শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

দমনকের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসায় সিংহ পিঙ্গলক তখন রীতিমত আপ্লুত। সঠিকভাবে নির্মিত নির্দোষ এবং সুপরিক্ষিত স্তম্ভ যেমন একটি বিশাল মন্দিরকে ভালোভাবে ধরে রাখতে পারে, নির্দোষ মন্ত্রীরাও সেইরকম রাজ্যভার নিজেদের স্কন্ধে গ্রহণ করতে পারে। পিঙ্গলক বললেন, হে দমনক! আপনি যথার্থই একজন সুমন্ত্রী। আপনার প্রত্যুত্পন্নপতিত্বে আমি প্রসন্ন। কারণ শাস্ত্রেও বলে, শত্রুরাজার সঙ্গে সন্ধি করাবার সময়েই মন্ত্রীদের সঠিকভাবে চেনা যায়। তাঁদের পরামর্শে রাজা, রাজ্য এবং প্রজাদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষা পেতে পারে— মন্ত্রীদের পরীক্ষা হয়ে যায় সেখানেই। তেমনই ভাবে সান্নিপাতিক রোগে যখন বায়ু, পিত্ত ও কফ একসঙ্গে কুপিত হয়, তখন চেনা যায় প্রকৃত চিকিত্সককে। যাঁর সুচিকিত্সায় রোগী ভালো হয়ে ওঠেন।

রাজা যখন শত্রুহীন অবস্থায় নিশ্চিন্তে রাজ্যশাসন করেন বা মানুষ যদি রোগগ্রস্ত না থাকেন, তখন মন্ত্রী বলুন বা চিকিত্সক সকলকেই বাইরে থেকে দেখে পণ্ডিত মনে হয়। কারণ তখন তাঁদের সেই অর্থে তেমন কোনও কাজই থাকে না। কাজে নামলে বোঝা যায়, কার কেমন প্রজ্ঞা। তাই হে দমনক! আপনি কর্মের মাধ্যমে আপনার প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তাই আমি আজ প্রসন্ন।

দমনকও রাজাকে প্রণাম করে মনের আনন্দে সঞ্জীবকের কাছে যেতে যেতে চিন্তা করলেন, সত্যিই আমার থেকে ধন্যতর আর কেই বা আছে? স্বামী আমার উপর এখন প্রসন্ন এবং সম্পূর্ণভাবে আমার বশে—এখন আমি যা বলবো তিনি তাই করবেন। পণ্ডিতরা বলেন, শীতের রাত্রে আগুনের তাপকে যেমন অমৃত-সমান মনে হয়; পছন্দের লোককে সামনে দেখলে যেমন ভালো লাগে, রাজার কাছ থেকে পাওয়া সম্মানও তেমনই; খিদের পেটে ক্ষীর ভোজনের মতো তা অমৃততূল্য।

এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই দমনক সঞ্জীবকের কাছে এসে বলল—ওহে মিত্র! আপনার জন্য স্বামী পিঙ্গলকের কাছ থেকে অভয়দানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছি। তিনি আপনার কোনও ক্ষতি করবেন না বলে কথা দিয়েছেন। তাই নিশ্চিন্তে আপনি এবার তাঁর কাছে আসতে পারেন। কিন্তু আপনি আবার রাজকৃপা পেয়ে আমাকে ভুলে যাবেন না। রাজশক্তি ভোগ করে অধিকাংশ সময়েই লোকে অন্য মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তাই আমার সঙ্গে যাতে আপনার বিরোধিতা না হয় সেটাও খেয়াল রাখবেন—আমার স্বার্থে আবার আঘাত আনবেন না। “মযা সহ সমযধর্মেণ বর্তিতব্যম্‌”—আমার সঙ্গে এ চুক্তি আপনাকে করতে হবে। তাহলেই একমাত্র ভবিষ্যতে নির্বিরোধে আমরা একসঙ্গে রাজলক্ষ্মীকে ভোগ করতে পারব।

ব্যাপারটা খেয়াল করুন—রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের এই চরিত্রটা কিন্তু চিরকালীন। মানেটা হল, আপনাকে রাজকার্যে একটা ব্যবস্থা করে দিলাম। তাই বলে আমাকে আবার ভুলে গেলে চলবে না, আমার যেন রাজসম্পদ ভোগ করতে কোনও রকম অসুবিধা না হয়; তখন যেন আবার বিরোধীতা করে বসবেন না। দমনক কূটনীতিশাস্ত্রের শ্লোক আওড়ায়—

