শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচ, দানবগুরু শুক্রাচার্যের কাছে সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ করে ইন্দ্রভবনে উপস্থিত হলেন। দেবতারা মহানন্দে, কচের কাছে সঞ্জীবনীবিদ্যা শিক্ষা করলেন। তাঁদের লক্ষ্য দানবনিধন। সঞ্জীবনীবিদ্যার প্রয়োগের সময় এ বার। প্রয়োজন দ্বন্দ্বের আবহ। এই বিরোধ সৃষ্টি করতে ওস্তাদ দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি কুবেরের উদ্যানতুল্য উদ্যানে জলকেলিরতা একদল কন্যাকে দেখতে পেলেন। ইন্দ্র বায়ুরূপ ধারণ করে সেই কন্যাদের বস্ত্রগুলি মিশিয়ে দিলেন এমনভাবে যে কোনটা কার? সেটা বোঝার উপায় নেই। কন্যাদের দলে ছিলেন অসুররাজকন্যা শর্মিষ্ঠা এবং দানবগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী। ভ্রমবশত শর্মিষ্ঠা সেই মিশ্রিত কাপড়ের স্তূপ থেকে দেবযানীর বস্ত্র পরিধান করলেন। দুই কন্যার মধ্যে প্রবল বিবাদ উপস্থিত হল। দেবযানী দানবগুরুর কন্যা, তিনি শর্মিষ্ঠার গুরুতুল্যা। দেবযানীর বক্তব্য—শর্মিষ্ঠার সৌজন্যবোধটুকু নেই? তিনি শিষ্যা হয়ে একাজ করলেন কীভাবে? মোটেই ভাল হবে না শর্মিষ্ঠার। সমুদাচারহীনতয়া ন তে সাধু ভবিষ্যতি।

শর্মিষ্ঠা ঔদ্ধত্যসহকারে জানালেন, দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্য, শর্মিষ্ঠার পিতা দানবরাজ বৃষপর্বার দিবারাত্র স্তুতি করেন। শর্মিষ্ঠার পিতার প্রদত্ত দান গ্রহণ করেন। দাতা হলেন শর্মিষ্ঠার পিতা। তিনি রাজা। কখনও দান গ্রহণ করেন না। তাই দেবযানী প্রকৃত অর্থে ভিখারিণী। তাঁর ক্রোধে কি আসে যায়। নিরস্ত্র ও দরিদ্র দেবযানী এই সসস্ত্র রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার কোনও ক্ষতি করতে পারবেন না। সুতরাং দেবযানীর ক্ষোভ নিষ্ফল। তাই শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে গ্রাহ্য করেন না। ন হি ত্বাং গণয়াম্যহম্। দেবযানী হার মানলেন না। তিনি বস্ত্রোদ্ধারের জন্যে বলপ্রয়োগ করলেন। শর্মিষ্ঠার শারীরিক সামর্থ্য হয়তো তুলনায় বেশি। তিনি দেবযানীকে একটি কুয়োয় ফেলে দিয়ে, তাঁকে মৃত মনে করে, পাপনিশ্চয়া হয়ে অর্থাৎ নিজের কৃত বধরূপ পাপকর্ম সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে, স্বভবনে ফিরে গেলেন।

