আয়ালসোমায়াজুল ললিতা।
ছোটবেলা থেকে নিজের মাকে শ্যামলা জানতেন একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। মামারা সবাই ইঞ্জিনিয়ার, দাদু ইঞ্জিনিয়ার, তাঁর মাও ইঞ্জিনিয়ার। কিন্ত বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বোঝেন যে, তাঁর মা আয়ালসোমায়াজুল (এ ললিতা) ললিতা শুধুই ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার এবং স্বাধীনতা উত্তর ভারতের নারী শিক্ষার অন্যতম প্রধান নাম।
কর্মক্ষেত্রে।
সময়কাল বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ। ভারতে তখন বৈধব্য মানেই ভয়ানক পরিস্থিতিতে জীবনযাপন, কখনও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য জীবনহানি, কখনও আবার সাধারণ সামাজিক অবস্থান থেকে বিতাড়ন। বিধবা বিবাহের প্রসারও কম। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৩৪ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে এ ললিতা-র বিবাহ হয়ে যায় এক দক্ষিণ ভারতীয় পরিবারে। ১৯৩৭-এ আঠারো বছর বয়সে তাঁর কন্যা শ্যামলা জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু ভয়ানক ভাগ্যবিপর্যয়ে তার ঠিক চার মাসের মাথায় ললিতার স্বামী মারা যান। তাঁর শাশুড়িমাতা সন্তান শোকের জ্বালা ভোলাতে পুত্রবধূর ওপর নানান অত্যাচার শুরু করেন। পরিস্থিতি অসহনীয় হলে ললিতা দুধের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসেন। আর তারপরেই বাবা ও ভাইদের সঠিক সিদ্ধান্তে আবার মূলধারার পড়াশোনায় প্রবেশ করেন। তার মানে কখনই এটা ছিল না যে কিছুদিন পড়াশোনা করেই তিনি নিজেকে সরিয়ে নেবেন।
দ্বাদশ শ্রেণির পর তাঁর পড়াশোনার জন্য অনুমতি নেওয়া হয় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। কারণ, তাঁর বিষয় ছিল ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, আর সেই ক্ষেত্রে তখন শুধুই পুরুষদের বিচরণ। মহিলা ইঞ্জিনিয়ার তখন কষ্টকল্পনা! তিনি এবং তাঁর অপর দু’জন সহপাঠিনী, তাঁরাই প্রথম ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার পঠনপাঠনের নথিভুক্ত ছাত্রী। এ ললিতা-র পড়াশোনার জীবন শুরুর প্রায় দেড় হাজার বছর আগে থেকেই এ দেশের মেয়েদের বাড়ির বাইরে গিয়ে পড়াশোনার অধিকার খর্ব হয়, বাবা-ভাইয়ের কাছে প্রাথমিক পড়াশোনাই মেয়েদের শিক্ষার মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারিত হতো। সেই ধারার ওলটপালট করে যখন স্বাধীনতার পূর্বে ভারতীয় পরিবারগুলো তাদের বাড়ির মেয়েদের পড়াশোনার জগতে এগিয়ে দেয়, সেই সময় ললিতার পরিবার ছিল অন্যতম।
আরও পড়ুন:
দশভুজা: রুমা দেবী—তিরিশ হাজার মহিলার ভাগ্য পরিবর্তনের কান্ডারি তিনি
ছোটদের যত্নে: হঠাৎই জ্বর, মুখে-হাতে ঘা হচ্ছে শিশুদের! কষ্টকর হলেও ভয়ের কিছু নেই, জেনে নিন কোন রোগের উপসর্গ এগুলি
বাইরে দূরে: অযোধ্যা— প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৯: দুঃসময়ের স্মৃতিগুলো ‘কার পাপে’? [১৫/০৮/১৯৫২]
১৯১৯ সালের ২৭ আগস্ট মাদ্রাজের এক মধ্যবিত্ত তেলেগু পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবা এবং ভাইয়েরা সকলেই তৎকালীন ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রাজের অন্তর্গত কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, গিন্ডি (সিইজি) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। এহেন পড়াশোনা কেন্দ্রিক, উজ্জ্বল পরিবারের ভাগ্যবিড়ম্বিত তিনি যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চিরতরে চলে আসেন, তখন থেকেই নিজের এবং মেয়ের কথা ভেবে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। পেশাগত ডিগ্রি অর্জনের জন্য চেন্নাইয়ের কুইন্স মারি কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। বরাবর মেধাবী তিনি সেই সময় তাঁর বাবা আর অন্যান্য ভাইদের মতো পড়াশোনার বিষয় হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নেন।
বাবা ও ভাইদের সঙ্গে ললিতা।
ললিতার বাবা পাপ্পু সুব্বা রাও তখন সিইজি -এর প্রফেসর। মেয়ের হয়ে তিনি সেই সময় প্রিন্সিপাল ও তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে অনুমতি নেন। এর পরেই গিণ্ডির সেই বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দরজা ছাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৯৪০ সালে চার বছরের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে তিনি ভর্তি হন। একশোরও বেশি ছাত্রদের মধ্যে তিনি একা ছাত্রী, কিন্তু সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কখনও কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি সেই সময়। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর জন্য পৃথক হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দেয়। মামার বাড়িতে দাদু, দিদা, মামাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন শ্যামলা। সপ্তাহান্তে ললিতা এসে মেয়েকে দেখে যেতেন সেই সময় আর তার সঙ্গে চলতে থাকে কঠোর অধ্যবসায়। ভালো লাগার বিষয়কে আরও ভালো করে জেনে, বুঝে নেওয়া।
