রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


প্রতীকী ছবি। সৌজন্যে: সত্রাগ্নি।

।। ফ্রেন্ডশিপ কেজি টু পিজি।।

নিজের বোকামির জন্য অনেক বেশি মাশুল দিতে হয়েছে শিবানীকে। যে চুক্তিতে সই করে ড্যান্সারের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যে শিবানী বম্বে ছুটে এসেছিল সেই তিনটে ছবির একটাও হয়নি। প্রাথমিক অগ্রিমটুকু ছাড়া কোনও টাকা পায়নি সে। বম্বেতে ছবির সুযোগ পাওয়ার আনন্দে সেই সই করা চুক্তিপত্রের কোনও কপি তার কাছে নেই। বম্বেতে জুনিয়র আর্টিস্ট বা ড্যান্সারদের ইউনিয়ন খুব শক্তিশালী। কিন্তু তাদের কাছে উপযুক্ত প্রমাণ তুলে না দিতে পারলে লড়াইটা করবে কী করে? মাস্টারজি সে-সব চুক্তির কথা বেমালুম অস্বীকার করছেন। কলকাতায় লোকটাকে দেখে মনে হয়েছিল কত সহজ সহৃদয় মানুষ। শিবানীকে বেটি বলে ডাকতেন। সিংহানিয়ার সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল যে ছবিতে তার ফাইন্যান্স করার কথা সেই ছবির তিনজন প্রযোজকের সঙ্গে সিংহানিয়ার চুক্তির শর্ত মনোমত হয়নি। সিংহানিয়ার যে গল্প নিয়ে ছবি করার কথা ছিল সেটা দিতেও তিনি অস্বীকার করেছেন।

শিবানী ভাবে সদর স্ট্রিটের হোটেলে সে রাতে সিংহানিয়ার কাছে ছবির গল্প তারও শোনা হয়নি। তার বদলে সিংহানিয়া এক নতুন উপন্যাসের পাঠ শুরু করেছিল। তবে প্রথম প্রথম সিংহানিয়া শিবানীর নেশায় মশগুল ছিল। প্রায়ই সোনার দুল গলার হার আংটি এসব প্রেজেন্ট করত। রিজেন্ট পার্কের বাড়ি ভাড়াও সিংহানিয়া দিত। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে। নিজের বৌ আর শালাকে খুব ভয় পেত সে। বম্বে চলে আসার পর প্রথম দিকে ঘনঘন কথা বলেছে শিবানী। একেবারে প্রথম কয়েকমাস কপর্দকহীন হয়ে পড়েছিল। চেনা একজনের হাতে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল সিংহানিয়া। কালো টাকা খাটত তার। তাই ব্যাঙ্কে বা মানি অর্ডারে টাকা পাঠানোর কোন ঝামেলা নিত না। বম্বেতে অসুবিধের কথা জানালে সিংহানিয়া ঠাট্টা করে বলতো, বম্বে শহরটা নাকি নীলার পাথরের মতো। যার সয় তাকে আকাশে তুলে দেয় যার সয় না সে পাতালে তলিয়ে যায়। চেষ্টা করে না পারলে কলকাতায় ফিরে যেতে। কিন্তু শিবানীর জেদ সে তলিয়ে যাবে না। শেষপর্যন্ত লড়াই করবে। “আখরি দম তক”। শিবানী আজকাল বম্বের চালু ঢঙে কথা বলে।

—ছোড়নে কা নাইরে বাবা!! আখরি দম তক লড়নে কা। কোশিস জারি রাখনে কা!

ভাগ্যের “সোনার কাঠির ছোঁয়া” খানিকটা সাবেকি কালের কালীপুজোর রাতে প্রতিযোগিতার তুবড়ির মতো। নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগীরা যাচ্ছে, তুবড়ি বসাচ্ছে। একই রকমের গোলাকার একরাশ সম্ভাবনাময় আলোর ফুলকিতে ঠাসা। সমবেত জনতা একই রকমের সম্ভ্রম নিয়ে তাকে দেখছে। ঠিক তার পিছনে সেই একের পর এক লম্বা বাঁশ বেঁধে বেঁধে অমাবস্যার অন্ধকার চিরে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রেষ্ঠত্বের সুউচ্চ মাপকাঠি। একই সোরা গন্ধক কাঠকয়লার মিশেল অথচ যোগ্যতার মাপকাঠিতে কত আলাদা। কোনও তুবড়ির আলোক ফুলকি এককভাবে দূরত্ব পাড়ি দেয়। সমবেত সৌন্দর্যে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে না। কেউবা অপরূপ সৌন্দর্যে ছড়িয়ে পড়ে অথচ উচ্চতায় সে বড় খাটো।