মৃগয়ারত রাজা যযাতি তাঁর পিপাসার্ত ঘোড়াটির জন্য জলের খোঁজে উপস্থিত হলেন সেই কুয়োটির কাছে। কুয়োর ভেতরের দিকে তাকিয়েই একজন উজ্জ্বলাকৃতি দেবোপমা কন্যাকে দেখতে পেলেন। সেই গুল্মলতায় ঢাকা কুয়োর ভিতরে পতিত কে এই নারী? রাজা তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন। দেবযানী আত্মপরিচয় জানালেন। সঞ্জীবনীবিদ্যাবলে বলী, দানবদের মৃত্যু হতে জীবনদান করেন যিনি, সেই শুক্রাচার্যের কন্যা তিনি। রাজা যযাতি দেবযানীকে কুয়ো থেকে হাত ধরে টেনে তুললেন। খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন পিতা শুক্রাচার্য। প্রিয় কন্যাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মানুষ নিজের দোষগুণের কর্মফলের দরুণ যথাক্রমে দুঃখ ও সুখ ভোগ করে থাকে। দেবযানী নিজের কৃত কোনও দোষের ফল ভোগ করেছেন নিশ্চয়ই। প্রকারান্তরে দেবযানীকৃত দোষের প্রায়শ্চিত্ত করিয়েছেন দানবরাজকন্যা শর্মিষ্ঠা।
দেবযানী, শর্মিষ্ঠাকৃত রূঢ় অবমাননার কথা জানালেন। জানালেন, শুধু তাই নয়, শর্মিষ্ঠা তাঁকে কুয়োয় ফেলে দিয়ে প্রস্থান করেছেন। শুক্রাচার্য কন্যাকে আশ্বস্ত করলেন। দেবযানী স্তাবক, যাচক ও দানগ্রহণকারীর কন্যা নন। অস্তোতুঃ স্তূয়মানস্য দুহিতা দেবযান্যসি। তিনি স্তাবকের কন্যা নন, বরং সকলের স্তুতি করে যাঁর, তাঁর কন্যা দেবযানী। শুক্রাচার্যের অদ্বিতীয় ব্রহ্মশক্তির কথা, শর্মিষ্ঠার পিতা দানবরাজ বৃষাকপি, দেবরাজ ইন্দ্র, নরপতি যযাতি সকলেই অবগত আছেন। যে বিদ্যাবলে মৃত জীব জীবন ফিরে পায় সেই সঞ্জীবনী বিদ্যা একমাত্র শুক্রাচার্যের অধিগত। গুণীব্যক্তিরা আত্মপ্রশংসা করে অনুশোচনাবোধে ব্যথিত হন। কথনং স্বগুণানাঞ্চ কৃত্বা তপ্যতি সজ্জনঃ। তাই আর নিজের গুণবর্ণনায় আগ্রহী নন তিনি। সাধুব্যক্তিদের কাছে ক্ষমাই শ্রেষ্ঠগুণ, ক্ষমাসারা হি সাধবঃ।

তাই শর্মিষ্ঠাকে ক্ষমা করে গৃহে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। কোমলমধুর কথায় প্রবল মনোবেদনায় কাতরা বিষণ্ণা, দুঃখিতা কন্যাকে শান্ত করতে চাইলেন শুক্রাচার্য। তাঁর মতে, যে ব্যক্তি অপরের তিরস্কার সহ্য করতে পারেন তিনিই সব অর্থেই বিজয়ী। অশ্বের শুধুমাত্র লাগামধারণ করে নয়, যিনি অশ্বের ক্রোধকে সংযত করতে সক্ষম হন, তিনিই সারথি। যঃ সমুৎপতিতং ক্রোধমক্রোধেন নিরস্যতি। দেবযানি! বিজানীহি তেন সর্ব্বমিদং জিতম্।। যিনি অক্রোধ অর্থাৎ ক্ষমাগুণে ক্রোধকে দমন করতে সমর্থ হন, তিনি সবকিছুর বিজেতা। সাপ যেমন নির্মোক অর্থাৎ জীর্ণ খোলস ত্যাগ করে তেমনই ক্রোধকে ছুঁড়ে ফেলে দেন প্রকৃত অর্থে যাঁরা পুরুষ। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চার পুরুষার্থের অধিকারী হন সেই ব্যক্তি যিনি ক্রোধকে সংযত রাখতে সক্ষম হন, যিনি তিরস্কৃত হয়েও প্রভাবিত হন না, যিনি অপরকৃত উত্তেজনাদ্বারা উত্তেজিত হন না, এমন। সহস্র বৎসরের অক্লান্তভাবে পিতৃশ্রাদ্ধকারীর থেকেও শ্রেষ্ঠ হলেন ক্রোধজয়ী ব্যক্তি। কাম ও ক্রোধ দুটিই নিষ্ফল ও ধিক্কৃত। কারণ, এই দুটিই পুণ্যফল হরণ করে। ক্রোধীর, প্রিয় আত্মীয়বর্গ ও সত্যপরায়ণতা সবকিছু বিফল। অপরিণত বালক বালিকারা, ভালোমন্দ না বুঝে শত্রুতায় লিপ্ত হয়, পরিণতবুদ্ধি মানুষের তাদের বিরোধ, অনুকরণ করা উচিত নয়।

