রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রবিদ্যাপ্রদর্শনের পরে, রঙ্গস্থানে, পাণ্ডবদের পিতৃব্য ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে, তাঁর কনিষ্ঠভাই ধার্মিক বিদুরকে বলেছিলেন, দেবী কুন্তী যেন হোমাগ্নি জ্বালিয়ে তোলার অরণি অর্থাৎ বহ্নি উৎপাদনের কাঠবিশেষ। সেই অরণি থেকে উৎপন্ন হয়েছে প্রজ্জ্বলিত তিনটি অগ্নিশিখা, পাণ্ডবত্রয়ী, যুধিষ্ঠির, ভীম এবং অর্জুন। এঁদের উপস্থিতিতে ধৃতরাষ্ট্র নিজেকে ধন্য, অনুগৃহীত এবং সুরক্ষিত মনে করেন। ধন্যোঽনুগৃহীতোঽস্মি রক্ষিতোঽস্মি মহামতে! পৃথারণিসম্ভূতৈস্ত্রিভিঃ পাণ্ডববহ্নিভিঃ।।
পাণ্ডবমাতা কুন্তীর প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ছিল ধৃতরাষ্ট্রের উক্তিতে। পরে সেই একই ধৃতরাষ্ট্রের রাতের ঘুম কেড়ে নিল, পঞ্চপাণ্ডবের সাফল্য। সর্বোত্তম বলশালী ভীম এবং সর্বাস্ত্রনিপুণ অর্জুন, দুর্যোধনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠলেন। দুর্যোধনের বন্ধু সূর্যপুত্র কর্ণ, মাতুল সুবলতনয় শকুনি, পাণ্ডবদের বিচিত্র বিনাশের উপায় চিন্তা করলেন তখন। পাণ্ডবদের হিতাকাঙ্খী বিদুরের পরামর্শ অনুসারে প্রতিবাদ না করে উপযুক্ত প্রতিরোধের নানাভাবে ব্যবস্থা নিলেন পঞ্চপান্ডব। পুরবাসীরা, পাণ্ডবদের গুণগুলি সভায় প্রচারে সোচ্চার হয়ে উঠলেন।

পুরবাসীদের ধৃতরাষ্ট্র সম্বন্ধে মূল্যায়ন ছিল এমন—ধৃতরাষ্ট্রের প্রজ্ঞারূপ জ্ঞানচক্ষু থাকলেও তিনি তো দৃষ্টিশক্তিহীনতার কারণে রাজা হতে পারেননি। তিনি এখন কীভাবে রাজা হবেন? আর ভীষ্ম? তিনি যে চিরকুমার ও সত্যপ্রতিজ্ঞ। তিনি রাজত্ব ফিরিয়ে দিয়েছেন এর আগেও। ভীষ্ম, কিছুতেই রাজমুকুট ধারণ করবেন না। তাই সদ্যযৌবনে উপনীত প্রবীনদের প্রতি সেবাপরায়ণ, দয়াবান, জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে অবশ্যই এখন যুবরাজপদে অভিষিক্ত করব আমরা। তে বয়ং পাণ্ডবজ্যেষ্ঠং তরুণং বৃদ্ধশীলিনম্। অভিষিঞ্চাম সাধ্বদ্য সত্যকারুণ্যবেদিনম্।।

সেই ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের দায়িত্বে, শান্তনুপুত্র ভীষ্ম এবং সপুত্র ধৃতরাষ্ট্র, সসম্মানে বিবিধ জীবনোপভোগের সামগ্রীভোগে সমর্থ হবেন। এইসব প্রশংসা উক্তি দুর্যোধনের কানে পৌঁছল। হিংসার দহনজ্বালায় দগ্ধ মন নিয়ে,দুর্যোধন হাজির হলেন পিতার কাছে। তিনি পিতাকে জানালেন, পুরবাসীদের অভিমত হল,ধৃতরাষ্ট্র বা ভীষ্ম নন, পাণ্ডপুত্রই রাজসিংহাসনের যোগ্য পুরুষ। তাঁকেই প্রজারা চাইছেন। পিতামহ ভীষ্মের রাজ্যভোগের কোনও ইচ্ছাই নেই। পুরবাসীদের এইসব যুক্তি পীড়াদায়ক। পাণ্ডু তাঁর রাজোচিত গুণবলেই রাজত্ব লাভ করেছিলেন, কারণ জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন জন্মান্ধ। তাই যুধিষ্ঠির রাজা হলে উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁদের বংশধরেরাই রাজা হবেন। এ ভাবে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে পাণ্ডবরা সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করবেন তাহলে রাজবংশে জন্ম নিয়েও রাজ্যবিহীন হবেন ধৃতরাষ্ট্র পুত্ররা। তাচ্ছিল্যের পাত্র হবেন তাঁরা।
এই নরকবাসের তুল্য দুঃখভোগ থেকে মুক্তি চাইছেন দুর্যোধন।হে রাজন্,কোন উপায় উদ্ভাবন করুন। ন ভবেম যথা রাজন্!তথা নীতির্বিধীয়তাম্। নিষ্কৃতির উপায় কিছু নির্ধারণ করুন। পিতা ধৃতরাষ্ট্র যদি জ্যেষ্ঠত্বহেতু রাজা হতেন তাহলে প্রজারা বংশানুক্রমে সিংহাসনে আসীন দুর্যোধনের আনুগত্যস্বীকারে বাধ্য হতেন। মন্ত্রী কণিকের প্ররোচনামূলক বিভেদ সৃষ্টিকারী মন্ত্রনা স্মরণ করে এবং দুর্যোধনের এই জ্বালাময় বার্তা শুনে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর জ্ঞানদৃষ্টি সত্ত্বেও দ্বিধান্বিত হলেন। চিন্তায়, শোকে উদ্বেল হয়ে উঠলেন।

দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, ও শকুনি সকলে মিলে পরামর্শ করে যে দুষ্ট বুদ্ধিটি দিলেন, সেটি দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন, পাণ্ডবদের ভয় থেকে মুক্তির উপায় হল, নিপুণ কোনও উপায় অবলম্বনে বারণাবত নগরে তাঁদের নির্বাসিতকরা। ধৃতরাষ্ট্র, দোলচলচিত্ততায় ভুগছেন। কনিষ্ঠ পাণ্ডু যে বড়ই ধার্মিক ছিলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্র এবং অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গের প্রতি সর্বদাই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তিনি নিজের প্রাত্যহিক ভোজ্যের বিষয়েই অবহিত থাকতেন না, তো রাজ্যের বিষয়ে আর কি বলবেন? তিনি একনিষ্ঠভাবে গভীর নির্ভরতায় সমগ্র রাজ্যটি ধৃতরাষ্ট্রের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। সেই ধার্মিক পাণ্ডুর পুত্র যে পাণ্ডুর মতোই ধর্মপরায়ণ, গুণী, পৃথিবীবিখ্যাত, পুরবাসীদের স্বীকৃত এবং অনুমোদিত ভাবি রাজা। এই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে কি পিতৃপিতামহদের রাজ্য থেকে বলপূর্বক নির্বাসিত করা সম্ভব? বিশেষ করে তাঁর বিপুল সমর্থক রয়েছেন চতুর্দিকে।

রাজা পাণ্ডু, মন্ত্রী সেনা প্রত্যেককে পালন পোষণ করেছেন। এমনকি তাঁদের পুত্র পৌত্রাদিক্রমে একই নিয়ম বজায় রেখে তাঁদেরকেও প্রতিপালন করেছেন। পুরবাসীদেরও, তিনি যথানিয়মে আপ্যায়িত করেছেন। পাণ্ডবদের বিরুদ্ধাচরণ করলে, পুরবাসীরা, যুধিষ্ঠিরের স্বার্থরক্ষায় সপরিবারে আমাদেরকেও হত্যা করবে না কেন? কথং যুধিষ্ঠিরস্যার্থে ন নো হন্যুঃ সবান্ধবান্। দুর্যোধন পিতাকে জানালেন, এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাণ্ডবদের নির্বাসিত করাই শ্রেয়। ভবিষ্যতে দুর্যোধন রাজ্যে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে, সপুত্র দেবী কুন্তী হস্তিনাপুরে ফিরে আসবেন। ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধনের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য অত্যন্ত আসাধু, তাই এই দুরভিসন্ধি তিনি প্রকাশ্যে আনতে পারছেন না। অভিপ্রায়স্য পাপত্বান্নৈতত্তু বিবৃণোম্যহম্।

