শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ছবি: সংগৃহীত।
‘প্রথমে সাধু সঙ্গ করতে হয়। সৎসঙ্গ করলে ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা হয়, শ্রদ্ধার পথ নিষ্ঠা। নিষ্ঠায় ঈশ্বর কথা বই আর কিছু শুনতে ভালো লাগে না। স্ত্রীর যেমন স্বামীতে নিষ্ঠা, এই নিষ্ঠা যদি ঈশ্বরেতে হয় তবেই ভক্তি হয়। ভক্তিতে প্রাণ মন একেবারে ঈশ্বরের লীন হয়ে মিশিয়ে যায়। ভক্তি পাকলেই ভাব। ভাব হলে সচ্চিদানন্দকে ভেবে অবাক হয়ে যায়। আবার ভাব পাকলে মহা ভাব প্রেম এইসব হয়। ভাবেতে মানুষ অবাক হয়। আপনি কুম্ভক হয় যখন প্রেমে সচিদানন্দকে বারবার দড়ি পাওয়া যায়। যখন দেখতে চাইবে দড়ি ধরে টানলেই হল। যখনই ডাকবে তখনই পাবে।’ শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বর প্রণিধানের পথ সোজা করে দিয়েছেন। বেদান্ত নির্দেশিত স্মরণ মনন ও নিধিদ্ধ্যাসন সাধন প্রণালী সহজ সরল ভাবে উপস্থাপনা করেছেন। আমারা প্রত্যেকে কোনও না কোনও ভাবে সংসারের সম্পর্কে যুক্ত আছি। সেই সম্পর্ক ভালবাসার ভাব বা টান যখন নিঃস্বার্থ হয়, যখন সেই ভালোবাসা ভগবানের উপর বর্তায় তখন তার আপন থেকেও আপন জনকে ভালোবাসতে পারে। তখন পৃথক সত্তা হারায়।
শ্রীশ্রীমা বলছেন, কারও কাছে প্রত্যাশা রেখো না। তা হলে সবায় কে সমান ভালোবাসাতে পারবে। ভুল তো সকলের হয়, কিন্তু দোষ ত্রুটি সংশোধন করে আপন করে নিতে পারতেন শ্রীশ্রীমা। তিনি সকল জীবের প্রতি সমান মমত্ববোধ রাখতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তবু বেছে, পরীক্ষা করে নিতেন। কিন্তু শ্রীমা কাছে যে আসত সে পরিবর্তিত হয়ে যেত তাঁর স্নেহ ভালোবাসায়।
শ্রীশ্রীমা বলছেন, কারও কাছে প্রত্যাশা রেখো না। তা হলে সবায় কে সমান ভালোবাসাতে পারবে। ভুল তো সকলের হয়, কিন্তু দোষ ত্রুটি সংশোধন করে আপন করে নিতে পারতেন শ্রীশ্রীমা। তিনি সকল জীবের প্রতি সমান মমত্ববোধ রাখতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তবু বেছে, পরীক্ষা করে নিতেন। কিন্তু শ্রীমা কাছে যে আসত সে পরিবর্তিত হয়ে যেত তাঁর স্নেহ ভালোবাসায়।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩৫: ঈশ্বরের নামে সব দোষ কেটে যায়, শুদ্ধতায় ভরে ওঠে মন
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৯: রাজবাড়ির সান্নিধ্যে নারীর উড়ান
“প্রেম হওয়া অনেক দূরের কথা। চৈতন্যদেবের প্রেম হয়েছিল। ঈশ্বরের প্রেম হলে বাইরে জিনিস সব ভুল হয়ে যায়। জগত ভুল হয়ে যায়। নিজের দেহ যে এত প্রিয় তাও ভুল হয়ে যায়।” শ্রীরামকৃষ্ণ স্বকীয় উপলব্ধিতে দেখিয়েছেন প্রেমের পরাকাষ্ঠা। সাধনার সময় বা ভাবমুখে অবস্থানে তাঁর মুহুর্মুহু সমাধি, স্পন্দনহীন ঈশ্বর সুখ অনুভব করা তা প্রেমের নিদর্শন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, “ভক্তি আট রকম জ্ঞানভক্তি, বিধিবাদীর ভক্তি বা বৈধ ভক্তি, প্রেমভক্তি বা রাগ ভক্তি, বিজ্ঞান ভক্তি, শ্রদ্ধা ভক্তি, অহৈতুকি ভক্তি, অর্জিত ভক্তি ও মধুর ভক্তি। ঈশ্বর আছেন এটি জ্ঞানের। গুণকীর্তন, অর্চনা বন্দনা, নিবেদন ইত্যাদি যে সকল কার্য করা যায় তাকে বলে জ্ঞানভক্তি। অথবা কৃষ্ণই সব হয়েছেন তিনি পরমব্রহ্ম, তিনি রাম, তিনি কালি, তিনি শিব, এবং জগত ব্রহ্মাণ্ডে তিনি রয়েছেন এইরূপ জ্ঞানকে জ্ঞানভক্তি বলে। এত জপ করতে হবে, উপবাস করতে হবে, এত উপাচারে পূজা করতে হবে, এসব বৈধ বাধির