পিতার এই মূল্যবান উপদেশ দেবযানীর মনে কী রেখাপাত করল? না। বিদুষী দেবযানী, প্রতিযুক্তির অবতারণা করলেন, তিনি ধর্মের তাত্ত্বিকদিক অবগত আছেন। তাই ক্রোধ ও ক্ষমার দোষগুণ তিনি জানেন। তাঁর মতে, শিষ্যের অশিষ্যসুলভ আচরণ গুরুর ক্ষমার অযোগ্য। ভৃত্য ও শিষ্যের কর্তব্য যথাক্রমে প্রভুসেবা ও গুরুসেবা। সে কাজ যাঁরা করেন না তাঁরা জীবনে অসফল। দেবযানী তাঁদের সঙ্গ পরিহার করতে ইচ্ছুক। যাঁরা আচরণ এবং বংশের উল্লেখ করে প্রতিবেশীকে ধিক্কার দেন, তাঁদের সঙ্গে, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বসবাস করেন না। ব্যবহার ও কুলমর্যাদার সম্মান দেন যাঁরা, সেই সাধুব্যক্তিদের সঙ্গে বসবাস করাই উচিতকর্তব্য। চণ্ডাল ও ধনী ব্যক্তিরা সর্বদাই উৎপীড়ক, সৎকর্মবিহীন, তাঁরা ধনাধিক্যহেতু প্রাধান্যবিস্তারকারী দুষ্কৃতী এবং পাপাচারী হয়ে থাকে। দেবযানীর যুক্তি হল, শুধু জাতি দ্বারাই মানুষের চণ্ডালত্ব চিহ্নিত হয় না। নিজের যথানির্দিষ্ট কর্তব্য না করে যে ব্যক্তি অর্থ, আভিজাত্য ও বিদ্যাবত্তায় আসক্ত থাকেন তিনি কার্যত চণ্ডাল। যাঁরা অকারণে সজ্জনদের হিংসা এবং নিন্দা করেন, সাধুব্যক্তিরা সেই পাপীদের সঙ্গ পরিত্যাগ করেন। কারণ সজ্জনেরাও তাঁদের সঙ্গে বসবাসহেতু ক্রমশ পাপী হয়ে ওঠেন। পাপ ও পুণ্য সঙ্গহেতু জন্ম নেয়। তাই পাপীদের দেশে বসবাস, রুচিকর নয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা

শর্মিষ্ঠার কটু তিক্তবাক্য দেবযানীর মনে দহনজ্বালা সৃষ্টি করেছে। দেবযানী, পিতাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, নিদারুণ কষ্টকর অভিজ্ঞতা হল—দারিদ্র্যসত্ত্বেও কেউ যদি ধনী শত্রুর ধন কিছুমাত্র লাভের আশায়, সেই শত্রুর ভজনা করেন। পণ্ডিতরা মনে করেন, নীচব্যক্তির সংসর্গবশত কেউ যদি বারবার অসম্মানিত হন তবে তাঁর মৃত্যুই শ্রেয়। দুর্জনের মুখনিঃসৃত তিরস্কার দিবারাত্র দুঃখ দেয়। আবার দুর্জনেরাও অপরের মনঃকষ্ট সৃষ্টি করতে তৎপর। তাই উৎসাহী ব্যক্তি দুর্জনদের সংসর্গমুক্ত থাকেন। অস্ত্রাঘাতে বিচ্ছিন্ন অঙ্গ পুনরায় উৎন্ন হয়, অগ্নিদ্বারা দগ্ধ অঙ্গ নিরাময় হয়, নিরাময় হয় না শুধু বাক্যের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত। বাক্যের ক্ষতে কলুষিত চিত্ত কখনও সুস্থ হয়ে ওঠে না।