কুরুমুখ্য ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ প্রভৃতি বিশিষ্টজনেরা পাণ্ডবদের নির্বাসনসিদ্ধান্তে সম্মত হবেন না। ভীষ্ম ব্যতীত অন্যান্য ধার্মিক কুরুবংশীয়রা ধৃতরাষ্ট্রপুত্র ও পাণ্ডুতনয়দের মধ্যে কোন বৈষম্য প্রকাশ করেন না। এই নির্বাসনের কারণে তাঁদের কাছে কৌরবরা বধযোগ্য হবেন। পিতার যুক্তির বিপক্ষে দুর্যোধন হিসেব কষলেন। পিতামহ ভীষ্মের অবস্থান মাঝখানে, অর্থাৎ তাঁর কাছে উভয়পক্ষই সমান। অশ্বত্থামা রয়েছেন দুর্যোধনের দলে। তাই পুত্রের প্রতি স্নেহশীল পিতা দ্রোণাচার্য দুর্যোধনদের পক্ষ অবলম্বন করবেন। আর কৃপাচার্য? তিনি ভগ্নীপতি ও ভাগিনেয় অশ্বত্থামার পক্ষ ত্যাগ করতে পারবেন কী? পিতৃব্য বিদুর যদিও তাদের অর্থে প্রতিপালিত হয়ে পাণ্ডবদের পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন, কিন্তু তাঁর একার শক্তি আর কত? কাজেই, দুর্যোধনের পরামর্শ হল, আশঙ্কাহীনভাবে পাণ্ডুপুত্রদের মাতাসহ এখনই পাণ্ডবদের বারণাবতনগরে নির্বাসিত করুন রাজা,আজই। সুবিশ্রব্ধঃ পাণ্ডুপুত্রান্ সহ মাত্রা প্রবাসয়।।বারণাবতমদ্যৈব যথা যান্তি তথা কুরু।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪০: রামচন্দ্রের পিতৃসত্যপালনের অঙ্গীকারে ধর্মবোধ, যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মনোমুগ্ধকর প্রভাব

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৪: শ্যামপুকুরে ঠাকুর

বিনিদ্ররাত্রি জাগরণের এবং শলাকাবিদ্ধমনের শোকের আগুনের অবসান হোক। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুর্যোধন, ভাইদের সঙ্গে নিয়ে, প্রজাদের মান ও অর্থের মাধ্যমে বশে আনলেন। ধৃতরাষ্ট্র কয়েকজন মন্ত্রণাবিশারদ মন্ত্রীকে নিয়োগ করলেন। তাঁর নির্দেশে, সেই মন্ত্রীরা পাণ্ডবদের কাছে বারণাবতের গুণকীর্তন করতে লাগলেন। রত্নসমৃদ্ধ, উপভোগ্য বারণাবত নগরে মহাদেবের উৎসব উপলক্ষ্যে বিপুল জনসমাগম হয়েছে এখন। পাণ্ডবরা আকৃষ্ট হলেন শহরটির প্রতি।

তাদের কৌতূহলকে উদ্দীপ্ত করলেন ধৃতরাষ্ট্র। আমার লোকজন প্রত্যহ বার বার বলছেন এই বারণাবতনগর পৃথিবীর একটি অত্যন্ত রমণীয় স্থান। তাই তোমরা ইচ্ছে করলে, সেখানে মহাদেবের ওই উৎসবে যোগদান কর। বাছারা, যদি মনে কর, তাহলে লোকজন নিয়ে, অনুচরসহ দেবগনের মতো মহাদেবের উৎসবে যোগ দাও। সেখানে দেবতাদের মতোই উদারভাবে ব্রাহ্মণ ও সেরাগায়কদের পুরস্কৃত করতে পারবেন পাণ্ডুপুত্ররা। কিছুদিন আনন্দে দিন কাটিয়ে আবার হস্তিনাপুরে নির্বিঘ্নে ফিরে আসবেন তাঁরা। ধৃতরাষ্ট্রের মনোভাব সবটাই বুঝতে পারলেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু অসহায় তিনি।নিরুপায় যুধিষ্ঠির অবশেষে সম্মত হলেন। তথেতি প্রত্যুবাচ তম্।

তাই হোক। মাননীয় কুরুমুখ্য এবং মান্যবর পুরমুখ্য, মন্ত্রীবর্গ ব্রাহ্মণ, তপস্বী, পুরোহিত ও সাধারণ পুরবাসী ও মা গান্ধারীর কাছে বিদায় নিলেন পঞ্চপান্ডব। জানালেন, সেই সুন্দর জনাকীর্ণ বারণাবতনগরে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ অনুসারে যাবেন তাঁরা। মাননীয় শ্রদ্ধেয় গুরুজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন যুধিষ্ঠির। সকলের আশিস মাথায় নিয়ে ভাবি রাজ্যলাভের জন্যে মাঙ্গলিকক্রিয়া সম্পন্ন করে যাত্রা করলেন পাণ্ডুপুত্ররা। দুর্জন, দুর্যোধন মন্ত্রী পুরোচনকে ডেকে বললেন, সমৃদ্ধ শহরটি যেমন এখন দুর্যোধনের তেমনভাবেই নিজের মনে করে সেটি রক্ষার দায়িত্ব এখন পুরোচনের। দুর্যোধনের বিশ্বাস, মন্ত্রী পুরোচন সমস্ত মন্ত্রণা গোপন রেখে শত্রুদের বিনাশ সাধন করবেন। এখন থেকে পুরোচনের লক্ষ্য হবে সেটাই। শত্রুদের ধ্বংসের উপায় কী? কোন উপায়ে সেটি সম্ভব? দুর্যোধন যেমনটি বলবেন সেইভাবেই কাজটি রূপায়িত করবেন পুরোচন।