ঈশ্বরের আশীর্বাদে বা ভাগ্যের সহাস্য প্রকাশে জীবনের পথে আচমকা কপালে শিকে ছিঁড়ে গেল হয়ত… কিন্তু মাঝপথেই দম হারিয়ে গেল, যা হওয়ার লক্ষ্য ছিল তা হয়ে ওঠা হল না। উন্নতির পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। এ বার ঘরমুখো হতে হবে। তবে শিবানী জেদি শিবানী একরোখা তাই সে ঘরের দাঁড়ে ফেরেনি। একঘাট থেকে অন্যঘাটে নাও ভিড়িয়েছে।

নিজের জীবনটাকে নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে এগিয়েছে সানন্দা। অর্ককে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল নিজের সিদ্ধান্তে। সেই অর্কের সঙ্গে বিয়ে ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত তার একার, নিজের। আমাকে বাবাকে বা মাকে সানন্দা এর মধ্যে জড়ায়নি। যতদিন নিজের বাড়ি হয়নি ততদিন হোটেলে থেকেছে। বসুন্ধরা ভিলায় এসে ঘুরে গেছে কিন্তু রাত কাটায় নি।অর্কর সঙ্গে বিয়ে হবার পর বছর দুয়েক দিগন্তর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। নিউইয়র্ক টাইমস-এর আঠারো মাসের একটা ট্রেনিংয়ে জে-ওয়ান এক্সচেঞ্জ ভিসা নিয়ে দিগন্ত আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-২৮: থাকার জায়গা ছিল টানা-বারান্দার সার সার ঘরে, বম্বেতে যাকে বলে চাল

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

শ্রীতমা বলেছিল নিজেকে কলকাতা থেকে সরিয়ে নিতেই দিগন্ত এটা করেছে। এমনই কাকতালীয় যোগাযোগ সানন্দার সঙ্গে অর্কর যখন ডিভোর্সের মামলা চলছে তখন দিগন্ত কলকাতা ফিরে এল। শ্রীতমার কাছে দিগন্তের ফেরার কথা শুনে আমাদের ঘর থেকেই দিগন্তকে ফোনে যোগাযোগ করল সানন্দা। তাকে জানিয়ে দিল ডিভোর্সের মামলাটা যতদিন না মিটছে ততদিন যেন দিগন্ত সানন্দার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ না করে। কারণ প্রাথমিক ভাবে চেঁচামেচি করলেও অর্ক তার সামাজিক কারণেই সানন্দাকে ডিভোর্সটা দিতে চায় না। সানন্দার অ্যাডভোকেট তাকে ডিভোর্স পাওয়ার ছকে বাধা অভিযোগ আনতে বলেছিল। সানন্দার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, তার সঙ্গে ক্রমাগত দূর্ব্যবহার বা এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স। সানন্দা সরাসরি না বলে দিয়েছে। সে বলেছে যেটা সত্যি সেটাই লিখুন।
আরও পড়ুন:

পাখি সব করে রব, পর্ব-১: সবুজ সুন্দরী মুনিয়া

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮: সুন্দরবনের নিশ্চিহ্ন প্রাণী

ডাক্তার হিসেবে যে মানুষটার কোনও এথিক্স নেই কোনও নীতিবোধ নেই, সামাজিক দায়িত্ববোধ নেই তার সঙ্গে সে থাকতে চায় না। যাতে অল্প কোনওরকম সুযোগ না পায় তাই সে দিগন্তকে যোগাযোগ করতে মানা করেছে। অর্কপ্রভ এর মধ্যে আমার সঙ্গে দু তিনবার ফোনে যোগাযোগ করেছে। বলার চেষ্টা করেছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য মতবিরোধ হয়ে থাকে আমি দাদা হিসেবে সানন্দাকে যেন একটু বোঝাই। আমি কথা না বাড়িয়ে বলেছিলাম চেষ্টা করব। পরে ফোন করায় বুঝিয়েছি আমি চেষ্টা করেছিলাম সানন্দা মানতে রাজি নয়। এ ভাবে ভাঙা সম্পর্ককে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করা বৃথা।
সানন্দা আর অর্কপ্রভ’র মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে গেল। এর বেশ কিছুদিন পর আমি শ্রীতমাকে বললাম —