সব শুনে, ক্রোধবশত, ভালোমন্দ বিচারবোধ হারিয়ে, শুক্রাচার্য, দানবরাজ বৃষপর্বাকে বললেন, পাপের ফল সদ্য ফলে না। বারবার কৃত পাপ, ক্রমশ পাপকারীর মূলোচ্ছেদ করে। নিজের পাপের ফল, নিজে ভোগ না করলেও পুত্রপৌত্ররা সেই পাপের ফল ভোগ করে থাকেন। শুক্রাচার্য দানবরাজকে ভর্ৎসনা করে বললেন, ঋষি অঙ্গিরার পৌত্র, অপাপবিদ্ধ, ধার্মিক, গুরুর সেবাপরায়ণ কচকে, দানবরাজ নিজে, অনুচরদের দ্বারা হত্যা করিয়েছিলেন। দানবরাজকন্যা শর্মিষ্ঠাও শুক্রাচার্যকন্যা দেবযানীকে প্রথমে নির্মমবাক্যে তিরস্কার করেছেন এবং এরপরে ক্রোধবশত মৃত্যুকামনায় পরিত্যক্ত কুয়োতে নিক্ষেপ করেছেন। দেবযানী এই রাজ্যে বাস করতে চাননা। প্রিয় কন্যাকে ছেড়ে শুক্রাচার্য বাস করবেন কীভাবে? তাই তিনি বৃষপর্বার রাজ্য ত্যাগ করতে চলেছেন। বৃষপর্বা প্রথমে বললেন, এই দুই ঘটনা সত্যি হলে, তেন গচ্ছাম্যসদ্গতিম্।

আমার অসদ্গতি হবে। গুরু শুক্রাচার্য, বৃষপর্বাকে তিরস্কার করে বললেন—দানবরাজ কী শুক্রাচার্যকে মিথ্যাবাদী মনে করেন? তাই দোষ স্খালন না করে, তিনি নিজের দোষ উপেক্ষা করছেন? অবশেষে নিজের দোষ স্বীকার করে বৃষপর্বা দেবযানীকে দুর্লভ বর দিতে চাইলেন। একহাজার কন্যাসহ শর্মিষ্ঠাকে দাসীরূপে প্রার্থনা করলেন দেবযানী। শর্ত হল, দেবযানীর পিতা যাঁকে কন্যাদান করবেন শর্মিষ্ঠাকে সেখানেও তাঁর অনুগমন করতে হবে। দেবযানী যেমন চাইবেন সেটাই হবে। শর্মিষ্ঠা সম্মত হলেন। দেবযানী বাক্যবাণে বিদ্ধ করে শর্মিষ্ঠাকে বললেন, স্তাবক, যাচক, দানগ্রহণকারীর কন্যার দাসীবৃত্তি তোমার পক্ষে কী সম্ভব? শর্মিষ্ঠা জানালেন, বিপন্ন জ্ঞাতিদের বিপদমুক্তির জন্যে তিনি যে কোন কাজেই রাজি। দেবযানীর বিবাহোত্তর জীবনেও তিনি তাঁর অনুগমন করবেন। সন্তুষ্ট শুক্রাচার্য, সকন্যা দৈত্যনগরীতে প্রবেশ করলেন।

একদা যে বনে, শর্মিষ্ঠা দেবযানীর মৃত্যুকামনায় তাঁকে কুয়োয় নিক্ষেপ করেছিলেন, সেই বনে, শর্মিষ্ঠা ও তাঁর সহস্র দাসীসহ দেবযানী এসে উপস্থিত হলেন। সখীরা মহানন্দে খেলায় মেতে উঠলেন। সেই সময়ে মৃগয়াবিহারী রাজা যযাতি, তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত অবস্থায় যেন দৈব ইচ্ছানুসারে সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি খেলায় মত্ত কন্যাদের দেখতে পেলেন। রাজা লক্ষ্য করলেন, প্রধানা নারী দেবযানী সহাস্যমুখে রত্নখচিত আসনে বসে আছেন। সেই মহিলাদের মধ্যে নিরুপমা, শ্রেষ্ঠা, স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিতা, শুচিস্মিতা, একজন নারী দেবযানীর আসন থেকেও নিকৃষ্ট আসনে বসে আছেন। সেই কন্যা, ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর পদসেবা করছেন। সহস্র দাসী পরিবৃত দুই কন্যার পরিচয় জানতে উৎসুক হলেন অনিন্দ্যসুন্দর রাজা যযাতি।

