্র্যান্ড। বহু পুরনো বাঙালি প্রতিষ্ঠান ‘এইচ মুখার্জি অ্যান্ড ব্যানার্জি সার্জিক্যাল প্রাইভেট লিমিটেড’। এইচএমবিএস ব্র্যান্ড। ৩৯/১ কলেজ স্ট্রিট কলকাতা ৭০০০৭৩। ১৯০৫-এর মেডিকেল ইকুইপমেন্ট তৈরির প্রতিষ্ঠান। মাঝারি দামের টেকশই ডাবল টিউব স্টেথোস্কোপ তৈরি করেন।

কলেজ স্ট্রিটে মেডিকেল কলেজের কাছেই সবুজ রঙের সাইনবোর্ডে সোনালি অক্ষরে লেখা ‘এইচ মুখার্জি অ্যান্ড ব্যানার্জি সার্জিক্যাল প্রাইভেট লিমিটেড’। সেখানে গিয়ে স্টিকারটা পরীক্ষা করিয়েও এসেছে ধৃতিমান। হালতু পোস্ট অফিসের কাছে—নিরঞ্জন দেবের পাড়ায় খোঁজ নিয়ে সেখান থেকে মেডিকেল কলেজে গিয়ে সংযুক্তাকে বের করতে অসুবিধে হয়নি। দেখা করেছে তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী সংযুক্তার সঙ্গে। জানিয়েছে, ধৃতিমান তার সঙ্গে কথা বলতে চায় কারণ কথা বলাটা খুব জরুরি। ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে ধৃতিমান। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে পৌঁছেছে কফিহাউসে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২০: আসল নাম মিতুল হলে ওই ফোন নম্বরটা কার?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫৬: তোমার আছে তো হাতখানি

ধৃতিমান জানিয়েছে, সংযুক্তার বাবা নিরঞ্জন দেবের মৃত্যুটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটা সে জানে। এই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য সে এসেছে।
—কথা বলে লাভ কী? যিনি সেদিন গাড়ি চালিয়েছিলেন আর যিনি তাকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাদের দু’ জনের শাস্তি তো স্বয়ং ঈশ্বর দিয়েছেন।
—আমি সেই ঈশ্বরকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। সেই ঈশ্বরই আপনাকে কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
কফি হাউসের তুমুল তর্কাতর্কি, কবিতাপাঠ, হাসি, হুল্লোড়ের মধ্যে সংযুক্তা বড় বড় চোখে ধৃতিমানের দিকে তাকিয়ে ছিল।
—অনেক কষ্ট করে বাবা আমাকে ডাক্তারি পড়াচ্ছিলেন। জয়েন্ট ক্র্যাক করে যে আমি মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাবো সেটা আমি বা-বাবা কেউই ভাবিনি। কিন্তু পেলাম যখন, তখন বাবা দাঁতে দাঁত দিয়ে লড়াই করতে রাজি হল। এই স্টেথোটা বাবার কিনে দেওয়া। বাবা যে নার্সিংহোমে কাজ করতেন, তার ডাক্তারবাবুরা অনেকে টাকাপয়সা দিয়ে আমার পড়ার বই কিনে দিয়েছেন। তাঁরা নানাভাবে সাহায্য করেছেন। আমার বাবার স্বপ্ন ছিল এত বছর ধরে নার্সিংহোমে ডাক্তারবাবুদের পিছনে পিছনে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে। তাঁর মেয়ে ডাক্তার হয়ে তাঁকে গর্বিত করবে। বাবার স্বপ্নের শেষটা আর দেখে যেতে পারলেন না। আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে স্বপ্নটা শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে না।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৫: রবি ঠাকুরের বড় মেয়ে— যিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন!

