শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


সরলা দেবী চৌধুরাণী।

কবিপক্ষ চলছে। তাই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের ছুঁয়ে দিই কলম দিয়ে। একাল সেকাল যেন স্বপ্নের দাঁড়িপাল্লার দুইটি ভাগ। মধ্যে শুধু বিস্ময়। সেকালের মহিলা লেখকদের নিয়ে আলোচনার সময় সরলাদেবীকে বাদ দেওয়া যায় না একেবারেই। সেই সময় স্বর্ণকুমারদেবী লেখক সমাজে এক চর্চিত নাম। তাঁরই কন্যা সরলাদেবী। মা ও মেয়ের ভাবনার মিল না থাকলেও কলমের জোরে বেশ তাজ্জব হতে হয়। আজ সেই লেখকের গল্প বলি।

ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিয়ে করে অনেক ব্রাহ্মণ যুবকদের ত্যাজ্যপুত্র হতে হয়েছিল। কারণ ঠাকুরবাড়ি ছিল পিরালী ব্রাহ্মণ। তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়লে জাতিচ্যুত হতে হয়— এমনটাই ছিল বিশ্বাস। ফলে ঠাকুরবাড়ির বেশিরভাগ মেয়েই পরিবার-সহ ঠাকুরবাড়িতেই থাকতেন। ব্যতিক্রম ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তাঁর স্বামী জানকীনাথ ঘোষালকেও স্বগৃহ থেকে ত্যাজ্য তকমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ এবং স্বকীয়তার কারণে বিয়ের আগে দেবেন্দ্রনাথের কথা মতো ব্রাহ্মধর্মও গ্রহণ করেননি। আবার স্ত্রীকে নিয়ে ঠাকুরবাড়িতেও থাকেননি।
স্বর্ণকুমারীও সরস্বতীর বরপুত্রী ছিলেন। কলম আর শব্দ —এই দুই ছিল তাঁর সারাজীবনের সঙ্গী। এমন দুই দৃপ্ত মানুষের সন্তান সরলা দেবী। বাবার আত্মমর্যাদাবোধ, স্বকীয়তা আর মায়ের শিল্পী মন উত্তরাধিকার সূত্রে এই দুই-ই পেয়েছিলেন তিনি। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ থাকলেও, রবীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করলেও নিজের বক্তব্যকে সারাজীবন জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন সরলা দেবী। হতে পারে ছেলেবেলার একাকিত্ব তাঁকে নিজের মতো হয়ে ওঠার অবকাশ দিয়েছিল। মায়ের সাহচর্য তেমন না পেয়ে দাসির কাছেই শৈশবের অনেক মুহূর্ত কেটেছে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

‘জীবনের ঝরাপাতা’য় পরে মা সম্পর্কে লিখেছিলেন সরলা দেবী, ‘তিনি আমাদের অগম্য রাণীর মতো দূরে দূরে থাকতেন।’ রক্ষিণী দাসীর অতিশাসন তাঁর ছোটবেলায় রীতিমতো বিভীষিকা ছিল। সেই সব মুহূর্ত পেরিয়ে বেথুন স্কুলের ছাত্রী হলেন সরলা দেবী। একেবারে বিএ পাশ করে বেথুন থেকে বেরোলেন। সেই আমলে এ বড় কম কথা নয়। ছোটবেলা থেকেই গানে খুব দখল ছিল তাঁর। পিয়ানো বাজাতেন বড্ড ভালো। বারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পিয়ানোতে প্রকাশ করে সকলকে অবাক করে দিয়েছিলেন সরলা। অনেক বাউল গান সরলার কন্ঠে শুনে রবীন্দ্রনাথ সেই সুর ভেঙে নতুন করে গান রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গানগুলির মধ্যে ‘কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘আমার সোনার বাংলা’ এইসব গান উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