আপাতত পুরোচনের দায়িত্ব হল,বারণাবতে পৌঁছে অস্ত্রাগারযুক্ত, মণিরত্নসমৃদ্ধ, প্রাকারবেষ্টিত, বসবাসের উপযোগী সুন্দর একখানি গৃহনির্মাণ। গৃহনির্মাণের উপকরণে মিশিয়ে দিতে হবে শন, ধুনা প্রভৃতি সহজদাহ্যপদার্থগুলি। মাটির সঙ্গে ঘি, তেল, চর্বি, লাক্ষা যুক্ত করে দেয়ালের ভিত্তিগুলিতে প্রলেপ যেন দেওয়া হয়। সেই গৃহের সর্বত্র শন, তেল, ঘি, গালা,সহজদাহ্য কাঠ নিক্ষেপ করা হয় যেন। পরীক্ষা করেও পাণ্ডবরা এগুলির অস্তিত্ব যেন টেরটি না পান। বারণাবতবাসীদের কাছে যেন এসব অজ্ঞাত থাকে। গৃহটিতে পান্ডবদের আসন, যান,শয্যা, সবকিছু যেন প্রস্তুত থাকে, আয়োজনে কোনও ত্রুটি না হয়। নিশ্চিন্তমনে যখন পাণ্ডবরা নিদ্রামগ্ন থাকবেন তখন দুয়ারের কাছে নিজের কক্ষে প্রথমে অগ্নিসংযোগ করবেন পুরোচন। তারপরে সেই আগুন ব্যাপ্ত ও প্রসারিত হয়ে গ্রাস করবে পাণ্ডবদের। জনসাধারণের নিন্দার বা সন্দেহের তীর যেন দুর্যোধনকে বিদ্ধ না করে। দুর্যোধন যেন নিন্দার পাত্র না হন। পুরোচন সম্মত হয়ে, প্রভু দুর্যোধনের নির্দেশমতো দ্রুতগামী ঘোড়ায় আরোহণ করে বারণাবত নগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।সবকাজই দুর্যোধনের পরিকল্পনামত সম্পন্ন হল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৬: সুন্দরবনের গবাদি-পশুরক্ষক মানিক পীর

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

শ্রেষ্ঠ কুরুমুখ্যরা এবং পৌরবৃন্দ পাণ্ডবদের বিদায়কালে তাঁদের অনুগমন করলেন। তাঁরা পাণ্ডবদের অসহায় অবস্থা দেখে ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রদের নিন্দায় মুখর হলেন। ধৃতরাষ্ট্রের, পুত্রদের প্রতি নির্লজ্জ সমর্থন ও পক্ষপাতিত্ব হল তাঁদের নিন্দাময় আলোচনার বিষয়। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনকে ধৃতরাষ্ট্রের অপছন্দ। নকুল ও সহদেবকে তিনি গণ্যই করেন না। জনতা অবাক হল, এই ভেবে, যে মহাত্মা ভীষ্ম কীভাবে এই অকর্মটিতে, পাণ্ডবদের নির্বাসনের সিদ্ধান্তে সম্মতি দিলেন? সত্যিই প্রজাদের পিতৃতুল্য ছিলেন বিচিত্রবীর্যের পুত্র পাণ্ডু। তাঁর এই বালক পুত্রগুলিকে ধৃতরাষ্ট্র সহ্যই করতে পারলেন না? প্রজাদের একেবারেই এই নির্বাসনে অসম্মতি রয়েছে। যুধিষ্ঠিরের গন্তব্য তাঁদেরও গন্তব্য। তাঁরা রাজধানী ত্যাগ করে সেখানেই বসতি করবেন। গৃহান্ বিহায় গচ্ছামো যত্র গন্তা যুধিষ্ঠিরঃ। প্রজাদের আশ্বস্ত করলেন যুধিষ্ঠির। পিতৃস্থানীয়, শ্রদ্ধেয়, গুরু, রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কথা তাঁরা মান্য করেন। সেটি তাঁদের শাস্ত্রসম্মত নিয়ম পালনের অনুরূপ। প্রজারা পাণ্ডবদের বন্ধু। তাঁদের আশিস পাণ্ডবদের পাথেয়। প্রজারা যেন খুশিমনে গৃহে ফিরে যান। যুধিষ্ঠিরের কথায় পুরবাসীরা আনন্দিত হয়ে বিদায় নিলেন।