—তোমার সঙ্গে সানন্দা দিগন্ত দু’ জনের টার্মস খুব ভালো। দেখো না কথা বলে যদি ওরা দু’ জনে আবার নতুন করে শুরু করে।
—দেখি কথা বলে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১০: আমাদের কোনও শাখা নেই

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ

শ্রীতমা পারেনি। দিগন্ত তখনও রাজি ছিল। রাজি নয় সানন্দা। সানন্দা আর দিগন্তকে নিয়ে শ্রীতমা কলকাতার এক নামী কফি শপে গিয়েছিল। কথাটা তুলতেই দিগন্ত বাধা দিয়ে বলেছিল—

—এসব থাক না শ্রীতমাদি।

সানন্দা নাকি দুম করে বলে উঠলো—

—থাকবে কেন? ব্যাপারটা নিয়ে তোর আমার একটা ক্লিয়ার কাট ধারণা থাকা উচিত। কথাটা বৌমণির সামনে হলে বসুন্ধরা ভিলার কাছেও ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। আমি আর দিগন্ত। আমরা কেজি থেকে বন্ধু প্রায় পিজি পর্যন্ত। প্রায় বলছি এই কারণে যে থার্ড ইয়ারের পর আমার আর অর্কর প্রেম হবার কথা শুনে দিগন্ত নিজেকে আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে নিল। ভালোই করেছিল, প্রেমিক বর হল। সেই তখন প্রায়োরিটি সেই তখন প্রেফারেন্স। সেই বা কেন প্রেমিকার কেজি ফ্রেন্ডশিপকে পাত্তা দেবে। আমার ডায়াগনোসিস করতে ভুল হয়েছিল, ম্যারেজ এক্সপায়ার্ড। আর বাবার লেখা গল্পের মতো ঠিক এখনই তুই ইউএসএ থেকে ফিরে এলি। এরপর তোর আমার বিয়েটা হলে গপ্পো সুপার হিট। কিন্তু সরি বস! বিয়ের চক্করে আর আমাদের কেজি টু পিজি বন্ধুত্বে কিছুতেই কালি লাগতে দেব না। এই বেশ ভালো আছি। তোর যদি বিয়ে করার ইচ্ছা হয় কাউকে করিস আমার কোনও আপত্তি নেই। স্বার্থপর বলিস আর যাই বলিস আমি চাইবো তুইও বিয়ে করলি না আমিও করলাম না বন্ধু হয়ে থেকে গেলাম।

শ্রীতমা দিগন্ত দু’ জনেই সানন্দার কথা শুনে মুখে আর কোন ভাষা খুঁজে পায়নি। ওরা বন্ধু হয়েই রয়েছে। দূর দূর গ্রামে গিয়ে কাজ করছে। বস্তিতে মেডিকেল ক্যাম্প করছে। নাইট স্কুল চালু করেছে। জীবনটাকে এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে ওরা দু’জন।

আর অন্যদিকে আরব সাগরের পাড়ে অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকতে ক্রমাগত যুদ্ধ করেছে শিবানী। নিজের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেযুদ্ধ করেছে। একেবারে অচেনা এই পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছে।

এখন আর ট্যাক্সিতে স্টুডিয়োতে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না শিবানী। কিছুটা বাসে কিছুটা হেঁটে কিছুটা ট্রেনে এভাবেই প্রতিদিন গন্তব্যে পৌঁছয়। কাজ থাকলে যায় না থাকলে যায় না। রোজগার না হলেও গাড়িভাড়াটা তো বাঁচে। বাসে করে যেতে যেতে, স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে একা একা মাঝে মাঝে নিজেকে কাঠগড়ায় তুলে নিজেই জেরা শুরু করে।—চলবে।

মুম্বই ফিল্ম শুটিং। ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩০

লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল জুটির চিরনতুন কম্পোজিশন। না চাহুঁ সোনা চাঁদি…। গোলাপি ব্লাউজ পরেছিল শিবানী। সেকেন্ড রোতে নাচছিল। সিনেমা হলে দেখতে গিয়ে নিজেই নিজেকে খুঁজে পায়নি। ঝুট বোলে কাউয়া কাটে নাচটায় ডিম্পলের সঙ্গে ক্যামেরা ট্রলি হচ্ছিল। এক ঝলকের জন্য গোলাপি ব্লাউজ পরা শিবানীকে দেখা গেলেও ক্যামেরা যখন স্টেডি হল তখন শিবানী আউট অফ ফ্রেম।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content