সরলার সাহিত্যের রুচিও তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। থিয়োসফি চর্চায় খুব উৎসাহ ছিল সরলার। অতিলৌকিক সব কিছুই বারবার আকৃষ্ট করেছে সরলাকে। সেই কারণেই ব্রাহ্মদের মতো সম্পূর্ণ নিরাকারবাদী হতে পারেননি তিনি। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতগুলি কেবলমাত্র নিরাকার ব্রহ্মকে ভেবেই লেখা কিনা, এই বিষয়েও প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। আবার রবিমামার জন্মদিনের প্রথম উদ্যোগ এই সরলা দেবীরই নেওয়া। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে খুব শ্রদ্ধা করতেন সরলা দেবী। নিজেও বিপুল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সারাজীবন, আর আধুনিক মনস্ক যেকোনও মেয়ের কাছে নত হয়েছেন সরলাদেবী। শান্তিনিকেতনে গিয়ে যেন তাঁকে লেখা পেয়ে বসল। ‘সখা’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন নিয়মিত। এরপর ‘বালক’, ‘ভারতী’ ইত্যাদি পত্রিকাতেও লেখা বেরোলো। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিলেন সরলা। সংস্কৃত সাহিত্যের উপর লিখেছিলেন অনেক প্রবন্ধ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ

একটা সময় সরলা ঠিক করে নিয়েছিলেন অবিবাহিত থাকার। জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর বিয়ে তলোয়ারের সঙ্গে দিয়ে তাঁকে দেশের কাজে নিয়োজিত হতে বলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মায়ের একান্ত ইচ্ছায় আর দিদির উদ্যোগে সরলা দেবীর বিয়ে হয় পাঞ্জাবী সংস্কারক রামভজ চৌধুরীর সঙ্গে। লাহোরে ছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ি। তাঁর স্বামী উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু সরলা দেবী জীবনের একটি পর্বে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। গান্ধীজি লাহোরে এসে সরলার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। দাম্পত্যজীবনের পরিসমাপ্তি হয় রামভজ চৌধুরীর হঠাৎ মৃত্যুর সঙ্গে। তবে তাঁর দাম্পত্যের বর্ণনা পাওয়া যায় ইন্দিরাদেবীর স্মৃতিকথায়। তাঁর রান্নাঘরে হিন্দু ও মুসলমান একসঙ্গে রান্না করত। তখনকার সময় এ ছিল উল্লেখ করার মতো উদারতা।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪২: ভৃত্য যদি কোনও অপরাধ করেন, তার দণ্ড প্রভুকেই পেতে হয়

স্বামীর মৃত্যুর পর কলকাতায় এসে সরলা দেবী বিপুল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সাহিত্য সেবা ও জনহিতকর কাজে মগ্ন হন। ভারতী পত্রিকার সম্পাদনা, ভারত স্ত্রী মহামণ্ডলের কলকাতা শাখার কাজের ভার, নারীশিক্ষার জন্য একটি শিক্ষাসদন, ছাত্রীনিবাস ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর আচার্য বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মার সঙ্গে পরিচয় ও তাঁর শাস্ত্রব্যাখ্যায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গুরুপদে বরণ করেন। ব্রাহ্ম পরিমণ্ডলে বড় হওয়া ,দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রীর পক্ষে এ এক বিপ্লব। সরলা দেবী সারাজীবন নিজের জীবনচর্যায় বিপ্লবের ফুল ফুটয়ে গিয়েছেন। পুরনো দিনের মেয়েদের কাছে তিনি মুক্ত দখিনা বাতাস, ছদ্মবেশী সরস্বতী।

জীবন তো পদ্মপাতায় জল। গড়িয়ে চলে নিজের নিয়মে। কিন্তু গল্পগুলো রয়ে যায়। সরলাদেবী সেই আমলে এক দাপুটে ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর বিদ্যাচর্চার দ্যুতি একালেও ঝলমল করে চলছে। সরস্বতীর বরপুত্রীকে সেলাম।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content