তখন বুদ্ধিমান বিদুর অন্যদের দুর্বোধ্য ম্লেচ্ছভাষায় যুধিষ্ঠিরকে সৎ পরামর্শ দিলেন। নীতিশাস্ত্রানুসারী বুদ্ধির সাহায্যে মানুষ শত্রুদের উদ্ভাবিত কূটকৌশল বুঝে নিয়ে, বিপদ হতে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে। সেই উপায়টিই যুধিষ্ঠির অবলম্বন করবেন। লৌহনির্মিত অস্ত্র ছাড়াও শাণিত অস্ত্র আছে—এই জ্ঞান মাথায় রেখে যারা শত্রুর প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেন তারা কখনও ধ্বংস হন না। আগুন শুষ্ক বন থেকে বিশাল অরণ্যে ছড়িয়ে পড়লেও, গর্তে আশ্রিত, ইঁদুরকে দগ্ধ করতে পারে না। মানুষের ক্ষেত্রেও এটি আত্মরক্ষার একটি অন্যতম উপায়। এই ইঙ্গিতে মাননীয় বিদুর যুধিষ্ঠিরকে আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে সংকেত দিলেন। দৃষ্টিহীন মানুষ পথ চিনতে পারে না। দিকনির্ণয় অজ্ঞাত থাকে তার কাছে। ধৈর্যহীনের ধনলাভের আশা অধরাই থেকে যায়।

এই উপদেশ থেকে যুধিষ্ঠির তাঁর পথনির্দেশ পেতে পারেন। গর্তের অভ্যন্তরে আগুনের তাপ থেকে রক্ষার উপায় সজারু জানে, সে আগুনের উত্তাপ থেকে প্রাণরক্ষার তাগিদে গর্তের অপরপ্রান্তে আশ্রয় নেয়।মানুষের পথ চিনবার উপায় হল বিভিন্ন স্থানে বিচরণ। রাত্রিতে নক্ষত্র তার দিকনির্ণায়ক হয়। সে নিজেও অজানা পথের কষ্ট ভোগ করে নিজেকে বাঁচাতে সমর্থ হয় এবং সঙ্গীদেরও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির, শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বিদুরের সমস্ত বক্তব্যই মনে মনে আত্মস্থ করলেন। মা কুন্তী, পুত্রের কাছে জানতে চাইলেন যদি কোন ক্ষতি না হয় তাহলে উভয়ের কথোপকথন তিনি শুনতে আগ্রহী। যুধিষ্ঠির মাকে সংক্ষেপে জানালেন বাসগৃহে অগ্নিকাণ্ড হতে পারে এবং এবং এই স্থানের কোন পথ যেন অজানা না থাকে—এই ছিল বিদুরের উপদেশ।

বারণাবতবাসীরা পাণ্ডবদের আগমনবার্তা শুনে শাস্ত্রীয় মাঙ্গলিকদ্রব্য নিয়ে পাণ্ডবদের অভ্যর্থনা জানালেন।তাঁদের পরম শ্রদ্ধায় আপ্যায়িত করলেন তাঁরা। পঞ্চপান্ডব সসম্মানে নগরের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে প্রথমে সাক্ষাৎ করলেন। তারপর যথাক্রমে সাক্ষাৎ করলেন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নির্বিশেষে সকল নগরবাসীদের সঙ্গে। পথপ্রদর্শক হলেন পুরোচন। তিনি, পাণ্ডবদের খাদ্য, পানীয়, উত্তম শয্যা, আসনের কোনও অভাব রাখলেন না। কিছুদিন একটি গৃহে অবস্থানের পরে পাণ্ডবরা পুরোচনের পরামর্শ অনুযায়ী, শিবভবন নামের অশিব অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে অমঙ্গলজনক ভবনে বসবাস করতে লাগলেন। সেই বাসভবনটি দেখে, গালা, চর্বির গন্ধ পেয়ে, যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে জানালেন—গৃহটি সহজদাহ্য পদার্থ দিয়ে নির্মিত হয়েছে। খুব নিপুণ শিল্পীরা এই গৃহের স্রষ্টা। দুর্যোধনের বিশ্বস্ত, দুষ্ট পুরোচন আমাদের দগ্ধ করতে ইচ্ছুক। কনিষ্ঠ পিতৃব্য বিদুর, যিনি পাণ্ডবদের একান্ত হিতাকাঙ্খী তিনি আগেই এটি জানিয়েছিলেন। ভীম বললেন, তাহলে এই গৃহ পরিত্যাগ করে পূর্বের বাসগৃহেই যাওয়া যাক।

যুধিষ্ঠির তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে বললেন, নিজেদের সুরক্ষাবলয় ঠিক রেখে নিঃশঙ্কচিত্তে এই গৃহে বাসকরাই ভালো। এখন শুধু ভাবি গন্তব্যের সন্ধান করতে হবে। নানা সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা করলেন জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠির। পুরোচনকে, তাঁদের নিজেদের সশঙ্কভাব, বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাহলে সে হয়তো দ্রুত বলপূর্বক আমাদের পুড়িয়ে মারবে। ক্ষিপ্রকারী ততো ভূত্বা প্রসহ্যাপি দহেত নঃ।