আখেটস্য ধর্মেণ বিভবাঃ স্যুর্বশে নৃণাম্‌।
নৃপ্রজাঃ প্রেরযত্যেকো হন্ত্যন্যোঽত্র মৃগানিব।। (মিত্রভেদ, ১৪০)


অর্থাৎ “আখেট-ধর্ম” মানে শিকার করবার প্রণালীর মাধ্যমেই সমস্ত সম্পদ মানুষের অধীনে আসতে পারে। এই শিকার করবার প্রণালীটা দুই ধরণের—কেউ কেউ লোকজন জুটিয়ে জঙ্গলে ঢুকে নানা রকম বাদ্য বাজিয়ে সমস্ত জন্তুদের এক জায়গায় করে মনের সুখে শিকার করেন। আবার কেউ কেউ পশু খুঁজে খুঁজে শিকার করেন। আপনিও পিঙ্গলকের সঙ্গে এমনভাবে মন্ত্রণা করুন যাতে সমস্ত রাজকার্য একসঙ্গে আমার আয়ত্তাধীন হয়, আর আমিও যাতে প্রজাদের শোষণ করে বিপুল অর্থ রোজগার করতে পারি; যা দিয়ে আমি আর আপনি দু’ জনেই সুখে দিন যাপন করবো। রাজার সান্নিধ্য লোকে চায়ও এই কারণেই। আর জানেন তো ভাই পণ্ডিতরা কী বলেন? তাঁরা বলেন—

যো ন পূজযতে গর্বাদুত্তমাধমমধ্যমান্‌।
ভূপসংমানমান্যোঽপি ভশ্যতে দন্তিলো যথা।। (ঐ, ১৪১)


মানেটা হল—নিজের পদমর্যাদার অভিমানে যে লোক নিজের থেকে উত্তম কিংবা মধ্যম বা অধম শ্রেণির বিভিন্ন রকম লোকেদের সঙ্গে সম্মান দিয়ে কথা বলে না রাজা তাঁকে বহু সম্মান করলেও সে লোকের অবস্থা কিন্তু দন্তিলের মতো হয়।

সঞ্জীবক জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপারটা কেমন?

দমনক বলতে শুরু করলেন—
 

০৩: রাজা, দন্তিল আর গোরম্ভের গল্প

আমাদের এ ধরাতলেই বর্ধমান বলে একটি নগরে দন্তিল নামে একজন রাজকর্মচারী থাকতেন। তিনি রাজার কোষাধ্যক্ষ হলেও বংশ পরম্পরায় তাঁদের পরিবার ছিল ধনী ও সম্ভ্রান্ত। স্বভাবেও ছিলেন তিনি বিনয়ী—নগরে পুরনায়কের মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। রাজকার্য তিনি এতোটাই সুনিপুণভাবে পরিচালনা করতেন যে রাজা এবং সেইসঙ্গে সে নগরের অধিবাসীরা সকলেই তাঁকে পছন্দ করতেন। তবে রাজা এবং প্রজা—দু’ জনকেই এভাবে খুশি রাখাটা কিন্তু নেহাৎ সহজ কথা নয়। একমাত্র বুদ্ধিমান সুচতুর ব্যক্তিই এটা পারেন। পঞ্চতন্ত্রকার বলছেন, দন্তিলের মতন এই রকম চতুর লোক আগে কেউ দেখেওনি শোনেওনি; কারণ—

নরপতিহিতকর্তা দ্বেষ্যতাং যাতি লোকে
জনপদহিতকর্তা ত্যজ্যতে পার্থিবেন্দ্রৈঃ।
ইতি মহতি বিরোধং বর্তমানে সমানে
নৃপতিজনপদানাং দুর্লভঃ কার্যকর্তা।। (ঐ, ১৪২)