১৯৪৪-এ তিনি স্নাতক হন। তাঁর শংসাপত্রে ‘হি’ (He) কেটে হাতে করে ‘সি’ (She) লিখে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ডিগ্রি অর্জনের জন্য ১৯৪৩-এ তাঁকে জামালপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে এক বছরের জন্য অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে যোগ দিতে হয়। এরপর ১৯৪৪ সালে তিনি সেন্ট্রাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন অব ইন্ডিয়া, শিমলাতে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দেন। একা ছোট মেয়ের মা তিনি শিমলাতে তাঁর ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য সেই চাকরি নেন। কারণ সেই সময় একা মহিলাকে বাড়ি ভাড়া দিতে কেউ রাজি হত না। নিজের বউদির প্রত্যক্ষ সাহায্য পান তিনি।
১৯৪৪-এ তিনি স্নাতক হন। তাঁর শংসাপত্রে ‘হি’ (He) কেটে হাতে করে ‘সি’ (She) লিখে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ডিগ্রি অর্জনের জন্য ১৯৪৩-এ তাঁকে জামালপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে এক বছরের জন্য অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে যোগ দিতে হয়। এরপর ১৯৪৪ সালে তিনি সেন্ট্রাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন অব ইন্ডিয়া, শিমলাতে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দেন। একা ছোট মেয়ের মা তিনি শিমলাতে তাঁর ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য সেই চাকরি নেন। কারণ সেই সময় একা মহিলাকে বাড়ি ভাড়া দিতে কেউ রাজি হত না। নিজের বউদির প্রত্যক্ষ সাহায্য পান তিনি।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৯: ঠাকুরবাড়ির বিয়েতে এমন জাঁকজমক আর হয়নি
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২৮: অনুপুষ্টিতে ভরপুর পুঁটিমাছ ছোটদের দৃষ্টিশক্তির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২১: মন্থরার মন্ত্রণাবিষ—নয় রাজসিংহাসন, হোক নির্বাসন
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪০: লোপামুদ্রার আবদারে ধনের অনুসন্ধানে নির্গত হলেন অগস্ত্যমুনি
কিন্তু ১৯৪৬-এ তাঁর বাবার অনুরোধে তাঁকে সাহায্য করতে শিমলার চাকরি ছেড়ে মাদ্রাজে ফিরে আসেন। মেয়ের সাহায্যে তিনি একাধিক পেটেন্টের জন্য আবেদন জানান, তার মধ্যে জেলেক্ট্রোমোনিয়াম (একধরনের ইলেক্ট্রিক্যাল মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট), স্মোকলেস ওভেন, ইলেক্ট্রিক ফ্লেম প্রডিউসার প্রধান ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে তিনি ১৯৪৮-এ কলকাতার অ্যাসোসিয়েটেড ইলেক্ট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজে (এইআই) যোগ দেন। কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে চলে আসার অন্যতম কারণ, তাঁর মেজ ভাইয়ের পরিবারের উপস্থিতি।
মেয়ে শ্যামলা।
এই চাকরিতে থাকাকালীন তিনি অনেক উল্লেখযোগ্য প্রজেক্টে কাজ করেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভাকরা নাঙ্গাল ড্যামের ইলেক্ট্রিক্যাল জেনেরেটরগুলোর ওপর তাঁর কাজ। অ্যাসোসিয়েটেড ইলেক্ট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, যা পরে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে পরিবর্তিত হয়, সেখানে টানা তিরিশ বছর কাজ করার পর তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা ছিল ১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্কে মহিলা ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানীদের প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে (আইসিডব্লুইএস) পঁয়ত্রিশটি দেশের পাঁচশ প্রতিনিধির মধ্যে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। সেই কনফারেন্সে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ১৫০ বছর আগে হলে আমি আমার স্বামীর চিতায় বিসর্জিত হতাম। তাই যে সুযোগ তিনি সেই সময় পেয়েছিলেন সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশে ফিরে এসে অনেক সংবাদপত্রে ও পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে পরবর্তী কনফারেন্সে আরও মহিলা ইঞ্জিনিয়ারদের যোগদানের উৎসাহ দেন।
নিউইয়র্কে একটি কনফারেন্সে।
ফলস্বরূপ ১৯৬৭ সালে আইসিডব্লুইএস-এর দ্বিতীয় কনফারেন্সে পাঁচজন ভারতীয় মহিলা প্রতিযোগী সরাসরি যোগ দেন। এ ললিতা নিজের অকাল বৈধব্যকে সঙ্গে করে যে শিশুকে নিয়ে এক বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে চলে আসেন। বাবার অভাব যাকে কখনও বুঝতে দেননি, সেই শ্যামলা নিজের মায়ের স্মরণে বলেছিলেন তাঁর মা সেই সময়ের অন্যতম খোলা মনের মানুষ ছিলেন। বিধবা বিবাহের পক্ষে তিনি নিজে কখনও দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। পড়াশোনা আর পেশাগত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ও মেয়ের জন্য সম্মানজনক জীবন গড়ে তোলেন। সেই দশভুজা ললিতা ১৯৭৯ সালে ষাট বছর বয়সে ব্রেন অ্যানিউরিজমের কারণে হঠাৎ মারা যান। কিন্তু তাঁর সাধনা আজও ভারতীয় মহিলা ইঞ্জিনিয়ারদের কাজের মধ্য দিয়ে অমর হয়ে আছে, থাকবে।