পুরোচনের লোকনিন্দার এবং পাপের এই দুইয়েরই ভয় নেই। সে অতি দুষ্ট এবং দুর্যোধনের আজ্ঞাধীন, বশংবদ। দগ্ধ হওয়ার ভয়ে পাণ্ডবরা নিজেরাই বসবাসকালীন অবস্থায় যদি গৃহে আগুন লাগিয়ে দেন, তাহলে পিতামহ ভীষ্ম, পাণ্ডবদের ওপর ক্রুদ্ধ হবেন, তাঁরা অন্যান্য কৌরবদেরও রাগের কারণ হবেন। পুরোচন যদি পাণ্ডবদের বাসগৃহটি দগ্ধ করেন তাহলে তাঁর ওপর এবং পুরোচনপ্রভু দুর্যোধনের ওপর সকলের ক্রোধ হওয়াই স্বাভাবিক। আর পাণ্ডবরা যদি পলায়ন করেন তবে রাজসিংহাসনে যাঁর লুব্ধদৃষ্টি রয়েছে, সেই দুর্যোধন, নিশ্চিত চর পাঠিয়ে গুপ্তহত্যা করবেন তাঁদের। এর কারণ হল, দুর্যোধন এখন স্বস্থানে স্বমহিমায় বিরাজমান। আর পাণ্ডবরা এখন স্থানচ্যুত, অসহায়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: স্বপ্নে আমার মনে হল

সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২: রাসসুন্দরী দেবী—বাংলার প্রথম আত্মজীবনী রচয়িতা

এখন বিদুরের নির্দেশমতো পাণ্ডবরা মৃগয়ায় আসক্তির ছলে স্থানটির পথঘাট চিনে নেবেন। আর পলায়নের জন্য গর্ত খননের প্রস্তুতি, সত্বর শুরু করা প্রয়োজন—স্থির করলেন যুধিষ্ঠির। ইতিমধ্যে বিদুরের প্রেরিত এক নিপুণ, খনক এসে খননকার্যের উদ্যোগ নিলেন। বিদুর আগাম খবর পাঠিয়েছেন, আগামী কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন এই ভবনের দুয়ারে দুর্যোধনের আদেশ অনুসারে অগ্নিসংযোগ করবেন পুরোচন। তার লক্ষ্য হল, কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডবদের অগ্নিদহনে বিনাশ। খনক যে বিদুরের বিশ্বস্ত সখা তার প্রমাণ কী? খনক জানাল, ম্লেচ্ছভাষায় যুধিষ্ঠির ও বিদুরের কথোপকথনের তথ্য সে জানে। বিদুর জানিয়েছিলেন, ভবনের দ্বারে দুরাত্মা দুর্যোধনের বিশাল অস্ত্রাগারে অস্ত্রসম্ভার মজুদ রয়েছে।

যুধিষ্ঠির সেই ব্যক্তিকে অনুরোধ জানালেন, তিনি যেন পাণ্ডবদের এই বিপদ থেকে মুক্ত করেন। পরিখা অর্থাৎ ভবন বেষ্টনের প্রাচীরের থেকে মাটি তুলবার ছলে, বিশাল বাসযোগ্য গর্ত খনন করল সেই খনক। সেই সঙ্গে ভবনের মাঝখানে কপাটযুক্ত আরও একটি বড় সুড়ঙ্গ খনন করল সে। সকলের অজ্ঞাতসারে সেই সুড়ঙ্গদ্বারে কপাট লাগিয়ে উপরিভাগে মাটি সমানভাবে বিন্যস্ত করে দিল, খনক। সশস্ত্র পাণ্ডবরা রাতে সেই গর্তে বাস করতেন আর দিনের বেলায় বন বনান্তরে মৃগয়া করে বেড়াতে লাগলেন। তাদের মনে আশঙ্কা, কিন্তু বাইরে নিশ্চিন্ত ভাবটি দেখে সেই খনক ভিন্ন,অন্য কোন নগরবাসী টেরটি পর্যন্ত পাবেন না তাঁদের মনোভাব। পুরোচনের অসততার নিঃশব্দ প্রতিরোধে পাণ্ডবদের ছলনা অব্যাহত ভাবে চলতে থাকল। ইতিমধ্যে ছয়মাস অতিবাহিত হয়েছে।