দেবযানী তাঁর আত্মপরিচয় জানালেন, তিনি শর্মিষ্ঠার পরিচয়ও জানালেন। আর এও জানালেন যে দানবরাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা তাঁর সখী এবং দাসী দুইই। শর্মিষ্ঠা সর্বদাই দাসীরূপে দেবযানীর অনুগমন করে থাকেন। ইয়ঞ্চ মে সখী দাসী যত্রাহং তত্র গামিনী। দুহিতা দানবেন্দ্রস্য শর্মিষ্ঠা বৃষপর্ব্বণঃ।। অসীম কৌতূহলে রাজা যযাতির প্রশ্ন কথং নু তে সখী দাসী কন্যেয়ং বরবর্ণিনী এই কন্যা একাধারে আপনার সখী ও দাসী হলেন কীভাবে? এমন রূপবতী কন্যা রাজা কোনওদিন দেখেননি। অকপটে রাজা বললেন, জন্মান্তরের পাপকর্মফলের দরুণ এই অপরূপা কন্যা, দেবযানীর থেকেও যিনি অনেক বেশি সুন্দরী, তিনি দাসীবৃত্তিতে নিয়োজিত হয়েছেন। দেবযানীও নিয়তির দোহাই দিয়ে, এই দাসীবৃত্তির কারণ সম্বন্ধে নীরব হলেন।

আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল,পর্ব-১৪: শোভনাসুন্দরী—ঠাকুরবাড়ির এক সরস্বতী!

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৮: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-পরিচয়

দেবযানী রাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন, চেহারা ও বেশভূষা রাজোচিত, কথা বলছেন বেদবিহিত ভাষায়, তিনি কে? কোথা থেকে আসা হচ্ছে?কার সন্তান তিনি? আমায় বলুন। রাজবদ্রূপবেশৌ তে ব্রাহ্মীং বাচং বিভর্ষি চ। কো নাম ত্বং কুতশ্চাপি কস্য পুত্রশ্চ শংস মে। ব্রহ্মচর্যাশ্রমে বেদবিদ্যার জ্ঞান আয়ত্ত করেছেন, তিনি রাজা যযাতি এবং তিনিও রাজার পুত্র। তৃষ্ণার জলের অনুসন্ধান—এই বনে আগমনের কারণ। দেবযানীর সবপ্রশ্নের উত্তরে যযাতি জানালেন। বিদায়ের অনুমতি প্রার্থনা করলেন রাজা। প্রত্যুত্তরে দেবযানী বিবাহের প্রস্তাব রাখলেন। দুই সহস্র দাসীসহ শর্মিষ্ঠাকে সঙ্গে নিয়ে দেবযানী যযাতির অধীনতা স্বীকার করলেন। ত্বদধীনাস্মি ভদ্রং তে সখা ভর্ত্তা চ মে ভব। আপনি আমার সখা ও স্বামী হন। ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন রাজা যযাতি। পরভার্য্যা স্বসা শ্রেষ্ঠা সগোত্রা পতিতা স্নুষা। অবরা ভিক্ষুকাঽস্বস্থা অগম্যাঃ কীর্ত্তিতাঃ বুধৈঃ।। পরস্ত্রী, ভগ্নী, বর্ণশ্রেষ্ঠা, সগোত্রা, পতিতা, পুত্রবধূ, নীচবর্ণা, ভিক্ষুকী এবং অসুস্থা এঁরা বিবাহে অযোগ্যা —এমন বিধান দিয়েছেন পণ্ডিতব্যক্তিরা। দেবযানীর যুক্তি হল, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। যযাতি নিজে রাজর্ষি এবং রাজর্ষি পিতার পুত্র। তাই বহস্ব মাম্। আমায় বিবাহ করুন। রাজা অনিচ্ছুক। একদেহ থেকে চার বর্ণের উদ্ভব হলেও প্রত্যেক বর্ণের ধর্ম এবং শৌচাদি বিষয় পৃথক এবং বৃত্তিগত কারণে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য।