যিনি রাজার ভালো চান জনগণ সাধারণত তাঁকে পছন্দ করেন না মোটেই। কারণ রাজা শুধু ছলে বলে আর কৌশলে বিভিন্ন রকম কর বসিয়ে প্রজার ধন হরণ করতে চায় মাত্র। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাজার উন্নতিকামনায় যিনি নিযুক্ত থাকেন, তিনি যে জনপদবাসীর বিদ্বেষের পাত্র হবেন—এতে কোনও সন্দেহ নেই। আবার জনগণের স্বার্থ যিনি দেখেন, রাজা তাঁকেও বিষ নজরে দেখেন এবং এইটা স্বাভাবিকও বটে। কারণ, যে ব্যক্তি রাজার জনহিতবিরোধী কার্য-কলাপকে সর্বদা সমালোচনা করেন, যিনি রাজার সমস্ত রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, জনগণ তাঁকে মাথায় করে রাখলেও রাজা যে তাঁকে পছন্দ করবেন না এতে আর সংশয়ের কী আছে? রাজনীতিজ্ঞরা বলেন, জনগণ যাঁকে পছন্দ করেন আর রাজা যাঁকে পছন্দ করেন—এ দুই মানুষের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। কিন্তু রাজা ও প্রজা—উভয়পক্ষের কাছেই যিনি প্রিয়, সেই দন্তিলের মতো মানুষ এ জগতে দুর্লভ।

আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৫: রাজা যে কখন, কার উপর, কী কারণে সদয় হন সেটা জানা সত্যিই দুষ্কর

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…

দিন কেটে যাচ্ছিল এ ভাবেই। এরপর কোনও এক সময়ে দন্তিলের বিবাহ স্থির হয়। বিবাহোত্সবের সেই প্রীতিভোজে সমস্ত নগরবাসী এবং রাজকার্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা সমস্ত কর্মচারীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। সেখানে সেদিন সকলকে সসম্মানে ভোজন করিয়ে, প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে বস্ত্রাদি উপহার দিয়ে অতিথি সত্কারে ব্যস্ত ছিলেন স্বয়ং দন্তিল। বিবাহানুষ্ঠান সম্পন্ন হলে তিনি যখন রাজাকে স্বয়ং অন্তঃপুরে নিয়ে এসে আলাদা করে অতিথি সত্কারে ব্যস্ত ছিলেন তখন রাজার সঙ্গে আসা রাজবাড়ির ‘গৃহসম্মার্জন কর্তা’, মানে সহজ ভাষায় যাকে আমরা ঝাড়ুদার বলি, সেই গোরম্ভও সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হল, রাজার খাওয়া-দাওয়ার জন্য যে আসনটি সুসজ্জিত করা হয়েছিল, কথা নেই বার্তা নেই, রাজা সেখানে এসে উপস্থিত হওয়ার আগেই গোরম্ভ গিয়ে গুছিয়ে সেই আসনটিতে বেশ আরাম করে বসে পড়েছিল। রাজার খাওয়া-দাওয়ার সব ব্যবস্থা ঠিক-ঠাক আছে কিনা সে সব পর্যবেক্ষণ করতে দন্তিল যখন ভোজনালয়ে প্রবেশ করল, তখন সে দেখল যে রাজার আসনে রাজার সেই ঝাড়ুদার গোরম্ভ বসে আছে। তাকে এ ভাবে রাজাসনে বসে থাকতে দেখেই দন্তিল রেগে গিয়ে অর্ধচন্দ্র মানে গলাধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে উঠিয়ে দেয়। গোরম্ভ সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে সারাটা রাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও দু’ চোখের পাতা এক করতে পারলো না।

সারাটা রাত ধরে সে শুধু চিন্তা করতে লাগল যে কীভাবে সেই দন্তিলকে অপদস্ত করা যায়। যে রাজশক্তির সান্নিধ্যে আসার কারণে দন্তিলের এতটা দম্ভ, সেই রাজশক্তির উত্সটা কীভাবে নষ্ট করে দেওয়া যায় বা কী করে রাজবাড়ির চাকরিটা থেকে তাকে বরখাস্ত করা যায়—সেইসব নিয়েই সে সারাটা রাত ধরে চিন্তা করতে থাকে। একমাত্র সেই দন্তিলকে রাজার কাছে ছোট প্রমাণ করতে পারলে তবেই রাজা তাকে উপেক্ষা করবেন এবং রাজসহায়ের অভাবে সেই দম্ভটিও ধ্বংস হবে তার।

এই সব ভাবতে ভাবতে কোনও কূল-কিনারা না পেয়ে রাত্রির শেষ প্রহরে এসে সে হতাশ ভাবল, এই সব ভেবে ভেবে অকারণে শরীর খারাপ করে কী লাভ? আমার মতো একজন সামান্য কর্মচারী তার কিই বা ক্ষতি করতে পারবে? পণ্ডিতরা বলেন—

যো হ্যপকর্তুমশক্তঃ কুপ্যতি কিমসৌ নরোঽত্র নির্লজ্জঃ।
উত্পত্তিতোঽপি হি চণকঃ শক্তঃ কিং ভ্রাষ্টকং ভঙ্‌ক্তুম্‌।। (ঐ, ১৪৩)