এইভাবে নিষ্ঠুর পুরোচনের বিশ্বস্ততা অর্জন করা হয়েছে এখন। এইবার পলায়নের উপযুক্ত সময়। ভাইদের এ কথা জানালেন যুধিষ্ঠির। অস্মানয়ং সুবিশ্বস্তান্ বেত্তি পাপঃ পুরোচনঃ। বঞ্চিতোঽয়ং নৃশংসাত্মা কালং মন্যে পলায়নে। এবার পুরোচনের চক্রান্ত প্রতিরোধের পরিকল্পনা অনুযায়ী কুন্তী দেবী ব্রাহ্মণভোজনের আয়োজন করলেন। বহু নারীপুরুষের সমাগম হল সেখানে। এক ব্যাধপত্নী তার পাঁচ পুত্রের সঙ্গে মদ্যপানজনিত মত্ততার কারণে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মৃতবৎ গভীর নিদ্রায় মগ্ন হল সেখানে। নিঝুম নিশিথে বায়ু উদ্দাম বেগে প্রবাহিত হল যখন, যখন পুরোচন গভীর সুখনিদ্রায় আচ্ছন্ন, ঠিক সেইসময়ে ভীম পুরোচনের কক্ষে প্রথম আগুন লাগিয়ে, সেই জতুগৃহের দ্বারদেশেও আগুন ধরিয়ে দিলেন। সমগ্র বাসগৃহ এক নিমেষে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হল। মা কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে, পাণ্ডবরা সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিলেন।

পাণ্ডবদের নির্মম পরিণতির কথা চিন্তা করে বারণাবতবাসীরা দুর্যোধনকে দোষারোপ করলেন, নির্দোষ পাণ্ডবদের পক্ষ নিয়ে রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক্কার জানাতে লাগলেন।পুরোচনের সম্ভাব্য নিধন কল্পনা করে, সেই দুষ্টবুদ্ধি পাপাচারীর বিনাশে, ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানালেন তাঁরা। সেই ক্রন্দনরত বারণাবতবাসীরা জ্বলন্ত গৃহটিকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখলেন সেই রাতে। বিনিদ্র পাণ্ডবরা, মা কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে সকলের অলক্ষ্যে সুড়ঙ্গ থেকে নির্গত হলেন। রাত্রি জাগরণের দরুণ এবং শঙ্কাতুর অবস্থায় তাঁরা দ্রুত পলায়নে অক্ষম, তখন। শুধু নিদ্রাহীন, বেগবান, পবনপুত্র ভীমসেন মা এবং চার ভাইকে বহন করে নিয়ে চললেন। মা কুন্তীকে নিলেন তার কাঁধে, নকুল ও সহদেবকে কোলে, যুধিষ্ঠির অর্জুনকে দুই বাহুতে ধারণ করে, পদাঘাতে মাটি বিদীর্ণ করে, বায়ুবেগে গাছপালা ভেঙে দ্রুত সম্মুখে অগ্রসর হলেন ভীম। বিদুর তাঁদের সুরক্ষার কারণে এক ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিলেন বনে।

বিশ্বস্ত সেই ব্যক্তি, বনমধ্যে প্রবহমানা গঙ্গার জলের গভীরতা পরিমাপরত অবস্থায় পাণ্ডবদের দেখতে পেলেন। মন ও বায়ুর মতো দ্রুতগামী, বায়ুবেগকে সহ্য করতে পারে এমন, পতাকাযুক্ত, যন্ত্রচালিত, গঙ্গা উত্তরণের যোগ্য একখানি সুন্দরভাবে প্রস্তুত নৌকা, সেখানে অপেক্ষমান।সেটি, আগে থেকেই বিশ্বস্ত মানুষ দিয়ে নির্মাণ করিয়েছিলেন বিদুর। সেই নৌকাতে গঙ্গা উত্তীর্ণ হলেন পাণ্ডবরা। বিদুর প্রেরিত ব্যক্তি বিদুরের আশীর্বাদ শোনালেন, অরিষ্টং গচ্ছতাব্যগ্রাঃ পন্থানমিতি চাব্রবীৎ। বিদুর বলেছেন, নির্বিঘ্নে নিঃশঙ্কমনে এগিয়ে চল পথে। পাণ্ডবদের জয়ধ্বনি ও আশীর্বচন উচ্চারণ করে সে বিদায় নিল। যুধিষ্ঠিরের নির্দেশমতো, অবিলম্বে পাণ্ডবদের নিরাপদ উদ্ধারবৃত্তান্ত বিদুরকে অবহিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য। পাণ্ডবরা, সকলের অগোচরে, দ্রুত এগিয়ে চললেন অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পাণ্ডবদের বারণাবতে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা, দুর্যোধন এবং ধৃতরাষ্ট্রের একটি নৃশংস রাজনৈতিক চাল। এই গদিদখলের লড়াই কোন যুগে হয়নি? ক্ষমতার লিপ্সা, নিজের স্বার্থরক্ষায় তার অপব্যবহারের নজির সৃষ্টি করেছেন কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র। কুরুরাজতন্ত্রে তাঁর স্থিতি শুধুমাত্র প্রকৃত রাজার অনুপস্থিতিতে রাজকার্যনির্বাহকমাত্র, আর কিছু নয়। পুত্রের আবদার এবং তাঁর নিজের রাজোচিত গরিমা উপভোগের আন্তরিক লালসা তাঁকে, অনৈতিকভাবে পাণ্ডবদের নির্বাসনপ্রেরণে প্ররোচিত করেছে। মনে কিছুটা হলেও বিবেকবোধ হয়তো অবশিষ্ট ছিল,হাজার হলেও ব্যাসদেবের ঔরসজাত সন্তান তিনি। ভাই পাণ্ডুর উদারতা, মহত্ত্ব তাঁকে এই অনৈতিককাজে বাধা দিয়েছে।কিন্তু আত্যন্তিক পুত্রস্নেহের কাছে হার মেনেছে, বিবেকবোধ, স্নেহমায়া, পিতৃহীন ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতি বাৎসল্যরসের উৎসারণ।