দেবযানী স্বমতপ্রতিষ্ঠায় স্মৃতিশাস্ত্রের বিবাহবিষয়ক বিধানের উল্লেখ করে বললেন, পাণিগ্রহণধর্মের অন্যথা করছেন যযাতি। একদা দেবযানীকে কুয়োর থেকে উদ্ধারের সময়ে পাণিগ্রহণ করেছিলেন রাজা, সেই হেতু দেবযানী তাঁকে আজ বরণ করছেন। ঋষিপুত্র এবং স্বয়ং নিজে ঋষি হয়ে যে হাত স্পর্শ করেছিলেন সেই পাণি আর কেউ গ্রহণ করতে পারবেন না। কথং নু মে মনস্বিন্যাঃ পাণিমন্যঃ পুমান্ স্পৃশেৎ। গৃহীতমৃষিপুত্রেণ স্বয়ং বাপ্যৃষিণা ত্বয়া।। অর্থাৎ রাজা শাস্ত্রোক্ত পাণিগ্রহণধর্মের অন্যথা করতে পারেন না। যযাতির মতে উগ্রবিষ সাপ এবং সর্বব্যাপী আগ্রাসী অগ্নির থেকেও ভয়ানক হলেন ক্রুদ্ধ ব্রাহ্মণ। কারণ সাপের দংশনের লক্ষ্য একজন, অস্ত্রের লক্ষ্যও একজনই।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৯৫: ফিলে তৈরির জন্য পাঙাশ মাছ আদর্শ, এই মাছচাষে আর্থিক লাভও ঈর্ষণীয়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

একজন ক্রুদ্ধ ব্রাহ্মণ কিন্তু নগরসহ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রকে বিনষ্ট করতে সক্ষম। তাই দেবযানীর পিতা স্বয়ং কন্যাদান না করলে যযাতির এই বিবাহে সম্মতি নেই। নিশ্চিন্ত দেবযানী বললেন, দত্তাং বহস্ব তন্মা ত্বং পিত্রা রাজন্! বৃতো ময়া। অযাচতো ভয়ং নাস্তি দত্তাঞ্চ প্রতিগৃহ্ণতঃ।।

আমি আপনাকে বরণ করছি। পিতা দান করবেন আমায়। তাহলে আমায় বিবাহ করুন। প্রার্থিতাকে নয়, ইতিমধ্যে প্রদত্তাকেই আপনি গ্রহণ করছেন, আপনার কোনও ভয় নেই। খবর গেল দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্যের কাছে। সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে শুক্রাচার্য উপস্থিত হলেন সেখানে। সেখানে, তাঁকে প্রণাম করে, নতমস্তকে জোড়হাতে রাজা যযাতি শুক্রাচার্যের বিধানের অপেক্ষায় রইলেন। দেবযানী পিতাকে জানালেন, ন হুষপুত্র রাজা যযাতিই একদা বিপন্না দেবযানীকে কুয়ো থেকে হাত ধরে টেনে তুলেছিলেন। তাই এর হাতেই অর্পণ করুন আমায়। পৃথিবীতে আর কোনও ব্যক্তিকে স্বামীরূপে বরণ করতে পারবেন না তিনি। নমস্তে দেহি মামস্মৈ লোকে নান্যং পতিং বৃণে।