অর্থাৎ যে মানুষের অন্যকে ক্ষতি করবার ক্ষমতাটুকুও নেই অথচ তার উপর মনে মনে কেবল ক্রোধ প্রকাশ করেই স্বয়ং অসুস্থ হয়, তাকে কেবল নির্লজ্জ মানুষ বলাটাও সাজে না; সে তার থেকেও ক্ষুদ্র। একটা সামন্য চণক বা ছোলার মতো। সেই সামান্য একটা ছোলা ছুঁড়ে কি আর একটা বড় ভাঁড় ভাঙা সম্ভব? তাই আমার মতো সামান্য লোক এমন একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর কীই বা ক্ষতি করতে পারে?
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২২: পঞ্চমের সুরে কিশোর-আশার গাওয়া ‘জীবন কে হার মোড় পে’ গানটির কথা মনে পড়ে?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৬: ঈল মাছের এই রহস্য নিশ্চয়ই একদিন উদঘাটন হবে

এই সব ভাবতে ভাবতে সেদিনটা কেটে গেল। দিন কয়েক বাদে একদিন সকালে রাজা যখন আধঘুমের মধ্যে ছিলেন, রাজার বিছানার পাশে ধোয়া-মোছা করতে করতে সেই গোরম্ভ ইচ্ছে করেই বলল, “অহো! দন্তিলস্য মহদ্‌ দৃপ্তত্বং যদ্রাজমহিষীমালিঙ্গতি”— রাজার উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়ে দন্তিলের কী সাহসটাই না বেড়েছে, ইদানীং আবার রাজমহিষীকে আলিঙ্গন করছে। কথাটা যাতে ঠিক রাজার কানে যায়, গোরম্ভ কিন্তু সেই ভাবেই বলেছিল। এই ভোরে রাজা যে সাধারণত জেগেই থাকেন এটা সে জানে। এতদিন ধরে রাজবাড়ির যে ‘গৃহসম্মার্জন কর্তা’, তার কাছে রাজবাড়ির সব লোকের জীবনযাত্রার খবর থাকে। তাই এই ভোরে রাজার নিদ্রাভঙ্গ হয়ে গেলেও তিনি যে এসময়ে একটু চোখ বুঁজেই থাকেন এটা গোরম্ভ জানে; আর জানে বলেই ঠিক সেই সময়ে এসেই এই কথাটি সে আধোঘুমের মধ্যে থাকা রাজার কাছে এসে বলল।

রাজা ধরফরিয়ে উঠে রীতিমত চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ভো! ভো! গোরম্ভ! সত্যমেতৎ; যস্ত্বযা জল্পিতম্‌? কিং দেবী দন্তিলেন সমালিঙ্গিতা?”—ওহে গোরম্ভ! তুমি যা বলছ সেটা কি সত্যি? দন্তিল কি সত্যিই রাজমহিষীকে আলিঙ্গন করেছেন?

এ বার গোরম্ভ কূট খেলাটা খেলল। বলল— “দেব! রাত্রিজাগরণেন দ্যুতাসক্তস্য মে বলান্নিদ্রা সমাযাতা। তন্ন বেদ্মি কিং মযাভিহিতম্‌”—হে রাজন্‌! আমি রাত জেগে জুয়া খেলি, সকালের দিকে মধ্যে মধ্যে হঠাৎ করে চোখ লেগে যায় রোজ। ঘুমের মধ্যে কী যে সব বলে ফেলি নিজেই জানি না।

গোরম্ভের কথায় রাজা কিন্তু বেশ সতর্ক হলেন এবং ঈর্ষাও হল দন্তিলের উপর। সম্ভ্রান্ত দন্তিলের চেহারাটি নায়কজনোচিত, তার উপর সমস্ত নগরে সে বেশ জনপ্রিয়; সকলেই তাঁকে পছন্দ করে। হতেও পারে রাজমহিষীকেও হয়তো সে আকর্ষিত করেছে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে রাজমহিষী বা দন্তিল কাউকেই যেহেতু এখন কিছুই বলা যাবে না তাই রাজা স্থির করলেন, দন্তিল যেভাবে স্বচ্ছন্দে রাজন্তঃপুরে প্রবেশ করে রাজার সঙ্গে যখন-তখন দেখা করবার সুবিধা পেতেন, সেটাকে এখনই খর্ব করতে হবে। এই গোরম্ভ নিশ্চয় কখনও দন্তিলকে দেখেছে রাজমহিষীকে আলিঙ্গন করতে। কারণ স্বপ্নতত্ত্ববিদ্‌রা বলেন—