এই দেশ এই মাটি: ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য

—তোমার ভুল মনে হচ্ছে। এই প্রথম আমি কোনও কেসের কিনারা করতে পেরেও তার কোনও প্রমাণের অস্তিত্ব রাখিনি। যে স্টিকারের সূত্র ধরে এখানে পৌঁছেছি বা যে মোবাইল নম্বরের হদিশ করতে করতে সংযুক্তা দেবের খোঁজ পেয়েছি তার কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। তিনি বা তোমার সেই ঈশ্বর যিনি বাবার অবর্তমানে আজ অবধি তোমার পড়াশুনা তোমাদের সংসারের ভরণপোষণের সব দায়িত্ব নিয়েছেন, নিখিল সেনের মৃত্যুর সঙ্গে তাঁরও কোন যোগসূত্র বা যোগাযোগ যাতে না থাকে আমি সে ব্যবস্থা করব।
—আপনি কি শ্রুতি ম্যাডামের?
—হ্যাঁ, তোমার বাবার ওই নার্সিংহোম থেকে ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, কেউ একজন এখন তোমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন। শ্রুতি ম্যাডামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করে তোমার ব্যাংক একাউন্টের টাকা পাঠানোর ট্রেস পেয়েছি। শ্রুতি ম্যাডামের কথা রাখতেই তুমি এই ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়েছিলে সেটা আন্দাজ করতে পারি। এমন ভাবে পুরো ঘটনাটাকে সাজানো হয়েছিল যাতে নিখিল সেনের রাত্রিযাপনের সব প্রমাণ থাকে। খাবার জলের মধ্যে অ্যালকোহলের মধ্যে খুব অল্প ডোজের সিডেটিভ বা ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। কিন্তু সেটা ওখানে থাকা মদের গ্লাসে বা জলের গ্লাসে ছিল না। কারণ, পরে মদ বা জল পাল্টে দেওয়া হয়। যার ফলে নিখিল সেনকে ডেইরিফাইলিন ডেকাড্রন ইনজেকশন দেওয়াটা খুব অসুবিধে হয়নি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাতে না থাকে সে ব্যবস্থা ছিল। সেদিন ওই রিসর্টে শ্রুতি সেন নিজেই ছিলেন। যেটা রিসেপশনের লোকটির সঙ্গে কথা বলার সময় সে একবার বলে ফেলেছিল। নিখিল চোখটা আই মাস্ক দিয়ে ঢেকে কনডমের মধ্যে নিখিল সেনের সীমেন রেখে দেওয়ার কাজটা সম্ভবত শ্রুতি ম্যাডাম করেছিলেন। তোমার যাতে কোন শারীরিক লাঞ্ছনা না হয় সেটা নিশ্চিত করতেই তিনি নিজে গিয়েছিলেন। তার গাড়িতেই তোমরা মাঝরাতে ফিরে এসেছিলে। এমনকি আমার সঙ্গে কথোপকথন রেকর্ড করার কারণ একটাই, যাতে আমি কোনওভাবে তোমার কাছে পৌঁছে গেলে আমার সঙ্গে ওঁর ঠিক কী কী কথা হয়েছে সেটা যাতে তুমি সেটা জানতে পারো।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৮: পুরীতে ‘নির্জন সৈকতে’র শুটিংয়ে একসঙ্গে চার চারটি শাড়ি পরে হাজির হয়েছিলেন ছায়া দেবী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

—এত কিছু যখন জেনে গিয়েছেন তাহলে অ্যারেস্ট করুন।
—আমি চাই তোমার বাবা যেখানেই থাকুন তিনি যেন তোমার স্বপ্নপূরণের আনন্দটা উপলব্ধি করেন। যে লোকটা একটার পর একটা অপরাধীকে আইনের চোরাপথে খালাস করে দিয়েছে, নিজের খুশিমতো বেপরোয়া জীবনযাপন করেছে, সেই লোকটা তো নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেছিল। তাকে শয়তানের শাস্তি দিলেন যাঁরা তাদের স্বয়ং ঈশ্বর সাহায্য করেছেন।
—আপনিও তো অপরাধীদের সাহায্য করছেন, আপনিও দোষী।
—নিশ্চয়ই দোষী। তবে আমরা আজ কফিহাউসের ফিশ ফ্রাই আর কফি খেয়ে দোষের খন্ডন করব। কারণ সৎ উদ্দেশ্যে করা দোষ, দোষ নয়। কলিযুগে বজ্জাতকে হারানোটা জরুরি। এ যুগে সামাজিক দুষ্কৃতীদের শাস্তি দেওয়াটাই পরম পুণ্য।
—আসুন ম্যাডাম।
সংযুক্তা চমকে দেখল কফি হাউসের দরজা দিয়ে ভিতরে আসছেন শ্রুতি সেন।—চলবে।
 

আগামী বৃহস্পতিবার ২১ মার্চ ২০২৪ নতুন রহস্যগল্প ‘সিন্নি’

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content