ভক্তি। এ সব করতে করতে প্রেমভক্তি আসে। বৈধি ভক্তি যেমন হাওয়া পাওয়ার জন্য পাখা রাখা। যখন দক্ষিণে বাতাস বয় তখন আর পাখার আবশ্যক হয় না। যখন সংসার বুদ্ধি একেবারে চলে যায়, ভগবানের প্রতি ষোলো আনা মন হয়, তার উপর পূর্ণ ভালোবাসা হয়, তখনই প্রেম ভক্তি বা রাগ ভক্তি। এই ভক্তিতেই ঈশ্বর দর্শন হয়। ঈশ্বর দর্শনের পর ভক্ত তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে যে সেবা করে তার নাম বিজ্ঞান ভক্তি। শ্রদ্ধা বা নিষ্কাম ভক্তি এই ভক্তিতে নিজের কোনও প্রকার আকাঙ্ক্ষা বা কামনা থাকে না। ভগবানের প্রীতিকর কার্য করা, তার সুখ সম্পাদন আকাঙ্ক্ষা করায় এই ভক্তির উদ্দেশ্য। ধর্মাধর্ম ছাড়লে শুদ্ধা ভক্তি লাভ হয়।”
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৩: মালিকা পরিলে গলে/ প্রতি ফুলে কে-বা মনে রাখে?…
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’
এই ভক্তি বৃন্দাবনের গোপগোপিকাদের ছিল। গোপ শিশুরা যখন কৃষ্ণকে নিয়ে গোচারণ করতে যেত, তারা তখন যাতে কৃষ্ণের কোন কষ্ট না হয়। সেই রূপ করত। আছে কোমল পদকমলে কাঁটা ফুটবে বা শ্রীকৃষ্ণ কষ্ট পান এই জন্য রাখালেরা তাঁকে কাঁধে করে লয়ে বেড়াত। পাছে প্রখর রোদের তাপে কৃষ্ণচন্দ্রের মুখ মণ্ডল আর রক্তিম হয় এই জন্য তাকে গাছের ছায়া ছাড়া অন্য স্থানে যেতে দিত না। যদি একান্তই যেতে হত তাহলে তারা রোদের তাপ নিবারণ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণের মাথার উপর গাছের পাতা ডাল ধরতো। পাছে তিক্ত, কসাই, কটু ফল খেলে কৃষ্ণের কোন রূপ অসুস্থতা হয় এজন্য তারা অগ্রে ফলগুলি আস্বাদন করে সুমিষ্ট সুস্বাদু সুগন্ধযুক্ত ফলগুলি বেছে বেছে কৃষ্ণাকে খেতে দিত। যারা শ্রীকৃষ্ণকে জীবন স্বরূপ জ্ঞান করত ভ্রমণে উপ-বেশনে শয়নে স্বপনে কৃষ্ণ ব্যতীত আর কিছুই জানত না। আপনা ভাবে কৃষ্ণসুখ অনুভব করত তারা। ভগবৎ ভাবের বিস্মরণ হয়ে সখ্য ভাবে আপন করে পাওয়া।
আরও পড়ুন:
যত মত, তত পথ, পর্ব-৪: শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন
একবার দেবর্ষি নারদ শ্রীরামকে, রাবণ বধের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য অযোধ্যায় গমন
করত, সীতা রাম দর্শন করে স্তবস্তূতি করতে আরম্ভ করলেন। রামচন্দ্র স্তবে তুষ্ট হয়ে বর প্রদান করতে চাইলেন। নারদ বললেন—প্রভু যদি একান্ত আমায় বর দেবেন, তবে এই ভয় দিন, যেন আপনার পদে আমার শ্রদ্ধা ভক্তি থাকে আর যেন আপনার ভুবন মোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। শ্রীরামচন্দ্র বললেন, আর কিছু বর লও। নারদ বললেন আর কিছু চাহিনা কেবল চাই আপনার পাদপদ্মে শুদ্ধা ভক্তি। ভগবান মুক্তি দিতে কাতর নয় কিন্তু শুদ্ধা ভক্তি দিতে কাতর হয়। ভক্ত ভক্তিরস আস্বাদন করতে চায়।
করত, সীতা রাম দর্শন করে স্তবস্তূতি করতে আরম্ভ করলেন। রামচন্দ্র স্তবে তুষ্ট হয়ে বর প্রদান করতে চাইলেন। নারদ বললেন—প্রভু যদি একান্ত আমায় বর দেবেন, তবে এই ভয় দিন, যেন আপনার পদে আমার শ্রদ্ধা ভক্তি থাকে আর যেন আপনার ভুবন মোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। শ্রীরামচন্দ্র বললেন, আর কিছু বর লও। নারদ বললেন আর কিছু চাহিনা কেবল চাই আপনার পাদপদ্মে শুদ্ধা ভক্তি। ভগবান মুক্তি দিতে কাতর নয় কিন্তু শুদ্ধা ভক্তি দিতে কাতর হয়। ভক্ত ভক্তিরস আস্বাদন করতে চায়।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।