যদ্বাঞ্চতি দিবা মর্ত্যো বীক্ষতে বা করোতি বা।
তত্স্বপ্নেঽপি তদভ্যাসাদ্‌ ব্রূতে বাঽথ করোতি বা।।


অর্থাৎ দিনের আলোয় সকালবেলা যা কিছু মানুষ কামনা করে, দেখে বা শোনে, রাত্রে স্বপ্নালোকের মাঝে সে সব কথাই তার মুখ থেকে অনর্গল বেরিয়ে আসে। মানুষের মনের ভাব, সে ভালো হোক বা মন্দ হোক, সেটা সযত্নে মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও রাত্রে স্বপ্নবাক্যের মধ্যে সে সবই প্রকাশিত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

ত্বকের পরিচর্যায়: টানটান ত্বক চাই? বয়স ধরে রাখতে মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৯: যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু

পাঠকদেরকে এই বিষয়টাতে এবার একটু নজর দিতে বলব। কাউকে যদি কারোর চোখে খারাপ প্রমাণ করতে হয় বা রাজনৈতিক মঞ্চে সহজেই অপদস্ত করতে হয়, তাহলে সহজ পন্থাটি হল তার একটা দুর্নাম রটিয়ে দেওয়া; সোজা কথায় তার খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করে দিতে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথাটা হল এটা করাটাও খুব কঠিন কিছু নয়। মানুষের মনে সন্দেহ বা অন্যের সম্পর্কে দুর্নাম রটিয়ে দেওয়াটা খুব সহজ।

ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে বোঝালে বুঝতে সহজ হবে। ধরুন আপনার প্রতিবেশী সুদর্শনবাবু, যাঁকে আপনি নিত্য দেখছেন। কেউ যদি আপনাকে এসে বলেন যে, সুদর্শনবাবুর এক প্রেয়সী আছেন যিনি অমুক জায়গায় থাকেন। মাঝে-মধ্যেই তাঁরা দীঘা-মন্দারমণি বেড়াতে যান। তাহলে কিন্তু কথাটা আপনি একবারে বিশ্বাস করে নেবেন। আপনার মনের মধ্যে একবারও ঘটনাটা সত্য কিনা সেটা যাচাই করে দেখবার কথা মনেই হবে না। তার উপর কেউ যদি এসে বলে যে, আপনার স্ত্রীকে তো প্রায়ই দুপুরে সুদর্শনবাবুর সঙ্গে সিনেমা হলের আশেপাশে বা নিউমার্কেট এলাকায় দেখতে পাই। তখন বলুন তো, আপনার মানসিক অবস্থাটা ঠিক কেমন হবে?

আপনিও কিন্তু সেই ব্যক্তির কথাটাকেই আগে বিশ্বাস করবেন। পরে হয়তো প্রমাণ খোঁজবার চেষ্টা করবেন কিংবা নাও করতে পারেন। কিন্তু সবার আগে যেটা করবেন সেটা হল সেই বর্ধমান নগরের রাজার মতো আপনিও সুদর্শনবাবুকে উপেক্ষা করবেন এবং তাঁকে নিশ্চয়ই আর ঘরে ঢুকতেও দেবেন না। এটাই স্বাভাবিক, এইটাই মনুষ্যচরিত্র। যে কোনও মানুষকে ছোট করতে গেলে, একটা নারীঘটিত বিষয়ের সঙ্গে তাঁকে জড়িয়ে দিয়ে শুধু একটা বদনাম রটিয়ে দিতে হয় মাত্র।

মানুষ সত্য মিথ্যে খুঁজে দেখে না। সহজেই যে কোন কেচ্ছাকে মানুষ বিশ্বাস করে। রাজাও কিন্তু তেমনটাই করলেন —গোরম্ভের মতো সামান্য এক ঝাড়ুদারের কথায় বিনা প্রমাণেই এতদিনের বিশ্বস্ত এবং সুযোগ্য কর্মচারী দন্তিলকে অবিশ্বাস করলেন। সেই সঙ্গে রাজন্তঃপুরে তাঁর যাতায়াতকেও নিয়ন্ত্রণ করলেন। গোরম্ভও ঠিক এইটাই চেয়েছিল—যাতে সে রাজার সুনজরে আর না থাকে।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content