দুর্যোধনের মধ্যে প্রতিহিংসাপরায়ণাতা পিতা ও মাতার কাছ থেকে হয়তো পেয়েছিলেন, আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলে জেনেটিক উত্তরাধিকার, সেটি ছিলই।এমনকি মাতৃসমা দেবী কুন্তীও তাঁর প্রতিহিংসার দহনের লক্ষ্য হয়েছেন। নিষ্ঠুর,দুরাচারী,দুর্যোধন, পিতৃসূত্রে পেয়েছিলেন ক্ষমতার লিপ্সা, আর মা গান্ধারী? যিনি প্রাতঃস্মরণীয়া, তাঁর উদার মানসিকতার কারণে? গান্ধারী কুরুবংশের রাজসিংহাসনের ভাবি উত্তরাধিকারী হিসেবে, কুন্তীর পুত্রলাভের সংবাদ পেয়ে, গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেন শুধুমাত্র প্রবল ঈর্ষায়। ভাবি রাজমাতা হওয়ার গৌরববোধ হারাবেন—একমাত্র সেই কারণে তাঁর এই নিষ্ঠুর প্রচেষ্টা। অভীপ্সিত এবং বৈধ শতপুত্রের জননীর এই গর্ভপাত একটি চরম নৃশংসকীর্তি বললেও হয়তো অত্যুক্তি হয় না।।সময়, তাঁকে এই নীচতা ভুলিয়েছে হয়তো। একদা গর্ভাবস্থায় তাঁর মনের হিংসার ক্ষরণ হয়তো জেনেটিকালি রক্তাক্ত ধ্বংসলীলায় উদ্বুদ্ধ করেছে পুত্রদের। এ সবই অবশ্য এক সাধারণ কথকের অনুমানমাত্র।

বারণাবতকাণ্ডে পাণ্ডবদের মুখ্য পরিত্রাতার ভূমিকায় ছিলেন বিদুর, তাঁর পরিচিতি তিনি ক্ষত্তা (ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্যামাতার মিলনে জাতপুত্র)। ঋষি ব্যাসদেবের আলোকিত উত্তরাধিকারের একমাত্র জীবিত বাহক তিনি।রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় অবতীর্ণ না হয়ে শুভবোধ প্রাণিত কর্ত্তব্যনিষ্ঠায় একজন মন্ত্রীর যেটি করণীয় সেটাই তিনি করেছেন। প্রজাসাধারণের অনুমোদিত, মাননীয়দের স্বীকৃত, ন্যায্যভাবে রাজপদের যোগ্য, আদর্শ ধার্মিক ভাবিরাজার প্রাণরক্ষায় তাঁর নিরন্তর বুদ্ধিদীপ্ত প্রচেষ্টা তাঁকে মহাভারতের একজন, বিশিষ্ট,মহান চরিত্রের মর্যাদা দিয়েছে।

রাজনৈতিক জতুগৃহের প্রদাহ চিরকালই উত্তপ্ত করে পরিমণ্ডল। সাধারণ অসাধারণ নির্বিশেষে সব প্রজাসাধারণ তার বিষময় জ্বালার শিকার হন,অনুভূতিশীল বিশিষ্টদেরতো কথাই নেই। বিদুরদের শুভবোধ,দহনে প্রলেপের কাজ করে। নিরাময়ে দ্রুত সমাধান হল বিদুরদের উদার নীতিবোধ, বিবেকচেতনা। ধারণার্থক ধর্মবোধের মূর্তিমান রূপ, এমন বিদুরের উপস্থিতি হয়তো ভরতবংশীয়দের উত্তরপুরুষদের মধ্যে আজও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content