শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অধ্যবসায়ের অন্য নাম অধ্যাপিকা সি সন্থাম্মা — অনভ্যাসে বিষং শাস্ত্রম্ অর্থাৎ অভ্যাসহীন জ্ঞান মানুষের জীবনে বিষের মতো কাজ করে। কিন্তু অধ্যাপিকা সি সন্থাম্মা অর্থাৎ চিলুকুরি সন্থাম্মার জীবন সবসময় এই সংস্কৃত প্রবাদের বিপরীতে গিয়েছে। অভ্যাস আর অধ্যবসায় তাঁর জীবনের মূলমন্ত্রস্বরূপ। যেখানে আজও আর পাঁচজন মানুষ ষাট, পঁয়ষট্টি বছর বয়সেই অবসর যাপনের পরিকল্পনায় রত থাকেন, সেখানে পায়ের সমস্যা ও অন্যান্য সমস্যায় জর্জরিত ৯৫ বছর বয়েসী সান্থাম্মা সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন ষাট কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আজও ভিজিনগরমের সেঞ্চুরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের কাছে পদার্থবিদ্যার বিবিধ বিষয় পড়িয়ে আর বিবিধ জটিল সমস্যার সমাধান করে চলেছেন। হ্যাঁ, তিনিই এই সময়ের সবথেকে বরিষ্ঠা অধ্যাপিকা। তাঁর নিরলস সাধনার সামনে সব সাধনাই যেন ফিকে হয়ে যায়। পদার্থবিদ্যা তাঁর আবেগ আর পড়ানো তাঁর কাছে জীবনের নামান্তর।

হাঁটু প্রতিস্থাপনের ফলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলা তিনি বিগত আট বছর ধরে প্রত্যক্ষভাবে ফেলোশিপ-সহ সেঞ্চুরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল ফিজিক্স, রেডিওলজি এবং অ্যানেস্থেসিয়া বিষয়ে পড়ালেও তাঁর অধ্যাপনার জীবন সত্তর বছর ধরে বিস্তৃত। শারীরিক বয়স তাঁর কাজের ক্ষেত্রে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনি বলেন, শরীরের বয়স মনে, আর ভালো থাকা হৃদয়ে। তাই মন আর হৃদয়কে পরিপুষ্ট রেখে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিজের অধীত বিদ্যা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণের পক্ষপাতী তিনি। তাঁর নিয়মানুবর্তিতা, অভিনিবেশ আর কঠোর পরিশ্রম তাঁকে আজও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যমণি করে রেখেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে চলমান বিশ্বকোষ বলা হয়। ছুটির দিনেও তাঁর স্পেশাল ক্লাস করার জন্য ছাত্রছাত্রীরা অতি উৎসাহে উপস্থিত হয়। শুধু অধ্যাপনাই নয়, লোকহিতৈষী হিসেবেও তিনি পরিচিত। নিজের বাড়ি বিবেকানন্দ ট্রাস্টকে দান করে তিনি বর্তমানে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। এমন জনহিতৈষী বিশিষ্টা মহিলা ১৯২৯ সালে ৮ মার্চ দক্ষিণ ভারতের মছলিপট্টনমে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পাঁচ মাসের মধ্যে পিতৃবিয়োগের কারণে তিনি মাতুলালয়ে বড় হন। ১৯৪৫ সালে মহারাজ বিক্রম দেও ভার্মার কাছ থেকে পদার্থবিদ্যায় তিনি গোল্ড মেডেল পান। তখন তিনি বিশাখাপত্তনমের এভিএন কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। এরপর যথাক্রমে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক, মাইক্রোওয়েভ স্পেকট্রোকপির ওপর ডি এসসি (পিএচডি-র সমতুল্য) এবং অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৬ সালে লেকচারার পদে যোগদান করেন। লেকচারার থেকে প্রফেসর থেকে অনুসন্ধিৎসু বৈজ্ঞানিক থেকে একনিষ্ঠ পাঠক, এক জীবনে প্রফেসর সন্থাম্না কোনও কিছুই বাদ দেননি।
সব ভূমিকায় তিনি যথাযথ। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেমন সিএসআইআর, ইউজিসি, ডিএসটিতে তিনি ইনভেস্টিগেটিভ ইনচার্জ হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮৯ সালে ষাট বছর বয়সে নিয়ম অনুযায়ী অবসর নিলেও পুনরায় তিনি গবেষণায় ব্রতী হন। আর পরের ছয় বছর অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেরারি লেকচারার হিসেবে কাজ করে যান। এখন তাঁর দিন শুরু হয় ভোর চারটেয়। দিনে ছয়টি ক্লাস নিতে তিনি এখনও সক্ষম। কর্মে ব্রতী এই প্রফেসর বহুবার আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা এবং স্পেনের বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগদান করেছেন। অ্যাটমিক স্পেক্ট্রোকপি এবং মলিকিউলার স্পেক্ট্রোকপির ওপর তাঁর কাজ ২০১৬ সালে আবার তাঁকে প্রবীণ বিজ্ঞানী হিসেবে গোল্ড মেডেল এনে দিয়েছে। বহু বিখ্যাত মানুষ তাঁকে শিক্ষিকা হিসেবে পেয়েছেন।

মূলত অধ্যাপিকা সি সন্থাম্মার স্বামী যিনি তেলেগু সাহিত্যের প্রফেসর ছিলেন, তাঁর উৎসাহে তিনি বেদ, বেদান্ত, পুরানাদির প্রতি আকৃষ্ট হন। এই আকর্ষণের ফলে তিনি গীতার শ্লোকগুলোকে ইংরেজিতে রচনা করে নাম দেন, ভগবদ্গীতা — দ্য ডিভাইন ডাইরেক্টিভ। এহেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ নিজস্ব পড়াশোনার পাশাপাশি আজও উপনিষদের সরলীকরণে ব্যস্ত আছেন নতুন প্রজন্মের হাতে তা বই আকারে তুলে দেওয়ার জন্য। সারস্বত সাধনার প্রতিরূপা তিনি তাই সত্যিকারের দশভুজা।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

Skip to content