শুক্রাচার্য জানালেন, প্রণয়ের পাত্র আর ধর্ম পৃথক। নহুষপুত্রকে স্বামীরূপে বরণ করেছেন দেবযানী, অনুমতির অপেক্ষা রাখেননি। বৃহস্পতিপুত্র কচের অভিসম্পাতে কোনও ঋষিপুত্রের গ্রহণযোগ্যা নন দেবযানী। হে নহুষপুত্র যযাতি, আমার পরমপ্রিয় কন্যাটি তোমায় স্বামীরূপে বরণ করেছে, আমি একে দান করলাম, তুমি তাঁকে গ্রহণ কর। বৃতোঽনয়া পতির্বীর! সুতয়া ত্বং মমেষ্টয়া। গৃহাণেমাং ময়া দত্তাং মহিষীং নহুষাত্মজ!।। রাজা শুক্রাচার্যের শরণাপন্ন হলেন, বর্ণসঙ্করজনিত অধর্মাচরণের পাপ থেকে যেন রাজা মুক্ত থাকেন। শুক্রাচার্য কথা দিলেন, রাজার পাপমুক্তির দায়ভার তাঁর নিজের। শুক্রাচার্য বর দিলেন, রাজা যযাতির পাপ বিনষ্ট করবেন তিনি। যযাতি দেবযানীকে ধর্মপত্নীরূপে গ্রহণ করে আনন্দে বিরাজ করুন। শর্ত হল, এই দানবরাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা, তিনিও রাজা যযাতির কাছে সর্বদাই সম্মানীয়া হবেন। শয্যায় যেন কখনও রাজা তাঁকে আহ্বান না জানান। ইয়ঞ্চাপি কুমারী তে শর্মিষ্ঠা বার্ষপার্ব্বণী। সম্পূজ্যা সততং রাজন্! মা চৈনাং শয়নে হ্বয়েঃ।। রাজা যযাতি দুসহস্রকন্যা এবং শর্মিষ্ঠাসহ দেবযানীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন। মহান শুক্রাচার্য ও দানবদের দ্বারা সম্মানিত হয়ে পুলকিতমনে রাজধানীতে ফিরে গেলেন রাজা যযাতি।

শুক্রাচার্যকন্যা দেবযানী ও দানবরাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা দু’ জনেই দেবাসুরের দ্বন্দ্বে ব্যবহৃত হয়েছেন। দেবরাজ ইন্দ্র দুই কন্যার পারস্পরিক কলহের নিয়ামক। এমনটাই ঘটে থাকে লৌকিক জীবনে, সামাজিক ও রাজনৈতিক চালচিত্রে। সরল সাধারণরাই যে কোনও বড় চক্রান্তে চাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকেন।পারস্পরিক বোঝাপড়া, হার মানে ক্রুর জটিলতায়। বাইরের বসনের আবরণের অন্তরালটুকু সরে যায়। বেড়িয়ে পরে নগ্নরূপ। ফল হল জাতিবিদ্বষ, ঘৃণা, বিষোদ্গার। যার প্রভাব চলতেই থাকে। হিংস্রতা চরমপর্যায়ে পৌঁছয়। সামাজিক অবক্ষয়ের শেষপর্যায়ে প্রাণহরণেও দ্বিধান্বিত হয়না মানুষ। দেবযানীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন শর্মিষ্ঠা। এই পতন বিবেকচেতনার, স্খলন, পতন, বিচ্যুতি। জন্ম নেয় প্রতিহিংসার জেহাদ। বড় বিচিত্র লৌকিক জীবন। তুচ্ছকারণে কে কখন হিংসায় মেতে ওঠে তা নির্ণয় করা দুষ্কর। মানুষের মধ্যেই আছে দানববৃত্তি, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, ইগোর প্রাধান্য। ইগোর লড়াইয়ে বুদ্ধিজীবীর কাছে হার মানে নীচ পাশবপ্রবৃত্তি। মর্মভেদী বাক্যের ক্ষত যে কত নির্মম হতে পারে দেবযানী, বুঝিয়ে দিয়েছেন।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সুস্থচেতনা হাত ধরে টেনে তুলতে চায় অধঃপতিত বোধকে। ঘৃণ্য আসুরিক শক্তি নিজেদের স্বার্থরক্ষার কারণে সমঝোতায় আসতে চায়। শুক্রাচার্যের মতো শুভবোধের আধার কোনও ব্যক্তিত্ব এই বিদ্বেষবিষবিনাশে প্রয়াসী হন। মহাভারতের শিক্ষাগুরু শুক্রাচার্যের কণ্ঠে কথা বলেন। ক্রোধজয়ের মধ্যেই নিহিত আছে মানুষের সম্পূর্ণতা। ক্রোধের বিনাশকরূপ ফুটে ওঠে শুক্রাচার্যের উপদেশে। ক্ষমাই আশ্রয়ণীয়। দেবযানী সেই ক্ষুব্ধ, নির্মম মানবাত্মার প্রতিনিধি যাঁরা যে কোনও সদুপদেশগ্রহণে অক্ষম। তাঁদের নিজস্ব অকাট্যযুক্তি নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে সর্বদাই মজুদ। কোনও অশুভবোধকে এড়িয়ে চলতেই তাঁদের আগ্রহ, যেমন দেবযানী দানবরাজ্যের অশুভপ্রভাবমুক্ত হতে চেয়েছেন স্থানত্যাগের সিদ্ধান্তে। বাক্যবাণের তীব্র অভিঘাত নিদারুণ ক্ষতের সৃষ্টি করে যার নিরাময় অসম্ভবপ্রায়। অবমানিতা দেবযানীর আহত মানসিকতার মধ্যে তা প্রতিফলিত হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত শুক্রাচার্য ক্রোধের বশ্যতা স্বীকার করেছেন। স্নেহ ও নৈতিকতার টানাপোড়েনের কাছে নতিস্বীকার করে, দানবগুরু শুক্রাচার্য দানবরাজা বৃষপর্বার ওপরে মানসিকচাপ সৃষ্টি করেছেন। অনেকটা যেন ব্ল্যাকমেলিং। শুক্রাচার্যের অভাবে বিপন্ন হবে দানবরা। কারণ সঞ্জীবনীবিদ্যা হাতছাড়া হয়ে যাবে যে। জীবনদায়ী সেই বিদ্যা। আত্মীয়দের স্বার্থরক্ষায় ঘৃণ্য দাসীবৃত্তি স্বীকার করে নিয়ে, দেবযানীর বশ্যতা স্বীকার করলেন শর্মিষ্ঠা। প্রথমদর্শনেই শর্মিষ্ঠার প্রতি রাজা যযাতির মুগ্ধতা ছিল। রূপজ মোহ, প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত করে মানুষকে, পরে বিচারবুদ্ধি কাজ করে।

বিদ্বান, রূপবান, ধার্মিক রাজা যযাতিকে মনে ধরল শুক্রাচার্যকন্যার। সদ্গুণ সর্বদাই আকর্ষণ করে, যে কোনও মানুষকে। দেবযানী প্রতিলোমবিবাহে (উচ্চবর্ণের কন্যা, নীচবর্ণের পাত্র) আগ্রহী। রাজা যযাতি বর্ণাশ্রমধর্মের নিয়মানুসারী। যে কোনও সুস্থ নাগরিক, সামাজিক নিয়মরক্ষায় যত্নবান হন। যযাতি প্রখ্যাত বংশের রাজা। তিনি সাধারণের পথপ্রদর্শক। তাঁর কাছে হয়তো এটাই প্রত্যাশিত ছিল।

যে কোনও পাণিগ্রহণ বিবাহের পর্যায়ভুক্ত নয়। দেবযানী জীবনরক্ষার্থে হাত স্পর্শকরাকে বৈবাহিক পাণিগ্রহণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। শুভবোধের হাত ধরে বাঁচতে চায় দ্বিধাগ্রস্ত বিভ্রান্ত মানুষ। দেবযানী যে কোনও উপায়ে যযাতির জীবনসঙ্গিনী হতে চেয়েছেন। প্রাচীনভারতীয় বর্ণাশ্রমধর্মকেন্দ্রিক সমাজে বর্ণশ্রেষ্ঠর অপরিসীম প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারেন না কেউই। রাজা যযাতিও পারেননি। সমাজধর্ম হৃদয়বৃত্তির কাছে হার মানে। এর পরিণতি শুধু আধুনিক ভারত নয়,মহাভারতীয়সমাজে শুক্রাচার্যও মেনে নিয়েছেন। একদা পরস্পরবিদ্বেষী এই দুই কন্যাকে গ্রহণ করলেন যযাতি। মহানুভব শুক্রাচার্যের শর্মিষ্ঠাসম্পর্কিত সতর্কবার্তাটি কী রাজা যযাতি মনে রেখেছেন? না, রূপজমোহের কাছে নিঃশর্ত আত্মনিবেদনের অমোঘ প্রভাব এড়িয়ে চলতে পারেননি তিনি?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content